Image Source: Samvada World
১৯৫০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন যখন তিব্বত দখল করে, তখন তিব্বত বিশ্বব্যাপী মনোযোগের কেন্দ্রে উঠে আসে। যাই হোক, বিগত দুই দশকে তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম মূলত আন্তর্জাতিক স্মৃতি থেকে ম্লান হয়ে এসেছে এবং একুশ শতকের স্বাধীনতা আন্দোলনগুলির একটি পাদটীকায় পরিণত হয়েছে।
১৯৫০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন যখন তিব্বত দখল করে, তখন তিব্বত বিশ্বব্যাপী মনোযোগের কেন্দ্রে উঠে আসে।
নেপাল এবং ভারত ছাড়াও - যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ তিব্বতি উদ্বাস্তুদের আবাসস্থল - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিসরে তিব্বতি আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অতি সম্প্রতি ২০২৪ সালের ১২ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘তিব্বত-চিন বিরোধ আইনে একটি সমাধানের প্রচার’ বা ‘প্রোমোটিং আ রেজোলিউশন টু দ্য টিবেট-চায়না ডিসপিউট অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন, যা রিজলভ টিবেট অ্যাক্ট নামেও পরিচিত।
পটভূমি
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে চিন কর্তৃক তিব্বত আক্রমণের পর থেকে তিব্বত অঞ্চলটি চিনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ১৯৫১ সালে স্বাক্ষরিত সতেরো-দফা চুক্তির মাধ্যমে তিব্বত ও চিনা সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছিল। তবে চুক্তির একাধিক ধারার উল্লেখযোগ্য লঙ্ঘনের পাশাপাশি বলপূর্বক সংস্কারের কারণে তিব্বতি সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর দরুন তিব্বত সরকার ১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে চুক্তিটি আইনত প্রত্যাখ্যান করে। একই সময়ে, তিব্বতের জনগণ একটি স্বল্পস্থায়ী সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা করে, যার ফলস্বরূপ ১৪তম এবং বর্তমান দলাই লামা লাসা থেকে পালিয়ে এসে ভারতের ধর্মশালায় আশ্রয় নেন।
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে চিন কর্তৃক তিব্বত আক্রমণের পর থেকে তিব্বত অঞ্চলটি চিনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বর্তমানে তিব্বত চিনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসাবে টিবেট অটোনোমাস রিজিয়ন বা তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (টিএআর) এবং সিচুয়ান, কিংহাই, গানসু এবং ইউনানের মতো কাউন্টির নিকটবর্তী প্রদেশ-সহ ১২টি তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত প্রিফেকচার বা দেশের মাধ্যমে শাসিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তিব্বত
ঐতিহাসিক ভাবে তিব্বতের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি চিনের সঙ্গে সম্পর্ক এবং তার ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে ব্যাপক ভাবে বদলেছে। ১৯৫০ এবং ৬০-এর সময়কালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতি গেরিলা বাহিনীকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। তবে সাত ও আটের দশকে একটি প্রত্যক্ষ বদল লক্ষ করা যায়, যখন চিনের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য নির্বাসিত তিব্বত সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদানপ্রদান প্রায় ছিন্ন হয়ে যায়। যাই হোক, ২০০০ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় তিব্বতের উপর মনোযোগ দিতে শুরু করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ২০০২ সালের টিবেট পলিসি অ্যাক্ট (টিপিএর)। এটি এমন একটি প্রধান আইন, যা এখনও তিব্বতের প্রতি মার্কিন নীতিকে পথ দেখায় এবং এটিতে বলা হয়েছে যে, ‘এই আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এবং তিব্বতের অভ্যন্তরে তিব্বতিদের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতাকে সমর্থন করে।’ আইনটি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে তিব্বত প্রসঙ্গের জন্য বিশেষ সমন্বয়কারীর পদ প্রতিষ্ঠা, লাসায় একটি মার্কিন শাখা অফিস প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কথা বলা এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে চিন ও দলাই লামার মাঝে আলোচনাকে উত্সাহিত করার বিষয়ে জোর দিয়েছিল।
২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রেসিপ্রোকাল অ্যাকসেস টু টিবেট অ্যাক্ট ২০১৮ প্রণয়ন করে, যা ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেটকে চিনের তিব্বত অঞ্চলে মার্কিন পর্যটক, সাংবাদিক এবং কূটনীতিকদের প্রবেশাধিকারের মাত্রা সম্পর্কে কংগ্রেসে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেয়।
২০২০ সালের টিবেটান পলিসি অ্যান্ড সাপোর্ট অ্যাক্ট (টিএসপিএ) অনুযায়ী বলা হয় যে, চিন সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই দলাই লামা-সহ তিব্বতীয় বৌদ্ধ নেতাদের উত্তরাধিকারের প্রশ্নটির ব্যাপারে তিব্বতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
২০২০ সালের টিবেটান পলিসি অ্যান্ড সাপোর্ট অ্যাক্ট (টিএসপিএ) অনুযায়ী বলা হয় যে, চিন সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই দলাই লামা-সহ তিব্বতীয় বৌদ্ধ নেতাদের উত্তরাধিকারের প্রশ্নটির ব্যাপারে তিব্বতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। টিএসপিএ চিনা কর্মকর্তাদের উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যাঁরা এ ধরনের হস্তক্ষেপের সঙ্গে জড়িত।
রিজলভ টিবেট অ্যাক্ট
মার্কিন সেনেটর জেফ মার্কলে এবং টড ইয়ং একটি দ্বিদলীয় বিল হিসাবে ‘প্রোমোটিং আ রেজোলিউশন টু দ্য টিবেট-চায়না ডিসপিউট অ্যাক্ট’ নিয়ে আসেন। আইনটি দলাই লামা ও পিপলস রিপাবলিক অফ চায়নার (পিআরসি) মধ্যে একটি নিষ্পত্তির জন্য এবং তিব্বতের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক সমর্থনকে আরও উন্নত করার উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত আলোচনার প্রচার চালায়।
মূল আইনে কী বলা হয়েছে:
১) তিব্বতের সংজ্ঞা: আইনটিতে তিব্বতকে চিনের একটি অংশ হিসাবে দেখার ওয়াশিংটনের নীতিতে কোনও পরিবর্তন না ঘটালেও এটিতে তিব্বতের একটি সংবিধিবদ্ধ সংজ্ঞা দেওয়া হয়, যা কেবল টিবেট অটোনোমাস রিজিয়নকেই (টিএআর) নয়, কিংহাই, সিচুয়ান, গানসু এবং ইউনানের মতো চিনা অ্ধিকারভুক্ত তিব্বতি অঞ্চলগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। চিন সরকারের তিব্বত সংক্রান্ত চিরাচরিত উল্লেখের বিপরীতে - যা কিনা টিএআর-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ - এই বৃহত্তর সংজ্ঞাটি ঐতিহ্যগত ভাবে তিব্বত হিসাবে স্বীকৃত অঞ্চলগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
২) স্ব-নিয়ন্ত্রণ: আইনের ধারা ২-এ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্থাপিত তিব্বতি জনগণের ‘রাইট অব সেলফ ডিটারমিনেশন’ বা ‘আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার’-এর কথা বলা হয়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনের একটি মূল নীতি, যা আসলে উল্লেখ করে যে, প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। উল্লিখিত অধিকার দ্বারা মানুষ স্বাধীন ভাবে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করতে পারে এবং স্বাধীন ভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের চেষ্টা করতে পারে। এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের ওয়াল কেসের (২০০৪) কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, ‘জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের নীতিটি রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং সাধারণ পরিষদের রেজোলিউশন ২৬২৫-এ (২৫) পুনরায় ব্যক্ত করা হয়েছে। এর অধীনে ‘প্রত্যেক রাষ্ট্রের কর্তব্য হল যে কোনও বলপূর্বক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, যা (সেই রেজোলিউশনে) উল্লিখিত জনগণকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।’ আইনটি তিব্বতকে আন্তর্জাতিক আইনের মনোযোগ এবং পরিধিতে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি অনুঘটক হিসাবেও কাজ করতে পারে।
৩) চিনা গুজবের মোকাবিলা করা: দলাই লামা-সহ তিব্বতের ইতিহাস, সংস্কৃতি, মানুষ ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে চিনা গুজবের মোকাবিলা করার জন্য ইউএস স্পেশ্যাল কো-অর্ডিনেটরের অফিসের দায়িত্ব প্রসারিত করে আইনটিতে টিপিএ-র সংশোধন করা হয়েছে। এই ঘটনা ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন চিন সরকার এই আন্তর্জাতিক আখ্যানকেই জোরদার করতে চাইছে যে, তিব্বত ‘সর্বদাই’ চিনের একটি অংশ ছিল। এমনটা করার নেপথ্যে একটি প্রধান কারণ হল, এমন এক আখ্যান তুলে ধরা, যা চিনকে তিব্বতে থাকার অধিকার দেয় এবং ১৯৫০ সালে দখল নেওয়ার পর থেকে চিনের কার্যকলাপকে বৈধতা দেয়। এ ভাবে চিন তিব্বতি জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিক কাঠামোর আওতায় স্বাধীনতার যে কোনও প্রশ্নকে বেআইনি বলে প্রমাণিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রভাব
২০২৪ সালের জুন মাসে ধর্মশালায় দলাই লামার সঙ্গে একটি উচ্চ-পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠকের পরে প্রণীত রিজলভ টিবেট অ্যাক্ট তিব্বত প্রসঙ্গে আমেরিকার সম্পৃক্ততার আর এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে এবং সম্ভবত এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক মনোযোগ পুনরুজ্জীবিত করে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের উপর জোর দিয়ে এবং চিনের আখ্যানকে চ্যালেঞ্জ করে আইনটি আন্তর্জাতিক আইনে তিব্বতের মর্যাদা সম্পর্কে কৌতূহলী প্রশ্ন উত্থাপন করে। এই আইনটি আন্তর্জাতিক আইনি মঞ্চের সামনে তিব্বতের প্রসঙ্গ তুলে আনার বিষয়ে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং আলোচনার নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। তবে, চিনের দৃঢ় অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবের কারণে বাস্তবিক প্রভাব এখনও অনিশ্চিতই রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে তিব্বতের জন্য দরজা খোলার ক্ষেত্রে এই আইনের কার্যকারিতা নির্ভর করবে কূটনৈতিক কৌশল, অন্যান্য দেশের সমর্থন এবং মার্কিন-চিন সম্পর্কের জটিল সমীকরণের উপর। যেহেতু তিব্বত যে কোনও ভূ-রাজনৈতিক বিরোধের মতোই দেশগুলির ভূ-রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের পরিবর্তনের মধ্যে আটকে রয়েছে, তাই ১৯৫০ সাল থেকে তিব্বতীয় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর উপর বিদ্যমান নির্যাতনের কথাও মনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উদয়বীর আহুজা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.