২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া একটি ঐতিহাসিক সুরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মূল লক্ষ্য হল চিনের উত্থানকে প্রতিহত করা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন একটি ভার্চুয়াল সম্মেলনে যৌথ ভাবে ‘অউকাস’ নামে এই উদ্যোগের ঘোষণা করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়া আমেরিকার দেওয়া প্রযুক্তির সাহায্যে পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ তৈরি করতে পারবে। এর আগে আমেরিকা তার এই প্রযুক্তি শুধু মাত্র ব্রিটেনের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল। শোনা যাচ্ছে, অউকাস চুক্তির আওতায় থাকবে দেশগুলির মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার প্রযুক্তি এবং অন্যান্য আন্তঃসামুদ্রিক প্রযুক্তির পারস্পরিক আদানপ্রদান। তবে প্রাথমিক ভাবে এই চুক্তির লক্ষ্য হবে সামরিক ক্ষমতার সশক্তিকরণ।
এই যৌথ বিবৃতি অনুসারে, চুক্তিটি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সুরক্ষা ও উন্নয়নের ধারাকে মজবুত করতে এবং নিজেদের মূল্যবোধকে রক্ষা করতে সমমনস্ক তিনটি দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক সুযোগ।’ ব্রিটিশ সরকারের বিবৃতিতে এ কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘অউকাস জোটের অধীনে আমরা যৌথ উদ্যোগ বৃদ্ধির উপরে নজর দেব। প্রযুক্তির পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের সুরক্ষার দিকটি এবং আমাদের সকলের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যগুলির সশক্তিকরণকে সুনিশ্চিত করা যাবে। অউকাস চুক্তি সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মধ্যে সুরক্ষা ও সামরিক ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বাণিজ্যিক ঘাঁটি এবং সরবরাহ শৃংখলগুলির মধ্যে গভীর সমন্বয় সাধনের উপরে জোর দেবে।’ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন যে, তিনটি দেশেরই কর্মীদল একত্রে কাজ করবে এবং আগামী ১৮ মাসের মধ্যে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনীর জন্য পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজের বহর নির্মাণের যৌথ পরিকল্পনা পেশ করবে। এই নির্মাণকাজটি অ্যাডিলেডে হতে চলেছে। অস্ট্রেলিয়ার জন্য অউকাস চুক্তি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দীর্ঘ সময়ের জন্য অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু শক্তি চালিত ডুবোজাহাজগুলি মোতায়েন করার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার পথ খুলে দেবে।
এই যৌথ বিবৃতি অনুসারে, চুক্তিটি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সুরক্ষা ও উন্নয়নের ধারাকে মজবুত করতে এবং নিজেদের মূল্যবোধকে রক্ষা করতে সমমনস্ক তিনটি দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক সুযোগ।’
অউকাসের বহুমাত্রিকতা, যেমন — সামরিক শক্তির আন্তঃব্যবহারযোগ্যতা বৃদ্ধি এবং সাইবার স্পেস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ও কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মতো সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলিতে পারস্পরিক সহযোগিতা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের প্রভাব বিস্তারকে প্রতিহত করার জন্য অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান আরও মজবুত করে তুলবে।
চিন প্রশ্ন
যদিও এই বিবৃতিতে এ কথা সরাসরি বলা হয়নি, কিন্তু এই ত্রিদেশীয় জোটের প্রধান লক্ষ্য হল চিনের আগ্রাসনের মোকাবিলা করা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলি, বিশেষত অস্ট্রেলিয়া তার পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে অবস্থিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে পরিকাঠামো নির্মাণে চিনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তিত। পাশাপাশি, কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎস সন্ধানে তদন্ত শুরু করার পর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চিনের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা নিয়েও দুশ্চিন্তার মেঘ কাটছে না।
বিগত বছরগুলিতে অস্ট্রেলিয়া চিনের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেই সম্পর্ক হোঁচট খেয়েছে। বিশেষত দক্ষিণ চিন সমুদ্রে, হংকংয়ে এবং তাইওয়ান প্রণালীতে চিনের আগ্রাসন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে উদবেগের সৃষ্টি করেছে। প্রতিরক্ষা চুক্তি চূড়ান্ত করার পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলে বর্তমান কৌশলগত পরিবেশের পাশাপাশি আগামী দিনের সম্ভাব্য পরিবর্তনগুলোর কথাও মাথায় রাখতে হবে। কারণ, আমাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের দেশের তথা সারা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মুক্ত এবং স্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উপরে, যা আগামী দশকগুলিতে আরও সহিষ্ণু ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে।’
পারমাণবিক শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ নির্মাণের চুক্তি অঞ্চলটির শান্তি এবং স্থিতাবস্থাকে গভীর ভাবে বিঘ্নিত করেছে। এর ফলে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়ে উঠবে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধি না করার প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে।
ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলির প্রতিক্রিয়া
অস্ট্রেলিয়া এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সে নিউক্লিয়ার নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি (এন পি টি) বা পরমাণু অস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তি মেনে চলবে এবং এই চুক্তির পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি বা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার নির্দেশ মতো একটি পরমাণু অস্ত্রবিহীন দেশ হওয়ার সমস্ত দায়িত্ব পালন করবে। কোনও কোনও দেশ যদিও এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এটা বলে যে, ‘এই সিদ্ধান্ত পরোক্ষ ভাবে পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।’ বিশেষ করে চিনের বিদেশমন্ত্রক ঘোষণা করেছে যে, ‘পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ নির্মাণের চুক্তি অঞ্চলটির শান্তি এবং স্থিতাবস্থাকে গভীর ভাবে বিঘ্নিত করেছে। এর ফলে পরমাণু অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়ে উঠবে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে পরমাণু শক্তি বৃদ্ধি না করার প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে।’
এশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মন্তব্য অনুযায়ী, ‘তারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ সংক্রান্ত পদক্ষেপের উপরে নজর রাখছিল। এই চুক্তির ফলে অঞ্চলটিতে শুরু হতে চলা সম্ভাব্য অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং দেশগুলির ক্ষমতা প্রদর্শন নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।’ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘অউকাস চুক্তি নিয়ে তারা যথেষ্ট চিন্তিত কারণ এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় অনুঘটকের কাজ করবে।’ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির দুশ্চিন্তা, এই চুক্তি দক্ষিণ চিন সমুদ্রে চিনকে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠতে প্ররোচিত করবে। অন্য দিকে ফিলিপিনস এবং ভিয়েতনামের মতো আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলি অঞ্চল বহির্ভূত দেশগুলির ইন্দো-প্যাসিফিকে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারটিকে সুনজরে দেখছে। তাদের মতে অঞ্চল বহির্ভূত দেশগুলির উপস্থিতি ‘অঞ্চলটিতে চিনের আগ্রাসন এবং ক্ষমতা জাহির করার প্রবণতাকে রুখতে সাহায্য করবে। কোয়াড বা চতুর্দেশীয় জোটে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গী জাপান এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। অন্য দিকে ভারত এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ‘অউকাস ভারতের কোয়াড বা চতুর্দেশীয় জোটের সশক্তিকরণের পরিকল্পনাকে কোনও ভাবেই প্রভাবিত করবে না। ভারত এই দুটি জোটকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের বলে মনে করে। তার মতে অউকাস একটি সুরক্ষা সংক্রান্ত জোট, কিন্তু ভারতের চতুর্দেশীয় জোট বা কোয়াডের প্রধান লক্ষ্য কখনওই সুরক্ষা বিষয়ক নয়। এর পাশাপাশি অউকাস-এর থেকে তার নিজস্ব আগ্রহের দিকগুলি আলাদা রাখতে চায় ভারত।’
ফ্রান্স এবং অউকাস জোটভুক্ত দেশগুলির এই মতান্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এক অস্বস্তির বাতাবরণ তৈরি করেছে। এর ফলে আটলান্টিক সাগরের অন্য দিকের দেশগুলির মধ্যে সেই বিভাজন আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে আমেরিকার একক সিদ্ধান্তের পরবর্তী সময় থেকেই ক্রমশ প্রকট হতে শুরু করেছিল।
ইউরোপ
অউকাস চুক্তি ২০১৬ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ডুবোজাহাজ সংক্রান্ত অস্ট্রেলিয়ার চুক্তিকে আকস্মিক ভাবে শেষ করতে বাধ্য করেছে। ফ্রান্স এবং অউকাস জোটভুক্ত দেশগুলির এই মতান্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এক অস্বস্তির বাতাবরণ তৈরি করেছে। এর ফলে আটলান্টিক সাগরের অন্য দিকের দেশগুলির মধ্যে সেই বিভাজন আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে আমেরিকার একক সিদ্ধান্তের পরবর্তী সময় থেকেই ক্রমশ প্রকট হতে শুরু করেছিল। আটলান্টিক সাগরের অপর প্রান্তের দেশগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের ক্রমাবনতি রুখতে আফগান সংকটের মধ্যেই ব্রাসেলসকে ইউরোপিয়ান কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের রাশ নিজের হাতে নিতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক পরমাণু চুক্তির সময়ে অউকাস ফ্রান্স এবং ইইউ বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বাইরে রেখেছে। যার ফলে ২৪৩ বছরের দীর্ঘ সম্পর্কের ইতিহাসে প্রথম বারের জন্য ফ্রান্স ক্যানবেরা ও আমেরিকা থেকে তার রাষ্ট্রদূতদের দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েছে।
ফ্রান্সের শাসনের আওতাধীন বেশ কয়েকটি অঞ্চল ইন্দো-প্যাসিফিকে অবস্থিত হওয়ার ফলে এই অঞ্চলটিতে সে একটি কৌশলগত ভূমিকা পালন করে। সর্বোপরি, বিশ্ববাণিজ্য ক্ষেত্রে অঞ্চলটির অংশীদারিত্ব এবং বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি অঞ্চলটিতে ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক বাণিজ্যের পরিমাণ ফ্রান্সকে ফ্রাঁসাফ্রিক বা সাব-সাহারান আফ্রিকায় ফ্রান্সের উপনিবেশগুলির বাইরেও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আগ্রহী করে তুলেছে, যা বিগত দশকগুলিতে যথেষ্ট পুঁজির অভাবে ফ্রান্সের পক্ষে করে ওঠা সম্ভব হয়নি। ২০১৮ সালের মে মাসে সিডনিতে যখন প্রেসিডেন্ট ম্যাকরঁ ফ্রান্সকে ইন্দো-প্যাসিফিক ক্ষমতার অন্যতম শরিক বলে ঘোষণা করেন, তার পরেই ইন্দো-প্যাসিফিক প্রসঙ্গে ফ্রান্সের গুরুত্ব বদলাতে শুরু করে। কারণ ফ্রান্সই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্গত প্রথম দেশ, যে ইন্দো-প্যাসিফিক-এর ধারণা গ্রহণ করেছে এবং এই অঞ্চলে নিজের কৌশলগত নীতির রূপরেখাও তৈরি করেছে।
যদিও অউকাস চুক্তির ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রবল ধাক্কা খেয়েছে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক শক্তি হিসেবে ফ্রান্সের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়েছে। প্যারিস নিয়ে ওয়াশিংটনকে জানানো ক্যানবেরার সম্মতি অঞ্চলটিতে চিনের আগ্রাসী মানসিকতা প্রতিরোধে ম্যাকরঁর প্রত্যাশায় জল ঢেলেছে। ফ্রান্সের সঙ্গে অ্যাটাক ক্লাস ডুবোজাহাজের চুক্তিভঙ্গের ফলে অস্ট্রেলিয়াকে কয়েকশো মিলিয়ন ইউরোর মতো বিশাল অঙ্কের টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকার সিদ্ধান্তে স্পষ্টতই ফ্রান্স ভীষণ রেগে আছে। ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রী জঁ ভেস লে দ্রিঁয়া এবং সামরিক প্রধান ফ্লোরেন্স পারলি অউকাস জোট গঠনে অস্ট্রেলিয়ার ফ্রান্সকে বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে খোলাখুলি ভাবে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
ফ্রান্স দ্বারা পরিচালিত ইইউ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তার এফ টি এ চুক্তি অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছিয়ে দিতে পারে। কারণ ইইউ-এর একাধিক সদস্য দেশই ফ্রান্সের সঙ্গে ‘বিশ্বাসভঙ্গের’ বিষয়টিতে সহমত পোষণ করেছে।
অউকাস চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ফ্রান্স ক্যানবেরা এবং ওয়াশিংটন থেকে তার রাষ্ট্রদূতদের দেশে ফেরত আসার নির্দেশ দিয়েছে, ফ্রাংকো-ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের শীর্ষ সম্মেলন পিছিয়ে দিয়েছে। এবং খুব সম্ভবত ইইউ বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যিক চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনাকেও পিছিয়ে দিতে বাধ্য করেছে, যেহেতু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতারা ট্রান্স-আটলান্টিক এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বন্ধুদেশগুলির বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তুলে ফ্রান্সের পক্ষ অবলম্বন করেছেন, ইউরোপিয়ান অ্যাফেয়ার্স-এর সংশ্লিষ্ট জার্মান মন্ত্রী মিখায়েল রথ অউকাসকে ইউরোপিয়ানদের জন্য এক সতর্কবার্তা বলে মনে করেছেন। কারণ ইইউকে প্রায়শই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে দ্বিধাবিভক্ত হতে দেখা গেছে। এ ছাড়াও, ফ্রান্স দ্বারা পরিচালিত ইইউ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তার এফ টি এ চুক্তি অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছিয়ে দিতে পারে। কারণ ইইউ-এর একাধিক সদস্য দেশই ফ্রান্সের সঙ্গে ‘বিশ্বাসভঙ্গের’ বিষয়টিতে সহমত পোষণ করেছে। ইইউ-এর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কোনও ক্ষোভ নেই, কিন্তু অসামরিক বিষয় যেমন বাণিজ্য ও অর্থনীতির উন্নতির মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করতে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজেদের যৌথ প্রত্যাশা পূরণে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠতে বিশ্বাসভঙ্গের সমস্যাটির সমাধান করা একান্তই প্রয়োজন।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারত এবং জাপানের মতো সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকা অনেক দিন ধরেই অঞ্চলটিতে উদ্ভূত সুরক্ষা সংক্রান্ত সমস্যাগুলির মোকাবিলায় তৎপর হয়েছে। সমমনস্ক দেশগুলির এই দলে ইংল্যান্ড নতুনতম সদস্য। সম্প্রতি তাদের এইচ এম এস কুইন এলিজাবেথ ক্যারিয়ারকে মার্কিন কর্মী এবং সরঞ্জাম-সহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে। গত মাসে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ যৌথ ভাবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও একাধিক বার কুচকাওয়াজ করেছে। এই মহড়ার মূল লক্ষ্য হল সমমনস্ক দেশগুলির মধ্যে আন্তঃপরিচালন ক্ষমতা তৈরি করা। ২০২১ সালে প্রতিরক্ষা এবং বিদেশনীতি পর্যালোচনায় নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল অবলম্বন করার পরবর্তী সময়ে অউকাস-এর চুক্তি ইংল্যান্ডের জন্য একটি মাইলফলক।
আফগান সংকটের পরবর্তী সময়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আমেরিকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্রাসেলসের তরফে ইউরোপিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি বা ইউরোপে কৌশলগত ক্ষেত্রে একাধিপত্য স্থাপনের ব্যাপারটি জোরালো হয়ে ওঠে। এবং বর্তমানে তাদের নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি অনুযায়ী ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ‘গ্লোবাল গেটওয়ে’ নামক উদ্যোগ শুরু করার মাধ্যমে চিনের বেল্ট অ্যান্ট রোড ইনিশিয়েটিভ বা বি আর আই-এর বিরুদ্ধে পালটা ব্যবস্থা নিয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্কের ভিতকে আরও মজবুত করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই অঞ্চলটিতে আগাম ভবিষ্যতে নিজেকে এক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক অংশীদার করে তুলতে চায়। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লেয়েন-এর মন্তব্য থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, এই চুক্তির ফলে শুধু প্যারিস নয়, ব্রাসেলসও ধাক্কা খেয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ইউরোপকে পিছনে সারিতে রাখার মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা মোটেও ভাল চোখে দেখছেন না। বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের অধীনে আমেরিকার আগ্রহ ইউরোপের তুলনায় অনেক বেশি এশিয়াকেন্দ্রিক। কারণ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সমমনস্ক গণতান্ত্রিক শক্তি এবং আঞ্চলিক বহুপাক্ষিক জোটগুলির অংশ হয়ে অঞ্চলটিতে নিজেদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করাই আমেরিকার লক্ষ্য।
অউকাস চুক্তি, বিশেষত এই নতুন ত্রিপাক্ষিক জোটের ফলে অস্ট্রেলিয়া একাধিক সুযোগ ও সুবিধে পেতে সমর্থ হলেও চুক্তির প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এশিয়া ও ইউরোপে তার বন্ধু দেশগুলির তরফে তৈরি হওয়া মনোমালিন্যের দিকটি অস্ট্রেলিয়াকে কূটনৈতিক ভাবে সামলাতে হবে। যেহেতু ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হল অঞ্চলটিতে সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে একত্রে কাজ করা, তাই এশিয়া ও ইউরোপ উভয় তরফেই দেশগুলির বাড়তে থাকা ক্ষোভকে হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক হবে না।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.