স্বাধীনতার মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে ‘এশিয়ান টাইগার’-এ পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭০ সালের বিধ্বংসী গ্রেট সাইক্লোন দ্বারা চিহ্নিত একটি টালমাটাল সূচনা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ করে রেডিমেড গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাক (আরএমজি) ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে দেশটির অর্থনৈতিক রূপান্তর আন্তরিক ভাবে শুরু হয়েছিল এবং অতিমারি-আক্রান্ত বছর অর্থাৎ ২০২০ সাল বাদ দিয়ে ২০১১ সাল থেকে জিডিপি বৃদ্ধির হার ধারাবাহিক ভাবে ৬ শতাংশের উপরে ছিল।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট নাটকীয় ভাবে কৃষিভিত্তিক শিকড় থেকে সরে এসেছে। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে কৃষি জিডিপির ৬০ শতাংশের জন্য দায়বদ্ধ থাকলেও সেই পরিসংখ্যান বর্তমানে প্রায় ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। জিডিপিতে শিল্পের হার বেড়েছে ৩৩ শতাংশ এবং পরিষেবা এখন ৫৫ শতাংশ অবদান রাখে, যা বাণিজ্য উদারীকরণ এবং শিল্প বৃদ্ধির দ্বারা চালিত একটি বিস্তৃত কাঠামোগত রূপান্তরকে প্রতিফলিত করে। কৃষি থেকে কাঁচামাল তৈরিতে আমদানির সংমিশ্রণ স্থানান্তরিত হওয়া সত্ত্বেও রফতানি আয়ের জন্য আরএমজির উপর দেশের অত্যধিক নির্ভরশীলতা ইস্পাত, রাসায়নিক এবং পরিবহণ সরঞ্জামের মতো আরও জটিল উত্পাদন খাতে বৈচিত্র্য না আনার দরুন ভবিষ্যতের বৃদ্ধিকে হুমকির মুখে ফেলে।
চিত্র ১: রফতানির প্রবণতা এবং মোট রফতানিতে আরএমজির পরিমাণ (১৯৮৩–২০১৮)
সূত্র: এস রায়হান এবং এস এস খান (২০২০), কাঠামোগত রূপান্তর, বৈষম্যের গতিশীলতা এবং বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধি
আরএমজি খাত আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি, যা দেশের রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশও বটে। রফতানির হার ২০১১ সালে ১৪.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০১৯ সালে ৩৩.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে ৭ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন ক্ষেত্রটিও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যাই হোক, কম মূল্যের পোশাকের উপর আরএমজি ক্ষেত্রের মনোযোগ এটিকে বিশ্বব্যাপী বাজারের অস্থিরতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে, যেমনটা কোভিড-১৯ অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের কারণে সৃষ্ট বাধাগুলির দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে।
এর উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশে আরএমজি ক্ষেত্রটি বেশ কিছু জটিল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যা এর দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে।
এর উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশে আরএমজি ক্ষেত্রটি বেশ কিছু জটিল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যা এর দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে। ভিয়েতনামের মতো দেশগুলি থেকে বাড়তে থাকা প্রতিযোগিতার কারণে ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয় এবং পরিকাঠামোগত ঘাটতি হল উল্লেখযোগ্য বাধা। এ ছাড়া, নিম্ন মজুরির শ্রমের উপর ক্ষেত্রটির অত্যধিক নির্ভরশীলতা এবং রফতানির জন্য পশ্চিমী বাজারের উপর নির্ভরশীলতা রফতানির বহুমুখীকরণের জরুরি প্রয়োজনীয়তাকেই দর্শায়।
চিত্র ২: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম থেকে পোশাক আমদানির মূল্য বৃদ্ধি (২০১১-২০২০)
উত্স: ইউরোস্ট্যাট; ইউএসআইটিসি; ম্যাককিনসে অ্যানালিসিস
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সম্প্রতি, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বিচার বিভাগ সরকারি চাকরির জন্য কোটা পদ্ধতি পুনঃস্থাপন করার পরে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ২০১৮ সালের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পরে বাংলাদেশে বিক্ষোভ শুরু হয়। এই ব্যবস্থাটির দরুন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর জন্য ৩০ শতাংশ চাকরি সংরক্ষিত ছিল, যা অনেক শিক্ষার্থীর মতে ছিল সীমিত যোগ্যতাভিত্তিক সুযোগ। উচ্চ যুব বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যেই বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়। পুলিশ এবং সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষ হয়, যার ফলে অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং হাসিনার প্রশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
সম্প্রতি, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বিচার বিভাগ সরকারি চাকরির জন্য কোটা পদ্ধতি পুনঃস্থাপন করার পরে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ২০১৮ সালের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পরে বাংলাদেশে বিক্ষোভ শুরু হয়।
বাংলাদেশে বিক্ষোভ ব্যাপক ভাবে আন্তর্জাতিক নিন্দার ঝড় তুলেছে। প্রত্যাশিত হিসাবে, সরকারের চাকরির কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্যমান বিক্ষোভের মাঝে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার বজায় রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। জানুয়ারি মাসে পুনঃনির্বাচনের পর এই পরিস্থিতি হাসিনার সরকারের জন্য প্রথম উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে। বাংলাদেশের নির্বাচনটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও ন্যায্য নয় বলেই মনে করেছিল। ২০২৪ সালের ৩ অগস্ট বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীরা সরকারি চাকরির কোটার বিরুদ্ধে গত মাসে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে ২০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল, যার ফলে আরও বেশি বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছিল। সঙ্কটটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে দেশব্যাপী আইন অমান্য অভিযানে রূপান্তরিত হয়েছে এবং শেখ হাসিনা তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন-সহ মানবাধিকার সংস্থা ও পশ্চিমী সরকারগুলি বাক্স্বাধীনতা দমন এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর সহিংস দমন-পীড়নের সমালোচনা করেছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে শাসন পরিবর্তনের প্ররোচনা দেওয়ার দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলে গণতন্ত্রের দূরীকরণ এবং একটি অগণতান্ত্রিক সরকার প্রবর্তনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তাঁর আওয়ামী লীগ পার্টির অধীনে সংসদে হাসিনার বক্তব্য ওয়াশিংটনের তরফে মানবাধিকার বিষয়ক আরও বেশি নজরদারি ও নিরীক্ষণকেই উস্কে দিয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে, বাজারে আরও ভাল প্রবেশাধিকার সুনিশ্চিত করতে এবং উন্নয়নমূলক উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য একটি নতুন পার্টনারশিপ অ্যান্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট বা অংশীদারি ও সহযোগিতা চুক্তি (পিসিএ) নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা স্থগিত করে। ইইউ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক অংশীদার, যেটি ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ২০.৭ শতাংশ বাণিজ্যের জন্য দায়বদ্ধ ছিল এবং সেপ্টেম্বর মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত আলোচনা স্থগিত রাখাও আসলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অস্থিরতার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে প্রতিক্রিয়াকে দর্শায়। ইইউ বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও মানবাধিকার সম্পর্কে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
কূটনীতি এবং বাণিজ্য সম্পর্কের ভারসাম্য
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পশ্চিমী শক্তির হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও উভয় পক্ষের তরফে যে কোনও চরম পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধি পশ্চিমী দেশগুলিতে রফতানির উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। তাই যে কোনও সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা বা বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ উল্লেখযোগ্য ভাবে অর্থনীতির ক্ষতি করতে পারে। সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা এড়াতে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সুনিশ্চিত করতে পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পশ্চিমী শক্তির হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও উভয় পক্ষের যে কোনও চরম পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের আরএমজি আমদানিতে পশ্চিমী আধিপত্য স্পষ্ট হয় পশ্চিমী দেশগুলি, প্রাথমিক ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। এটি প্রধানত বাংলাদেশের বাজারের উপর নির্ভরশীলতা দ্বারা চিহ্নিত এবং বাংলাদেশের আরএমজি রফতানির ৮০ শতাংশ এই পশ্চিমী বাজারেই চালিত হয়। বাংলাদেশি আরএমজি কারখানার খরচের সুবিধা এবং উল্লেখযোগ্য উৎপাদন ক্ষমতা প্রধান পশ্চিমী পোশাক ব্র্যান্ডগুলির পাশাপাশি কৌশলগত সরবরাহকারী সম্পর্ককেও চালিত করে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরএমজি ক্ষেত্রটি রফতানি আয় এবং কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য ভাবে অবদান রাখে। তা সত্ত্বেও এটি পশ্চিমী চাহিদা, বাজারের পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে রাজনৈতিক ধারণার উপর দেশের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাকেও তুলে ধরে।
পশ্চিমী চাহিদা বাংলাদেশের আরএমজি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এটি একই সঙ্গে বাহ্যিক অর্থনৈতিক চাপ এবং নৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এর দুর্বলতাকেও তুলে ধরে। অবশেষে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই তার রফতানি ও আমদানি ক্ষেত্রে কৌশলগত বহুমুখীকরণ এবং স্থিতিস্থাপকতার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। আরএমজি শিল্পের বাইরে রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এবং ব্যবসায়িক অংশীদারদের সম্প্রসারণ একক বাজারের উপর নির্ভরতা কমাতে পারে এবং অর্থনৈতিক বাধার ঝুঁকি কমাতে পারে। একই ভাবে, আমদানি উৎসের বৈচিত্র্যকরণ অপরিহার্য পণ্যের স্থিতিশীল সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে পারে এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
সৌম্য ভৌমিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সেন্টার ফর নিউ ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
(দ্রষ্টব্য – এই প্রতিবেদনটির জন্য একই লেখকের লেখা ‘আ গেম অব শ্যাডোজ – গ্রোথ, ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড সিস্টেমিক শকস ইন দ্য বাংলাদেশ ইকোনমি’ থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে সারসংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে জিপিটি-৪ও ব্যবহার করা হয়েছে। তারপর তথ্য সম্পাদনা করা হয়েছে এবং প্রতিবেদনের প্রথম চারটি অনুচ্ছেদে সেই তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।)
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.