Published on Apr 13, 2023 Updated 0 Hours ago

ভারত এবং ইইউ-এর মধ্যে সম্পর্ক বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ কথা সুস্পষ্ট যে বৃহত্তর নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার পারস্পরিক প্রয়োজন বিরক্তির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে

ইউক্রেন সঙ্কটের বর্ষপূর্তি: ইইউ-ভারত সম্পর্ক কোথায় দাঁড়িয়ে?

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ শুরু হয় এবং বর্তমানে তা দ্বিতীয় বছরে পড়েছে।

যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার আর্থিক নিষেধাজ্ঞার দশম প্যাকেজ আরোপ করেছে এবং জার্মানির মতো সদস্য রাষ্ট্রগুলি কঠোর শক্তির গুরুত্বের বিলম্বিত স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সুরক্ষা নীতিগুলির পুনর্গঠন করেছে, তখন রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের অব্যাহত সম্পর্ক এবং রাশিয়ার কাছ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বর্ধিত পরিমাণে তেল ক্রয় স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের নিরপেক্ষতা ইইউ-ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্বকে ভিত্তি করে এমন একটি নিয়মভিত্তিক আদেশের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংঘাতের প্রাথমিক দিনগুলিতে নজিরবিহীন ইউরোপীয় কূটনৈতিক প্রয়াস ভারতকে তার অবস্থান পরিবর্তন করতে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের (ইউএন) যুদ্ধ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে বিরত থাকার বিষয় পুনর্বিবেচনা করার জন্য নয়াদিল্লিতে বহু ব্যক্তিত্ব এসেছেন।

ভারতের নিরপেক্ষতা ইইউ-ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্বকে ভিত্তি করে এমন একটি নিয়মভিত্তিক আদেশের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

তবুও এই সঙ্কটের বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ব্রাসেলসের পাশাপাশি ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিকভাবে ভারত-ইউরোপ রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাকে কমিয়ে দেয়নি; সম্পর্কের ঊর্ধ্বমুখী গতি স্থিতিশীল রয়েছে।

একটি পুনরুজ্জীবিত অংশীদারিত্ব

অতিমারি যুগ ইতিমধ্যে ইইউ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের সাক্ষী থেকেছে এবং একে অপরকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার প্রাথমিক অবস্থান থেকে উভয়ের সম্পর্ক অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। মধ্যশক্তি ভারত এবং ইউরোপ ইতিমধ্যেই মার্কিন-চিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে সৃষ্ট কৌশলগত শূন্যতা পূরণ করতে একে অপরের সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ততার চেষ্টা চালিয়েছে। তার পরে একই সঙ্গে চিন সম্পর্কে ভারতীয় এবং ইউরোপীয় হুমকির ধারণার পরিবর্তন এই বদলকে আরও ত্বরান্বিত করে এবং ২০২১ সালে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত একটি ইইউ+২৭ ফরম্যাটে ইইউ-ভারত নেতাদের ঐতিহাসিক বৈঠকের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। অতিমারির সময়ে একটি বৈশ্বিক কৌশলগত শক্তি হিসেবে ইইউ-এর উত্থান এবং সাম্প্রতিক ইউক্রেন সঙ্কট ভারত সম্পর্কে তার পরিবর্তনশীল ধারণার নেপথ্যে ভূমিকা পালন করেছে।

ভারত ও ইউরোপ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা-সহ অনেক নীতির ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে; এবং ইইউ-ভারত কর্মসূচির বিষয়বস্তুতে প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি এবং এমনকি ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (এআই) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রথম ইইউ-ইন্ডিয়া সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স কনসাল্টেশনস বা ইইউ-ভারত নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা পরামর্শ ২০২২ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ইইউ-ইন্ডিয়া ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজি কাউন্সিল এই ক্ষেত্রগুলিতে সহযোগিতার সুবিধার্থেই তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়াও ইইউ কাউন্সিলের সুইডেনের বর্তমান সভাপতিও ভারতের সঙ্গে এফটিএ-কে অগ্রাধিকার দিয়েছে।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে রাশিয়ার সম্পর্কে মতভেদ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ইইউ-ভারত কৌশলগত সমন্বয়কে ক্ষুণ্ণ করেনি যেখানে চিনা আগ্রাসন সম্পর্কে যৌথ সতর্কতা বর্ধিত সহযোগিতায় রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম একক বাজার এবং পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার দরুন এশিয়াকে ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্তকারী বাণিজ্যপথ এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ইইউ-এর গ্লোবাল গেটওয়ের অংশ হিসাবে ২০২১ সালে ইইউ-ভারত সংযোগ অংশীদারিত্ব চালু হয়।

ইউক্রেন সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে ইইউ-ভারত এফটিএ আলোচনা, যা ২০১৩ সাল থেকে স্থগিত ছিল, তা পুনরায় চালু করা হয়েছে। এফটিএ-র প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিশীলতা এবং বাণিজ্যিক অংশীদারদের বৈচিত্র্য-সহ ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা আলোচনা পুনরায় চালু করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। ২০২২ সালে ইইউ-ইন্ডিয়া ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজি কাউন্সিল এই ক্ষেত্রগুলিতে সহযোগিতার সুবিধার্থেই তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়াও ইইউ কাউন্সিলে বর্তমান সভাপতি সুইডেনও ভারতের সঙ্গে এফটিএ-কে অগ্রাধিকার দিয়েছে।

রাজনৈতিক ব্যস্ততা গভীরতর হচ্ছে

ভারত এবং ইউরোপও রাজনৈতিকভাবে একে অপরের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সম্পৃক্ত। ২০২২ এবং ২০২৩ সালে রাইসিনা ডায়লগের উদ্বোধনকারী ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট ভন ডার লেইন এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনির উপস্থিতি থেকেই এ কথা আরও স্পষ্ট। দু’বছরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান কূটনীতিক বোরেল এবং বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় বিদেশমন্ত্রী-সহ বিশাল সংখ্যক ইউরোপীয় উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল এই আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের বর্ষপূর্তিতে জার্মান চ্যান্সেলর স্কোলজ ভারত সফরের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে শীঘ্রই ফ্রান্স সফর করতে পারেন।

ব্রাসেলস, প্যারিস এবং বার্লিন ছাড়িয়ে নর্ডিক এবং স্লাভকভ গোষ্ঠী-সহ উপ-অঞ্চলগুলিকে সংযুক্ত করতে ভারত ইউরোপের সঙ্গে ব্যাপক কূটনৈতিক আদানপ্রদান চালাচ্ছে। ইউরোপীয় মহাদেশে বৈশ্বিক প্রতিবন্ধকতা এবং সংঘর্ষের সময়কালে এই আদানপ্রদান একে অপরের বর্তমান বিশ্বদৃষ্টিতে ভারত এবং ইউরোপের বর্ধিত প্রাসঙ্গিকতাকেই তুলে ধরে। জি২০, ভারত বর্তমানে যার সভাপতিত্ব করছে, সেই মঞ্চ-সহ একাধিক বহুপাক্ষিক মঞ্চে দুই দেশই সহযোগিতা করছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের বর্ষপূর্তিতে জার্মান চ্যান্সেলর স্কোলজ ভারত সফরের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে শীঘ্রই ফ্রান্স সফর করতে পারেন।

অতিমারি এবং ইউক্রেন সঙ্কটের মধ্য দিয়ে ইইউ-ভারত অংশীদারিত্ব নিঃসন্দেহে পরিপক্ব এবং সশক্ত হয়েছে। সেই দিনও গত, যখন ২০১২ সালের ইতালিয়ান মেরিন মামলার মতো ঘটনা সমগ্র অংশীদারিত্বকে পথচ্যুত করেছিল। তার পরিবর্তে বর্তমান সমস্যাগুলিকে আরও ভাল যোগাযোগ এবং একে অপরের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার সদিচ্ছার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের নিপুণ কূটনীতি এবং ভারতের অবস্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এই বোঝাপড়ায় অবদান রেখেছে। ইউরোপের জন্য ইউক্রেন সঙ্কট সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে মূল্যবোধ-ভিত্তিক অংশীদারিত্বের পুনরুত্থান ঘটিয়েছে, যেখানে একটি গণতন্ত্র হিসাবে ভারত যথাযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে।

সহযোগিতার সুযোগ

পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইইউ-ভারত সহযোগিতার সুযোগ বৃদ্ধিই পেয়েছে। কারণ উভয় দেশই তাদের শক্তি, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করছে এবং রাশিয়া ও চিন থেকে দূরে সরে আসার বিকল্প পথের সন্ধান চালাচ্ছে।

ইউরোপ রাশিয়ার জ্বালানির ব্যবহার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে এবং ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তার প্রতিরক্ষা আমদানিতে বৈচিত্র্য আনছে, যা ইতিমধ্যেই ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া আক্রমণের পরে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। রাশিয়ার জরাজীর্ণ সেনা এবং তার উপর চাপিয়ে দেওয়া পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞাগুলি রাশিয়াকে ভারতের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনির্ভরযোগ্য প্রতিরক্ষা অংশীদার করে তুলেছে। ভারতের সঙ্গে উন্নত নিরাপত্তা সহযোগিতার মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলি এই শূন্যতার কিছুটা পূরণ করতে পারে। স্টকহলম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অনুসারে, ইউরোপ বিশ্বের মোট প্রতিরক্ষা রফতানির ২৪ শতাংশের জন্য দায়বদ্ধ এবং জার্মানির মতো দেশগুলি তাদের অস্ত্র রফতানি নীতির উদারীকরণ ঘটাচ্ছে। ফ্রান্স এবং ইতালির সঙ্গে এগুলি ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা এবং দেশীয় উৎপাদনকে সমর্থন জোগাতে পারে তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির মাধ্যমে, যা ভারতে যৌথভাবে ছ’টি প্রচলিত সাবমেরিন নির্মাণের জন্য জার্মানির প্রচেষ্টায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

স্টকহলম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অনুসারে, ইউরোপ বিশ্বের মোট প্রতিরক্ষা রফতানির ২৪ শতাংশের জন্য দায়বদ্ধ এবং জার্মানির মতো দেশগুলি তাদের অস্ত্র রফতানি নীতির উদারীকরণ ঘটাচ্ছে।

রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সামগ্রিক সম্পর্কের ক্রমহ্রাসমান মূল্য সত্ত্বেও ভারত দেশটির সঙ্গে তার সম্পর্ক বজায় রাখবে। এর প্রাথমিক কারণ হল চিন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে মস্কোর ঘনিষ্ঠতা রোধ করা, যা ভারতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আগামী দিনে রাশিয়া ইউরোপের জন্য একটি বাধা হিসাবে অবিরত থাকবে এবং ভারতের সুসঞ্চালিত ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ ইউরোপীয় অংশীদারদের শ্যেন নজরে থাকবে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে তার কার্যকলাপ সঙ্কুচিত হওয়া রোধ করতে ভারত কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হতে পারে। ইইউ-এর কার্যকারিতার ঐকমত্যভিত্তিক প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে, পোল্যান্ডের মতো দেশগুলি – যেটি সংঘাতের দোরগোড়ায় রয়েছে – তারাও ভারতের সঙ্গে

সহযোগিতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি করতে পারে।

তবু এখনও পর্যন্ত ভারতের অবস্থানের বিষয়ে ইউরোপীয় বিরোধিতা গণমাধ্যমের ভাষ্য এবং জনমতের মাধ্যমেই উঠে এসেছে। বাস্তবে উভয় সরকারের মধ্যে সম্পর্কের উপর এর প্রভাব সীমিত এবং উভয় পক্ষই সম্ভাব্য ঝুঁকির প্রেক্ষিতে বিস্তৃত দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের উপর মনোনিবেশ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে করা হচ্ছে।

নিরাপত্তা, ভূ-অর্থনীতি, চিন, রাশিয়া এবং উদীয়মান বিশ্বক্রম নিয়ে বিতর্ক ভারতীয় এবং ইউরোপীয়… উভয় ক্ষেত্রেই অভিযোজিত হয়েছে। এই সঙ্কটময় মোড়ে ব্রাসেলস এবং সদস্য রাষ্ট্রের রাজধানীগুলির সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক৷ বোরেল যেমনটা বলেছেন, ‘সকল দৃষ্টান্তে চোখে চোখ রাখা কোনো সহযোগিতার পূর্বশর্ত হওয়া উচিত নয়।’ ভারত এবং ইউরোপের জন্য বৃহত্তর নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার পারস্পরিক প্রয়োজন বিরক্তির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.