পাকিস্তান নৌবাহিনী আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে নৌবাহিনী দিবস সংক্রান্ত একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল দীনেশ ত্রিপাঠী পাকিস্তান নৌবাহিনীর আগামী দশকের মধ্যে ৫০টি জাহাজবিশিষ্ট বাহিনীতে পরিণত হওয়ার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এই মন্তব্যটি গণমাধ্যম জুড়ে নানা বিতর্ককে উস্কে দিয়েছে। কারণ ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের নৌ-আধুনিকীকরণ নিয়ে জল্পনা চলছে।
০৫৪এ/পি ধরনের ফ্রিগেট, বাবর শ্রেণির করভেট এবং হ্যাঙ্গর শ্রেণির ডুবোজাহাজ কেনার মাধ্যমে পাকিস্তান নৌবাহিনী এ বার কৌশলগত পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত বলে মনে করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও অ্যাডমিরাল ত্রিপাঠীর সঙ্কটবিধ্বস্ত পাকিস্তানে ‘কল্যাণের চাইতেও অস্ত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া’র নেপথ্যে আসল প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কৌশলগত যুক্তির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ, যা পাকিস্তান নৌবাহিনীর উচ্চ পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করেই গৃহীত হয়েছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামগুলি ভাল ভাবে নথিভুক্ত করা হলেও যে বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রায় হয়নি তা হল, দেশটির নৌ-আধুনিকীকরণের নেপথ্যে থাকা গভীর প্রেরণা। এই আখ্যানটি ঐতিহাসিক উদ্বেগ, ক্রমাগত দুর্বলতা এবং দেশটির সামুদ্রিক প্রতিবেশে ভারতের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য দ্বারা আকার পেয়েছে। অনেকের মতে, ১৯৭১ সালে অপারেশন ট্রাইডেন্টের ধাক্কা — যখন ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রবিশিষ্ট নৌকাগুলি করাচির বন্দরে বিধ্বংসী আঘাত হেনেছিল — পাকিস্তানের সামুদ্রিক চেতনাকে এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামগুলি ভাল ভাবে নথিভুক্ত করা হলেও যে বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রায় হয়নি তা হল, দেশটির নৌ-আধুনিকীকরণের নেপথ্যে থাকা গভীর প্রেরণা।
নিশ্চিত ভাবে এ কথা বলা যায় যে, সময় পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রতি নির্দয় থেকেছে এবং দেশটির নৌবাহিনীর দুর্বলতা কয়েক দশক ধরে বারবার পরীক্ষার মুখে পড়েছে। বিশ্লেষকদের ভাষায়, ১৯৯৯ সালে অপারেশন তলওয়ার এবং ২০০১ সালে অপারেশন পরাক্রমের সময় ভারতীয় নৌবাহিনী আরব সাগরে কিছু ‘আলগা বাধা’ সৃষ্টি করেছিল। সম্প্রতি ২০১৯ সালে পুলওয়ামা সন্ত্রাসবাদী হামলার পর পাকিস্তানের জলসীমার কাছে ভারতের ৬০টিরও বেশি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করার বিষয়টি ইসলামাবাদের কাছে ভারতীয় সংকল্পের একটি স্পষ্ট বার্তা প্রেরণ করেছে।
পাকিস্তানের নেতৃত্বের জন্য এই পর্বগুলি ভারতের সামুদ্রিক আধিপত্যকে ভারসাম্যহীন করতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর ক্রমাগত অক্ষমতাকেই দর্শিয়েছিল এবং পাকিস্তানও বিশ্বাসযোগ্য নৌ প্রতিবন্ধকতা তৈরির প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করেছিল।
পাকিস্তান নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণের অনুঘটক
এ কথা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, ভারতের ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রক্ষেপণ পাকিস্তানকে তার সামুদ্রিক কৌশল পুনর্নির্মাণ করতে বাধ্য করেছে। এক সময় প্রতিরক্ষামূলক ভঙ্গিতে সন্তুষ্ট থাকা পাকিস্তান নৌবাহিনী এখন এমন মঞ্চগুলিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যা অপ্রতিসমতাকে হ্রাস করতে পারে এবং সামুদ্রিক পরিসরে ভারতের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
এই কৌশলগত পরিবর্তন পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অধিগ্রহণেই প্রতিফলিত হয়, যা সমুদ্রের তলদেশে এবং পৃষ্ঠে যুদ্ধপ্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিকেই দর্শায়। পাকিস্তানের এয়ার-ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রপালশন (এআইপি) ব্যবস্থায় সজ্জিত - যা ক্ষেপণাস্ত্র দৃঢ়তা ও ক্ষিপ্রতা বৃদ্ধি করে - প্রথম হ্যাঙ্গর শ্রেণির ডুবোজাহাজের উৎক্ষেপণ ভারতীয় নৌবাহিনীর সামনে এক উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ।
একই ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হল দেশীয় ভাবে তৈরি জাহাজচালিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (এসএলবিএম) সফল পরীক্ষা, যা সমুদ্রে একটি শক্তিশালী সেকেন্ড-স্ট্রাইক পারমাণবিক প্রতিরোধ স্থাপনে পাকিস্তানের স্পষ্ট অভিপ্রায়কেই দর্শায়। পাকিস্তান নৌবাহিনী চিন থেকে চারটি ০৫৪এ/পি ধরনের ফ্রিগেট এবং তুর্কিয়ে থেকে একটি এমআইএলজিইএস শ্রেণির করভেট (পিএনএস বাবর) ক্রয় করেছে। উন্নত রাডার ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট, বহুমুখী অ্যান্টি-এয়ার ও অ্যান্টি-সারফেস অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত এই যুদ্ধজাহাজগুলি ভূপৃষ্ঠের বহরের যুদ্ধের ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি করেছে, ক্ষমতা প্রদর্শনে ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জলরাশিতে কার্যকর ভাবে কাজ করার ক্ষমতা বাড়িয়েছে।
ইতিমধ্যে সামুদ্রিক মানবহীন ব্যবস্থায় অগ্রগতি পাকিস্তান নৌবাহিনীর নজরদারি ও ভারতের কাছ থেকে অনুভূত হুমকির বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
উন্নত রাডার ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট, বহুমুখী অ্যান্টি-এয়ার ও অ্যান্টি-সারফেস অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত এই যুদ্ধজাহাজগুলি ভূপৃষ্ঠের বহরের যুদ্ধের ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি করেছে, ক্ষমতা প্রদর্শনে ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জলরাশিতে কার্যকর ভাবে কাজ করার ক্ষমতা বাড়িয়েছে।
ফলস্বরূপ, পাকিস্তানের নৌ নেতৃত্ব পাকিস্তান নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণকে একটি কৌশলগত প্রয়োজন বলে মনে করেছে। একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাত্কারে পাকিস্তানের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ ভারত মহাসাগর অঞ্চলে (আইওআর) ভারতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন এবং নয়াদিল্লিকে ‘তার প্রতিবেশীদের উস্কানি দিয়ে আঞ্চলিক শান্তি বিঘ্নিত করা’র দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।
তিনি ভারতের পারমাণবিক ত্রয়ীর উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলেও সেই বিষয়ে পাকিস্তানের কৌশলগত আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ইসলামাবাদের ২০২২ সালের জাতীয় নিরাপত্তা নীতি নয়াদিল্লির অগ্রসরমান পারমাণবিক ক্ষমতাকেই তুলে ধরে। সেখানে বলা হয়েছে ‘ভারতের পারমাণবিক ত্রয়ীর সম্প্রসারণ, পারমাণবিক নীতির উপর উন্মুক্ত বিবৃতি, অস্থিতিশীল প্রযুক্তির বিনিয়োগ ও প্রবর্তন এই অঞ্চলে কৌশলগত ভারসাম্যকে ব্যাহত করেছে।’
পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অভিজাতদের মধ্যে উদ্বেগ পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর) এজেন্সি দ্বারা প্রসারিত হয়েছে, যেটি ভারত সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচারের জন্য খ্যাত। মার্চ মাসে সি স্পার্ক মহড়ার সময় আইএসপিআর দাবি করেছিল যে, ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ ও ডুবোজাহাজগুলি গোপনে পাকিস্তানের নৌ চলাচলের উপর পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। এটি এমন একটি অভিযোগ, যা ভারতীয় হুমকি সংক্রান্ত ইসলামাবাদের চিরাচরিত আখ্যানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এই ধরনের আখ্যানগুলি একটি দ্বৈত উদ্দেশ্যই পরিবেশন করে: সেগুলি একটি সামুদ্রিক আধিপত্য হিসাবে ভারতের ধারণাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে পাকিস্তানের নৌবাহিনীকে ন্যায্যতা দেয়।
চিনের ভূমিকা
ভারতের সামুদ্রিক আধিপত্যকে নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তান ক্রমশ চিনের দিকে ঝুঁকছে, যেটি পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রধান স্থপতি ও প্রাথমিক পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছে। গত এক দশকে বেজিং উন্নত মঞ্চ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি সরবরাহ করে পাকিস্তান নৌবাহিনীর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল, আটটি হ্যাঙ্গর শ্রেণির ডুবোজাহাজ ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তির অধীনে পাকিস্তান ক্রয় করেছে। পাকিস্তান দীর্ঘ বিলম্বিত প্রজেক্ট ৭৫-এর (ভারত) অধীনে ভারতের ছ’টি প্রচলিত ডুবোজাহাজের মতো প্রায় একই দামে আটটি ডুবোজাহাজ অধিগ্রহণ করছে, যা চিনের সুলভ মূল্যের হার্ডওয়্যারের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
চিন পাকিস্তানকে ০৫৪এ/পি ফ্রিগেট সরবরাহ করেছে, যার নানাবিধ ভূমিকা পালন করার দক্ষতা পাকিস্তান নৌবাহিনীকে আরব সাগরে আরও ভিন্ন ধরনের অভিযানমূলক নমনীয়তা প্রদান করে। পিপলস লিবারেশন আর্মি নেভি (পিএলএএন বা প্ল্যান) এবং পাকিস্তান নৌবাহিনী সি গার্ডিয়ানস-এর মতো দ্বিপাক্ষিক মহড়ার মাধ্যমে কার্যকরী সমন্বয়কে আরও গভীর করার চেষ্টা করেছে এবমগ আইওআর-এ ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় একটি যৌথ আগ্রহ প্রদর্শন করেছে।
এখানে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনে চিনের অনিচ্ছা একটি ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপকেই দর্শায় এবং তা হল তার বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করার সময় পাকিস্তানের অবস্থানকে শক্তিশালী করা ও ভারতের সঙ্গে সরাসরি সামুদ্রিক সংঘর্ষ এড়ানো।
আশ্চর্যের বিষয় হল, কৌশলগত অবস্থান ও দ্বৈত ব্যবহারক্ষম অভিযানের সুস্পষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও চিন ও পাকিস্তান গোয়াদরের সামরিকীকরণ থেকে বিরত থেকেছে। গোয়াদর চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) একটি মূল কেন্দ্র এবং সুপ্ত সামরিক মূল্য ধারণ করে। বেজিং সেখানে তার কার্যক্রমকে ব্যাপক ভাবে বাণিজ্যিক করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এখানে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনে চিনের অনিচ্ছা একটি ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপকেই দর্শায় এবং তা হল তার বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করার সময় পাকিস্তানের অবস্থানকে শক্তিশালী করা ও ভারতের সঙ্গে সরাসরি সামুদ্রিক সংঘর্ষ এড়ানো।
তা সত্ত্বেও, গোয়াদরের বিষয়ে সতর্কতা এই বাস্তবতাকে বদলে দেয় না যে, পাকিস্তান নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ ভারতের জন্য একটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। উন্নত ডুবোজাহাজ, আধুনিক ফ্রিগেট ও মনুষ্যবিহীন ব্যবস্থা পাকিস্তান নৌবাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে এবং ভারতীয় নৌবাহিনীকে গতি বজায় রাখার জন্য নিজের সংস্থান প্রসারিত করতে হবে। সর্বোপরি, আরব সাগরে পাকিস্তান-চিন সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা ভারতের সামুদ্রিক সমীকরণকে জটিল করে তুলছে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে না পারলেও পাকিস্তান নৌবাহিনীর অপ্রতিসম ক্ষমতা ও পিএলএনএ-র ক্রমবর্ধমান সমন্বয় – যার মধ্যে ডুবোজাহাজ ক্রয় ও সমুদ্রভিত্তিক প্রতিরোধ অন্তর্ভুক্ত - নয়াদিল্লির সামনে একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য, এর অর্থ হল শক্তি প্রয়োগের অবলম্বন না করেই আরও দৃঢ় ভাবে পিএন-পিএলএনএ-র মোকাবিলা করার জন্য তার অবস্থানের পুনর্বিবেচনা করার সময় সুর্নিদিষ্ট প্রতিরোধী মনোভাব বজায় রাখা।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য প্রিন্ট-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.