এই প্রবন্ধটি ‘অগ্নিপথ প্রকল্প: র্যাডিকাল না অযৌক্তিক’ সিরিজের অংশ
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ১৪ জুন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য একটি নতুন নিয়োগ প্রকল্প অনুমোদন করেছে যার নাম অগ্নিপথ প্রকল্প। এই প্রকল্পকে বলা যেতে পারে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ প্রতিরক্ষা লোকশক্তি সংস্কার৷ অবিলম্বে কার্যকর এই প্রকল্পটি ১৭.৫ থেকে ২১ বছর বয়সী সৈনিক, নাবিক ও এয়ারম্যানদের চার বছরের জন্য নিয়োগের মাধ্যমে এখন থেকে বাহিনীর সমস্ত নিয়োগ নির্দেশিত করবে। নতুন প্রকল্পের অধীনে সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদানকারী যুবকরা অগ্নিবীর হিসেবে পরিচিত হবে, এবং তাদের তালিকাভুক্তি হবে ‘সর্বভারতীয়’ ও ’সর্বশ্রেণি’ভিত্তিক। নতুন প্রকল্পটি আমূল বদলে দিয়েছে আগের নিয়োগ নীতিকে, যেখানে নিযুক্তদের পেনশন সহ অবসর নেওয়ার আগে কমপক্ষে ১৭ বছর কাজ করতে হত। প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে সমসাময়িক প্রযুক্তিগত প্রবণতাগুলির সঙ্গে পরিচিত তরুণ প্রতিভাকে আকৃষ্ট করা এবং সশস্ত্র বাহিনীর বয়স প্রোফাইল উন্নত করার মাধ্যমে ‘প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ সশস্ত্র বাহিনীর দিকে একটি রূপান্তরমূলক’ পরিবর্তন আনতে’।
অগ্নিপথ এবং এর যুক্তি
অগ্নিপথ প্রকল্প, যার আওতায় শুধু এই বছরেই ৪৬,০০০ অগ্নিবীর নিয়োগ করা হবে, তা সশস্ত্র বাহিনীর নন–অফিসার কাডারদের জন্য প্রযোজ্য। প্রতিভাবান যুবকদের আকৃষ্ট করতে এই প্রকল্পটি বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় আর্থিক প্যাকেজের পাশাপাশি স্থায়ী মেয়াদের সুযোগও দেয়, যা অগ্নিবীরদের প্রতি বার্ষিক ব্যাচের সর্বাধিক ২৫ শতাংশের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। আর্থিক প্যাকেজগুলির মধ্যে রয়েছে প্রথম বছরে প্রতি মাসে মোট বেতন ৩০,০০০ ভারতীয় টাকা, যা বেড়ে চতুর্থ বছরে ৪০,০০০ ভারতীয় টাকা হবে। অগ্নিবীরদের ভারতীয় টাকায় প্রায় ১১.৭১ লক্ষের একটি অ–করযোগ্য সেবা নিধি বিচ্ছেদ প্যাকেজ প্রদান করা হবে, যে টাকার একটি অংশ অগ্নিবীরদের মাসিক বেতন থেকে আসবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারেরও সমতুল্য অবদান থাকবে। অগ্নিবীরদের জন্য উপলব্ধ এই সুবিধাটি হবে অন্য বেশ কয়েকটি ভাতা এবং মৃত্যু ও অক্ষমতার ক্ষতিপূরণের অতিরিক্ত।
নতুন প্রকল্পটি আমূল বদলে দিয়েছে আগের নিয়োগ নীতিকে, যেখানে নিযুক্তদের পেনশন সহ অবসর নেওয়ার আগে কমপক্ষে ১৭ বছর কাজ করতে হত।
দুটি প্রাথমিক উদ্দেশ্য মাথায় রেখে প্রকল্পটি ঘোষণা করা হয়েছে। এক, নিযুক্তির মেয়াদ মাত্র চার বছর করার মাধ্যমে নতুন নিয়োগ নীতিটির পরিকল্পনা করা হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর গড় বয়স বর্তমান ৩২ বছর থেকে কমিয়ে ২৪–২৬ বছর করার জন্য। এটি বেশ কয়েকটি উচ্চ–পর্যায়ের কমিটির সুপারিশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যা ভারতের বিভিন্ন নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় অনেক তরুণ কাডার নেওয়ার কথা বলেছিল। দুটি শত্রু প্রতিবেশীর সঙ্গে সক্রিয় সীমান্ত বিরোধে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যেখানে হাতাহাতি লড়াই হয়েছে, তখন বিশেষ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটি তরুণ বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা ছোট করে দেখার কোনও অবকাশ নেই।
দুই, যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে বলা হয়নি, অগ্নিপথ প্রকল্পটি মূলত লোকশক্তি ব্যয়ের অত্যধিক বৃদ্ধির কারণে উদ্ভূত জরুরি আর্থিক প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে তৈরি। ১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকে ‘কালার সার্ভিস’ (বা চাকরির ন্যূনতম সময়কাল) ধীরে ধীরে সাত বছর থেকে বাড়িয়ে ১৭ বছরে নিয়ে আসা, এবং ধারাবাহিক কেন্দ্রীয় বেতন কমিশনগুলির (সি পি সি) সুপারিশ ও ওয়ান র্যাঙ্ক ওয়ান পেনশন (ও আর ও পি) বাস্তবায়নের কারণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের লোকশক্তির খরচ বছরের পর বছর ধরে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধির মাত্রা এই ঘটনার দ্বারা বিচার করা যেতে পারে যে বিগত ১০ বছরে (২০১১–১২ থেকে ২০২১–২২) প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সামগ্রিক ব্যয়ের মধ্যে বেতন ও ভাতা (পি অ্যান্ড এ) এবং প্রতিরক্ষা পেনশনের অংশ ৫০ শতাংশের কম থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। এটি ক্রয় এবং সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের বাজেটের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, যার সম্মিলিত অংশ ৩৬ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে, এবং তার ফলে সরকার চলতি বরাতগুলির জন্যও টাকা দেওয়া কঠিন বলে মনে করেছে।
অগ্নিপথ প্রকল্পটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ক্রমশ বেড়ে চলা লোকশক্তি খরচের সমাধানে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। অগ্নিবীরদের সংক্ষিপ্ত মেয়াদ নিশ্চিত করবে যে কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ অগ্নিবীরের সর্বোচ্চ বেতন ৪০,০০০ ভারতীয় টাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে, যা সিনিয়র সৈনিকদের তুলনায় অনেক কম। আর্থিক সঞ্চয়ের সিংহভাগ অবশ্য পেনশনে জমা হবে। চার বছর পর অগ্নিবীরদের তিন–চতুর্থাংশকে বিদায় দেওয়ার কারণে সরকার অবসর–পরবর্তী পেনশনারি বেনিফিটগুলিতে প্রচুর পরিমাণে সাশ্রয় করবে। ফলে দেশের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিকে আরও কার্যকর ভাবে মোকাবিলা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ আধুনিকীকরণ ও পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্য টাকা হাতে থাকবে।
অগ্নিবীরদের সংক্ষিপ্ত মেয়াদ নিশ্চিত করবে যে কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ অগ্নিবীরের সর্বোচ্চ বেতন ৪০,০০০ ভারতীয় টাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে, যা সিনিয়র সৈনিকদের তুলনায় অনেক কম।
অগ্নিপথ কতটা র্যাডিকাল?
অগ্নিপথ প্রকল্পের সঙ্গে ‘ট্যুর অফ ডিউটি’–র ২০২০ সালের প্রথম দিকের প্রস্তাবের কিছু মিল আছে, যেখানে সৈনিক ও অফিসার উভয়কেই তিন বছরের জন্য নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু এর সঙ্গে অতীতের কোনও কমিটির সুপারিশের কোনও সমান্তরাল টানা যায় না। বেড়ে–চলা লোকশক্তির খরচ মোকাবিলার জন্য সরকারের গঠিত বিভিন্ন কমিটি বিভিন্ন পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছে, যার মধ্যে ছিল কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীতে (সি এ পি এফ) পার্শ্বীয় প্রবেশ এবং সশস্ত্র বাহিনীকে বাকি সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য জাতীয় পেনশন সিস্টেমে (এন পি এস) নিয়ে আসা। যাই হোক, অগ্নিপথ ঘোষণা করে সরকার নতুন নন–অফিসার কাডার নিয়োগের দিকে নজর দিতে সাহসী পথ গ্রহণ করেছে। অগ্নিপথ বা অন্য কোনও সংস্কারের পরিধি থেকে অফিসার কাডারকে বাদ দেওয়াটা অবশ্য একটু বিস্ময়কর। কারণ, অন্তত এটুকু বলা যেতেই পারে যে, সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার কাডারের (প্রায় ১০,৫০০ মেডিক্যাল, ডেন্টাল এবং নার্সিং অফিসার সহ যার সমন্বিত সংখ্যা প্রায় ৭৬,০০০ ) বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
অগ্নিপথের বিরোধিতা
অগ্নিপথ ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিক্ষোভ, হিংসা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রধান কারণ মনে হচ্ছে পূর্ববর্তী নিয়োগ নীতি দেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির উপর নেতিবাচক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও যে আকর্ষণীয় আজীবন পেনশন–সহ একটি স্থায়ী সরকারি চাকরির নিরাপত্তা দিয়েছিল, তা হারানোর অনুভূত ক্ষতি। উদ্বেগ দূর করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার বেশ কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে আছে এককালীন যোগদানের বয়স দুই বছর শিথিল করা এবং অগ্নিবীরদের জন্য চাকরির সংরক্ষণ (সারণি ১ দেখুন)। প্রাথমিক ভাবে দেখা যাচ্ছে এখনও পর্যন্ত ঘোষিত চাকরিতে সংরক্ষণের প্রস্তাবগুলি চার বছরের মেয়াদ শেষে বেরিয়ে আসা অগ্নিবীরদের নিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পশ্চাৎদৃষ্টির সুযোগ নিয়ে অবশ্য কেউ বলতেই পারেন যে সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরি করতে আগ্রহীদের নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে এই প্রণোদনাগুলি অগ্নিপথ ঘোষণার সময় একই সঙ্গে ঘোষণা করা যেতে পারত।
সারণি ১। চার বছর পর অগ্নিবীরদের জন্য চাকরি ও অন্যান্য প্রণোদনা
কেন্দ্র / রাজ্য সরকার |
প্রণোদনা |
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক |
সেন্ট্রাল আর্মড পুলিশ ফোর্সেস (সিএপিএফ) ও আসাম রাইফেলস (এআর)–এর শূন্যপদে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ সিএপিএফ এবং এআর-এ নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা তিন বছর (অগ্নিবীরদের প্রথম ব্যাচের জন্য ৫ বছর) শিথিল করা হবে |
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক |
ভারতীয় কোস্ট গার্ড, প্রতিরক্ষা অসামরিক পদ এবং ১৬টি প্রতিরক্ষা পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিংস–এর চাকরির শূন্যপদে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ |
বন্দর, জাহাজ ও জলপথ মন্ত্রক |
অগ্নিবীরদের মার্চেন্ট নেভির ছটি ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ |
শিক্ষা মন্ত্রক |
১০ ক্লাস পাশ অগ্নিবীরদের ১২ ক্লাস পাসের সার্টিফিকেট দিতে বিশেষ শিক্ষা কর্মসূচি |
অসম সরকার |
রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা অগ্নিবীরদের অসম পুলিসে নিয়ে নেওয়া হবে |
উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা ও মধ্যপ্রদেশ সরকার |
রাজ্য পুলিশে নিয়োগে অগ্রাধিকার |
সূত্র: প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো, ও সংবাদমাধ্যমের খবর
উপসংহার
অগ্নিপথ প্রকল্প নিঃসন্দেহে মোদী সরকারের ঘোষিত একটি রূপান্তরমূলক ব্যবস্থা। সাম্প্রতিক অতীতে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি সংস্কার করা হয়েছে,যেমন চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ (সি ডি এস) নিয়োগ, সামরিক বিষয়ক বিভাগ (ডি এম এ) তৈরি করা, বেশ কয়েকটি দেশীয় শিল্পের ঘোষণা, বন্ধুত্বপূর্ণ ক্রয় ব্যবস্থা (বিশেষ করে ইতিবাচক স্বদেশিকরণের তালিকা), এবং সাতটি ডি পি এস ইউ–তে ভেঙে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির কর্পোরেটাইজেশন। এই প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে অগ্নিপথ প্রকল্প ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতিকে শক্তিশালী করার জন্য সাহসী সংস্কারের একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এই ধরনের আমূল সংস্কারের জন্য সরকারকে কৃতিত্ব দিতে হবে, বিশেষ করে সংস্কারের আবেগপ্রবণ প্রকৃতির কারণে। সংস্কারটি দীর্ঘ সময় ধরে প্রতীক্ষিত ছিল, এবং এটি করা হয়েছে দেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির স্বার্থে।
অগ্নিবীরদের সংক্ষিপ্ত মেয়াদ সশস্ত্র বাহিনীকে উন্মেষশীল নানা বিপদ মোকাবিলার জন্য অনেক কমবয়সী প্রোফাইল বজায় রাখতে সাহায্য করবে। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ঘোষিত চাকরিতে সংরক্ষণগুলি সশস্ত্র বাহিনী থেকে বেরিয়ে আসার পরে অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের ক্রমিক উৎপাদনশীল ব্যস্ততা নিশ্চিত করবে। অবশ্যই, অন্য যে কোনও সংস্কারের মতো অগ্নিপথ–এ গোড়ার দিকে কিছু সমস্যা হবে। তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হবে নতুন অগ্নিবীরদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করার উপযোগী একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরি করা। কিছু হতাশাও থাকবে, বিশেষ করে তাঁদের জন্য যাঁরা আরামদায়ক জীবনব্যাপী পেনশন সুবিধা সহ দীর্ঘ মেয়াদের জন্য চাকরিপ্রার্থী। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে ভারত ১৯৬২, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে যখন বড় যুদ্ধগুলো লড়েছে, তখন কাজের মেয়াদ ছিল ৭–১০ বছর, এবং বেশিরভাগ ইউনিফর্মধারী কর্মী পেনশন বন্ধনীর বাইরে ছিলেন।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.