এই নিবন্ধটি ‘দ্য চায়না ক্রনিকলস’ সিরিজের ১৫১তম রচনা।
চিনের বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচি ১৯৫০-এর দশকে শুরু হলেও দেশটি ১৯৯৯ পর্যন্ত ত্রাণ গ্রহীতাই হয়ে থেকেছে। ২০০০-এর দশকে চিনের আন্তর্জাতিক অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। কারণ দেশটির উন্নয়নমূলক সহযোগিতা কর্মসূচি দ্রুত প্রসারিত হয় এবং এর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলি ‘গো আউট’ নীতির অধীনে নিজেদের বিশ্বব্যাপী উপস্থিতি বৃদ্ধি করে। অল্প সময়ের মধ্যেই চিন বেশির ভাগ দক্ষিণের দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকান অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন-সহযোগী হয়ে উঠেছে। পশ্চিমী শর্তে হতাশ এমন বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য চিনা উন্নয়নমূলক সহযোগিতা কর্মসূচিই অর্থের একটি বিকল্প এবং সহজ উৎস প্রদান করেছে। চিন শুধু মাত্র আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক পরিসরের আধিপত্যকেই চ্যালেঞ্জ করেনি, বরং দেশটি দ্রুত উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য প্রধান আন্তর্জাতিক অর্থদাতা এবং অবকাঠামো প্রদানকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
পশ্চিমী শর্তে হতাশ এমন বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য চিনা উন্নয়নমূলক সহযোগিতা কর্মসূচিই অর্থের একটি বিকল্প এবং সহজ উৎস প্রদান করেছে।
যাই হোক, চিনের উন্নয়নমূলক সহযোগিতা কর্মসূচি সব সময়ই বিতর্কিত থেকেছে। এটি বিশেষত পশ্চিমী বিশ্ব থেকে তীব্র সমালোচনা পেয়েছে এবং প্রায়শই নব্য-ঔপনিবেশিকতা, দুর্বৃত্ত দাতা এবং ঘৃণ্য ফাঁদমূলক ঋণ কূটনীতির নীতিতে জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। এর বেশ কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্পও দুর্নীতির কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে এবং প্রাপক দেশগুলিতে পরিবেশগত ও শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছে। কিছু সমালোচনাকে অত্যধিক বা অনুপ্রাণিত হিসাবে বিবেচনা করা হলেও চিনের পদ্ধতির মধ্যেও কিছু গুরুতর সমস্যা ছিল, যা চিন নিজেই আর উপেক্ষা করতে পারে না। বাতাইনে, বেনন অ্যান্ড ফুকুয়োমা (২০১৯), রাসেল অ্যান্ড বার্জার (২০১৯), জিথাইগা, বুরিমাসো, বিং অ্যান্ড আহমেদ-এর (২০১৯) মতো বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, অবকাঠামোর জন্য চিনা সফট লোন প্রায়শই যথোপযুক্ত পরিশ্রম, সম্ভাব্য অধ্যয়ন ছাড়াই এলোমেলো ভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিক লাভের একটি অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে। যে সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি সমালোচনার উদ্রেক করেছে, তা হল দুর্নীতি, পিছু হঠা এবং চিনা প্রকল্পের অস্বচ্ছতা। তানজানিয়া এবং বাংলাদেশের মতো বেশ কয়েকটি প্রাপক দেশও চিনের ঋণের অস্বচ্ছতার সমালোচনা করেছে। চিনের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনেও ঋণ-অর্থায়নকৃত উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে ত্রুটি পাওয়া গিয়েছে। কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, চিনের সেন্ট্রাল ডিসিপ্লিন ইন্সপেকশন কমিশন বিদেশি প্রকল্পে দুর্নীতির উদাহরণ খুঁজে পেয়েছে। চিন স্বীকার করে নিয়েছে যে, তার উন্নয়নমূলক সহযোগিতা কর্মসূচি অনেক বড় ও জটিল হয়ে উঠেছে এবং এর জন্য আরও বেশি ও সুদক্ষ পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন। দেশটি গত কয়েক বছরে তার উন্নয়নমূলক সহযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোয় ধারাবাহিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি অগ্রগতি হল ২০১৮ সালে চায়না ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সি (সিআইডিসিএ) প্রতিষ্ঠা করা এবং ২০২১ সালে চিনা আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংক্রান্ত তৃতীয় শ্বেতপত্র প্রকাশ। সিআইডিসিএ যে সময় স্থাপিত হয়, তখন ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো কিছু ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) দেশ ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি) এবং অস্ট্রেলিয়ান এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর (অস-এইড) মতো বিশেষ সাহায্যমূলক সংস্থাগুলিকে বাতিল করে দিয়েছিল। সিআইডিসিএ চিনা আন্তর্জাতিক ত্রাণের গুরুত্বকে উন্নীত করা, তার উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচিকে নিজের বিদেশনীতির লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ করে তোলা এবং চিনা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে উন্নত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
চিন স্বীকার করে নিয়েছে যে, তার উন্নয়নমূলক সহযোগিতা কর্মসূচি অনেক বড় ও জটিল হয়ে উঠেছে এবং এর জন্য আরও বেশি ও সুদক্ষ পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন।
সিআইডিসিএ প্রতিষ্ঠার আগে চিনের সাহায্যমূলক প্রশাসনিক পরিকাঠামোয় প্রভাবশালী ভূমিকা পালনকারী তিনটি মন্ত্রক ছিল বাণিজ্য মন্ত্রক, বিদেশ মন্ত্রক এবং অর্থ মন্ত্রক। উন্নয়নমূলক প্রকল্পের অর্থনৈতিক খাতের উপর ভিত্তি করে ২০টিরও বেশি লাইন মন্ত্রক (সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক) সম্পৃক্ত ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে খুব কমই তথ্য আদান-প্রদান করা হত এবং আমলাতান্ত্রিক দ্বন্দ্ব প্রায়শই প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতাকে নির্দেশ করে। সিআইডিসিএ চিনা উন্নয়নমূলক সহযোগিতার প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রককে প্রতিস্থাপন করে এবং বর্তমান আলোচনায় চিনা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি তার নামে নানা চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাণিজ্য মন্ত্রকের বিপরীতে সিআইডিসিএ-কে বিদেশি ত্রাণের বিষয়ে চিনা নেতাদের পরামর্শ দেওয়ার এবং দেশের কৌশলগুলিকে প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সিআইডিসিএ অনেক আড়ম্বর করে প্রতিষ্ঠিত করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্য মন্ত্রককে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। উপ-মন্ত্রক হিসাবে সিআইডিসিএ-এর মর্যাদা বাণিজ্য ও বিদেশ বিষয়ক শক্তিশালী মন্ত্রকগুলির উপর তার প্রভাবকে মারাত্মক ভাবে খর্ব করে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের সংখ্যাও সীমিত। চিনের উন্নয়নমূলক সহযোগিতা পদ্ধতির আর একটি বড় সমস্যা হল এই যে, তা সম্পূর্ণ রূপে চিনা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির দ্বারা পরিচালিত হয়। সেখানে অন্য কোনও সংস্থার সংস্পর্শ নেই, যা প্রায়শই প্রাপক দেশগুলিতে স্থানীয় জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। চিনা এনজিওগুলি মনে করেছিল যে, সিআইডিসিএ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে চিনা নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলি দেশের উন্নয়নমূলক অংশীদারিত্বে আরও বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যাই হোক, গবেষক ডেঙ্গুয়া ঝাং এবং হংবো জি দেখিয়েছেন যে, তেমনটা বাস্তবে ঘটেনি। একই ভাবে, সিআইডিসিএ-এর সীমিত কর্মী শক্তি উন্নয়নমূলক সহায়তা, উন্নয়নমূলক কার্যকারিতা ও বাস্তবায়নের উপর অপ্রতুল গবেষণা উপদেষ্টা হিসাবে এটির ভূমিকাকে ব্যাহত করেছে।
দেশটি তার আন্তর্জাতিক সহায়তামূলক কর্মসূচির প্রশাসনিক পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য কিছু প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং উন্নয়নমূলক কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা উন্নত করার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
২০২১ সালে চিন বিদেশি সহায়তার বিষয়ে তার তৃতীয় শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। শ্বেতপত্রে সাহায্যের কার্যকারিতা এবং স্বচ্ছতার পাশাপাশি স্পষ্ট ভাবে সংজ্ঞায়িত প্রকল্প ব্যবস্থাপনা নিয়ম ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়ার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু, দুর্নীতি দূর করতে এটি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলির মূল্যায়ন ও নিয়মিত নিরপেক্ষ প্রকল্প মূল্যায়নের সুপারিশ করেছে। যাই হোক, শ্বেতপত্রের মূল বিষয়টি ছিল বিদেশি সহায়তার উপর নজরদারি চালাতে এবং তদারকি বাড়ানোর জন্য একটি আধুনিক পরিসংখ্যান ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। বছরের পর বছর ধরে চিনা রাষ্ট্র ত্রাণের ধরন বা উদ্দেশ্য অনুসারে কী ভাবে তার আন্তর্জাতিক ত্রাণ পৃথক পৃথক দেশগুলিতে বিতরণ করা হবে, সে বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেনি। নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব তুলনামূলক আলোচনাকে ব্যাহত করেছে এবং প্রায়শই সন্দেহের উদ্রেক করেছে। একটি দায়িত্বশীল শক্তি হিসেবে চিনকে অবশ্যই তার বিদেশ সহায়তা কর্মসূচির প্রশাসনিক কার্যকলাপের উন্নতি ঘটাতে হবে, তার প্রকল্পের গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে এবং অন্যান্য দেশে তার উন্নয়নমূলক কর্মসূচির বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার জবাব দিতে হবে। দেশটি তার আন্তর্জাতিক সহায়তামূলক কর্মসূচির প্রশাসনিক পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য কিছু প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং উন্নয়নমূলক কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা উন্নত করার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ২০১৫ সাল থেকে চিনা বৈদেশিক ত্রাণ ব্যয়ে স্থির বৃদ্ধি ঘটেনি। চিনা সংস্থাগুলি এখন আরও ভাল প্রকল্পের সম্ভাব্য অধ্যয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং যে সকল প্রকল্পের আয়ের প্রবাহ থেকে ঋণ পরিশোধ করা হয়, সেগুলিকে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেনি। সিআইডিসিএ একটি উন্নয়নমূলক সংস্থা হিসাবে অনেক কম ক্ষমতাসম্পন্ন একটি উপমন্ত্রক এবং তার কর্মী সংখ্যাও নগণ্য। চিনা নেতাদের পরামর্শ দেওয়ার এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য চিনের কৌশলগুলি প্রস্তুত করার জন্য সংস্থাটির গবেষণামূলক ক্ষমতারও অভাব রয়েছে। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চিনা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগগুলিকেও তাদের কার্যক্রমকে ব্যাপক পরিমাণে উন্নত করতে হবে। আন্তর্জাতিক ত্রাণের বিষয়ে চিনের শ্বেতপত্রে করা একাধিক প্রতিশ্রুতিও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। সংক্ষেপে বললে, দেশটিকে নিজের কথা মতোই কাজ করতে হবে।
মালঞ্চ চক্রবর্তী একজন সিনিয়র ফেলো এবং অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (রিসার্চ) ডেপুটি ডিরেক্টর।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.