Published on Jan 25, 2022 Updated 0 Hours ago

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে পরিবর্তনশীল সমীকরণের প্রেক্ষিতে দুটি দ্বীপ দেশের কাছেই যথেষ্ট সুযোগ থাকছে একই সঙ্গে ভারত ও চিনের সঙ্গে মানিয়ে চলার।

দক্ষিণ এশিয়ায় দক্ষিণতম প্রান্তের ভারসাম্য এবং উপযোগিতা: ২০২১ সালে মলদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কা

ভারত ও চিনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং ইন্দো-প্যাসিফিকের ক্রমশ বাড়তে থাকা প্রাধান্য ভারত মহাসাগর এবং সংশ্লিষ্ট দ্বীপরাষ্ট্রগুলির প্রতি বিশ্বের আগ্রহকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। একই সঙ্গে এর প্রভাব পড়েছে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলির আচরণ এবং তাদের বিদেশনীতির উপরে। ২০২১ সালে মলদ্বীপ তার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতির প্রেক্ষিতে এই প্রতিযোগিতা থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। একই ভাবে শ্রীলঙ্কাও ভারত ও চিনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে আসন্ন অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

মলদ্বীপ: প্রতিযোগিতা থেকে সুবিধাভোগকারী দেশ

২০২১ সালেও মলদ্বীপ তার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতির প্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে। এটি অংশত ভাবে ভারতকে খুশি রাখার জন্য এবং খানিক চিনের ঋণের ফাঁদ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যও। বিশেষ করে যখন ইয়ামিন সরকার চিনের কাছ থেকে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে। একই সঙ্গে চিনের রোষের কারণ না হয়ে দেশটি অন্য মুখ্য শক্তিগুলির সঙ্গেও কৌশলগত ভাবে নিজের জায়গা তৈরির চেষ্টা করেছে।

ক্রমবর্ধমান চিনা ঋণ এবং তার মোকাবিলায় ভারতের সদিচ্ছা মলদ্বীপকে বাধ্য করেছে তার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতিকে পুনরায় সক্রিয় করে তুলতে। এই নীতির ধারাবাহিকতা উভয় দেশের তরফেই ২০২১ সালে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ স্বাভাবিক ভাবেই মলদ্বীপ ভারতকে দেশে তার দ্বিতীয় দূতাবাস খোলার অনুমতি দিয়েছে এবং ভারতের ভ্যাকসিন কূটনীতির প্রাথমিক সুবিধাভোগীদের মধ্যেও অন্যতম হিসেবে রয়েছে৷

এই নীতি এবং ভারতের সঙ্গে নৈকট্য দ্বীপ দেশটিকে নিরাপত্তা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা প্রদান করেছে। ভারত তার টহলদারি জাহাজ এবং বিমানের সাহায্যে মলদ্বীপের এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোনে (ই ই জেড) টহল ও নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। ২০২১ সালে ভারত মলদ্বীপের উথুরু থিলা ফালহু নৌ ঘাঁটিতে একটি ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স কোস্ট গার্ড হারবার তৈরি, সহযোগ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান চিনা ঋণ এবং তার মোকাবিলায় ভারতের সদিচ্ছা মলদ্বীপকে বাধ্য করেছে তার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতিকে পুনরায় সক্রিয় করে তুলতে।

উপরন্তু মলদ্বীপে চিনের আগ্রহও দ্বীপরাষ্ট্রটিকে ভারতের কাছ থেকে অত্যধিক প্রয়োজনীয় যুক্তিসঙ্গত এবং স্থিতিশীল বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সাহায্য করেছে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ভারত মলদ্বীপে ৪৫টি প্রধান উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছে যার সম্মিলিত মূল্য ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। ভারত সে দেশের বৃহত্তম পরিকাঠামো প্রকল্প… দ্য গ্রেটার মালে কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট-এ স্বাক্ষর করেছে এবং এটির জন্য ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ এবং ১০ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান মঞ্জুর করেছে। এই ভাবেই তারা মলদ্বীপের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং প্রণোদনা আনার কাজ করছে।

অন্য দিকে চিন এ বছর প্রাপকদের দলে ছিল। মলদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বেশ কিছু প্রচেষ্টা চালিয়েছে, বি আর আই প্রকল্পগুলির উপরে জোর দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে এবং চিনের কাছ থেকে কোভিড টিকাও গ্রহণ করেছে, এবং এই সমস্ত সুবিধে নেওয়ার মাধ্যমে তারা চিনকে তুষ্ট রেখেছে। তবুও এর ফলাফলগুলির উপরে তেমন জোর দেওয়া যায় না। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মলদ্বীপে চিনের একটি মাত্র সক্রিয় প্রকল্প ছিল এবং ২০২১ সালের ডিসেম্বরে একটি অতিরিক্ত শক্তি প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

ভারতের জন্য মলদ্বীপের অগ্রাধিকারের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নিয়েও চিনের অভ্যন্তরে নিজস্ব সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও কিছু ধারণা রয়েছে। বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে চিন-দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য বিমোচন এবং সমবায় উন্নয়ন ও চিন-দক্ষিণ এশিয়া জরুরি সরঞ্জাম ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প থেকে চিন মলদ্বীপকে বাদ রেখেছে

এ ছাড়াও মলদ্বীপ এ বছর বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ঘটনাবলিতে তার আগ্রহ দেখিয়েছে। মলদ্বীপ নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ত্রিপাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপের মাধ্যমে ভারত ও শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি ভারত মহাসাগরে নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরার পরিকল্পনা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মলদ্বীপ প্রথম বার্ষিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আলোচনায় মুখোমুখি হয়েছে এবং দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কূটনৈতিক মিশন আয়োজনের জন্য তা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, মলদ্বীপও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জরুরি ও আর্থিক সহায়তাকে স্বাগত জানিয়েছে

চিনের প্রভাবকে সীমিত করার জন্য ও ঋণের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মলদ্বীপ ভারত এবং অন্য দেশগুলির সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে।

সামগ্রিক ভাবে চিনের প্রভাবকে সীমিত করার জন্য ও ঋণের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মলদ্বীপ ভারত এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে। একই সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উদ্ভূত প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সুবিধা লাভের আশায় তারা চিনকে চটানোর ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছে।

শ্রীলঙ্কা: ভারসাম্য উন্নয়নের শিল্প

২০২১ সালে শ্রীলঙ্কা ভারত ও চিনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার শিল্পকে উন্নত করেছে। তবে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করা এবং আসন্ন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর মতো দিকগুলি তার বিদেশনীতিকে প্রভাবিত করেছে।

ইস্টার্ন কন্টেনার টার্মিনালের (ই সি টি) ভবিষ্যৎ নিয়ে তীব্র মতবিরোধের মধ্য দিয়ে বছরটি শুরু হয়েছিল। দেশব্যাপী প্রতিবাদ এবং পরোক্ষ চিনা সমর্থন শ্রীলঙ্কাকে তার ই সি টি প্রকল্প পর্যালোচনা এবং একতরফা ভাবে বাতিল করতে প্ররোচিত করে, যা তার অংশীদার ভারত এবং জাপানকে হতাশার মুখে ঠেলে দেয়। এ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা একটি চিনা সংস্থাকে জাফনা উপদ্বীপের কয়েকটি শক্তি প্রকল্পের প্রস্তাবও দিয়েছে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টও কলম্বো পোর্ট সিটি ইকনমিক কমার্শিয়াল বিল পাস করে, যা নয়াদিল্লির অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়। এই বিলটি অঞ্চলটিকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং বিদেশিদের সরকারি প্রশাসনে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে।

চিনের মন জুগিয়ে চলার এই সব প্রচেষ্টার নেপথ্যেও কারণ ছিল। ২০২১ সালে তার বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ছাড়াও শ্রীলঙ্কাকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এই ভাবে মুদ্রা অদলবদল, বৈদেশিক মুদ্রার মেয়াদি অর্থায়ন সুবিধা (এফ টি এফ এফ) এবং অনুদানের জন্য চিনের উপর শ্রীলঙ্কার নির্ভরতা অবিচ্ছিন্ন থেকেছে। ফলে চিনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ, নতুন ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর এবং অতিরিক্ত নতুন ঋণের অনুরোধ অব্যাহত রয়েছে শ্রীলঙ্কার তরফে।

অন্য দিকে শ্রীলঙ্কা সরকার বেশ ভাল ভাবেই জানত যে, তাদের বা ভারত সরকার উভয়ের পক্ষে একে অপরকে সম্পূর্ণ ভাবে পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কা এই কারণেই আদানি গ্রুপের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন কন্টেনার টার্মিনাল (ডব্লিউ সি টি) চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং কম সাফল্য সত্ত্বেও একাধিক ক্ষেত্রে ভারতের কাছে আর্থিক সহায়তার জন্য অনুরোধ জানায়। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা অব্যাহত ভাবেই ভারতের কাছ থেকে মানবিক এবং কোভিড সংক্রান্ত সহযোগিতা, বিনিয়োগ এবং ঋণ গ্রহণ করেছে, শ্রীলঙ্কার চিনপন্থী ঝোঁক নিয়ে ভারত অসন্তুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও।

শ্রীলঙ্কা এই কারণেই আদানি গ্রুপের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন কন্টেনার টার্মিনাল (ডব্লিউ সি টি) চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং কম সাফল্য সত্ত্বেও একাধিক ক্ষেত্রে ভারতের কাছে আর্থিক সহায়তার জন্য অনুরোধ জানায়।

যদিও ২০২১ সালের শেষের দিকে ভারতকে আকৃষ্ট করার জন্য শ্রীলঙ্কার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত হয়। সার চুক্তি নিয়ে শ্রীলঙ্কা এবং চিনের মতবিরোধ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের কাছে তরল সারের আপৎকালীন জোগানের জন্য অনুরোধ জানায় শ্রীলঙ্কা। সাধারণত ভারতের বিরুদ্ধে চিনকে ব্যবহার করার যে প্রথাগত কৌশল শ্রীলঙ্কা এত দিন চালিয়ে এসেছে, এখন তার বিপরীতে গিয়ে তারা চিনের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহারের নতুন প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছে।

পরবর্তী সপ্তাহগুলিতে শ্রীলঙ্কা ভারতের সঙ্গে একটি আর্থিক চুক্তিও চূড়ান্ত করেছে যা শ্রীলঙ্কা সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টির কারণে ভারত দীর্ঘ দিন আটকে রেখেছিল। এই নতুন চুক্তিতে ভারত শ্রীলঙ্কাকে মুদ্রা বিনিময়, শক্তি নিরাপত্তা এবং খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামের আমদানির জন্য ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর বিনিময়ে শ্রীলঙ্কাও জাফনা উপদ্বীপে চিনা প্রকল্প বাতিল করে এবং কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ত্রিনকোমালি ট্যাঙ্ক ফার্মের আধুনিকীকরণের জন্য ভারতকে প্রস্তাব দিয়েছে। এই সব ঘটনা এ দিকেও নির্দেশ করে যে চাইলে শ্রীলঙ্কা চিনের সঙ্গেও ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারে।

উপসংহার

দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতি মলদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কার মতো দ্বীপ রাষ্ট্রগুলিকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছে। যদিও উভয় দেশই এই প্রতিযোগিতা থেকে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেছে, আশা করা যায়, যে আগামী বছরগুলিতে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র হয়ে উঠবে।

ইয়ামিনের বেকসুর খালাস, ইন্ডিয়া আউট প্রচারণার পক্ষে ওকালতি বৃদ্ধি, মলদ্বীপে চিনের আগ্রহ এবং ভারতীয় প্রযুক্তিবিদ, কর্মী এবং কর্মকর্তাদের উপস্থিতির রাজনীতিকরণ এই ইঙ্গিত দেয় যে, মলদ্বীপে ২০২৩ সালের সাধারণ নির্বাচন কেবল মাত্র এই প্রভাবের খেলাকে আরও তীব্র করে তুলবে। একই রকম ভাবে শ্রীলঙ্কায় চিনের আগ্রহ ও প্রভাব, তার ঋণের জালে জড়িয়ে রাখার কূটনীতি এবং উত্তর শ্রীলঙ্কায় ও তামিল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের নতুন উদ্দেশ্য ভারতকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলবে। সামগ্রিক ভাবে মলদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কা উভয়ই ২০২২ সালে একটি তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বছরের দিকে এগোচ্ছে এবং আগামী ভবিষ্যতে তাদের প্রতিক্রিয়া এবং পারস্পরিক ভারসাম্য কেমন হতে চলেছে, এখন সেটাই দেখার।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.