২০২২ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ইউক্রেন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের চারপাশে সৈন্য-সমাবেশ করছিলেন। তা দেখে এ কথাই বিশ্বাস করা হয়েছিল যে, এই পদক্ষেপ ইউরোপের সঙ্গে মীমাংসার পুনর্বিবেচনার জন্য একটি কূটনৈতিক কৌশলের অংশ। ইউরোপে যাতে যুদ্ধ ফিরে না আসে সেকথা সুনিশ্চিত করার জন্য পশ্চিমী দেশগুলি চেষ্টা চালাচ্ছিল। সারা বিশ্ব শঙ্কিত ছিল কিন্তু খুব কম মানুষই একথা বিশ্বাস করেছিলেন যে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হতে পারে।
কিন্তু তবুও এমনটাই ঘটল যা চিরতরে ইউরোপ এবং সারা বিশ্বের ভূ-রাজনীতিকে বদলে দিয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি সেই দুর্ভাগ্যজনক দিন থেকে – যখন রুশ আক্রমণ শুরু হয়েছিল – আনুমানিক প্রায় ১ লক্ষেরও বেশি রুশ এবং ১ লক্ষ ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত বা আহত হয়েছেন। এর পাশাপাশি প্রায় ৪০,০০০ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। ৭৮ লক্ষেরও বেশি ইউক্রেনীয় মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সাম্প্রতিক সফরের সময় ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন যে তাঁর দেশ কখনই আত্মসমর্পণ করবে না। তিনি বলেছিলেন, ‘ঠিক যেমনটা ১৯৪৪ সালের ক্রিসমাসের সময়ে সাহসী আমেরিকার সৈন্যরা তাঁদের জমি আঁকড়ে থেকে হিটলারের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, সাহসী ইউক্রেনীয় যোদ্ধারাও এ বছরের ক্রিসমাসে পুতিনের বাহিনীর বিরুদ্ধে একই ভাবে মোকাবিলা করছে।’ ইউক্রেনীয় যুদ্ধ-প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করাতে গিয়ে জেলেনস্কি এই প্রস্তাবকে ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য এক বিনিয়োগরূপে দর্শান, এবং এমনকি আগামী বছর সংঘাতে একটি ‘বাঁক বদল’-এর কথাও অনুমান করেন।
রাশিয়া আশা করবে যে, একটি কঠোর শীত শুধুমাত্র ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য জনসমর্থনের ভিতই নাড়িয়ে দেবে না, বরং কিয়েভের পাশে দাঁড়ানোর ইউরোপীয় সংকল্পকেও পরীক্ষার মুখে ফেলে দেবে।
তবে জেলেনস্কি এ কথাও জানেন যে, আগামী কয়েক মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জো বাইডেন নতুন করে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা প্যাকেজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পরে আসছে আরও ৪৫ বিলিয়ন। তবে আর একটি যুদ্ধ প্রচেষ্টায় আমেরিকার ক্রমবর্ধমান খরচ সম্পর্কে রিপাবলিকানদের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কথা লক্ষ্যণীয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ-ক্লান্ত, আমেরিকানদের এক-তৃতীয়াংশ ইউক্রেনকে অব্যাহত মার্কিন সহায়তা প্রদানের পক্ষে নয় এবং জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক চান ইউক্রেন শান্তিচুক্তির পথ বেছে নিক।
রাশিয়া আশা করবে যে, একটি কঠোর শীত শুধুমাত্র ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য জনসমর্থনের ভিতই নাড়িয়ে দেবে না, বরং কিয়েভের পাশে দাঁড়ানোর ইউরোপীয় সংকল্পকেও পরীক্ষার মুখে ফেলে দেবে। মস্কো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনে একটি প্রক্সি যুদ্ধ চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করেছে এবং ওয়াশিংটনের প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ এই ক্ষোভের পরিমাণকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ইউক্রেনের যুদ্ধ শীঘ্রই শেষ হতে পারে বা না-ও হতে পারে। তবে এটি বিশ্বব্যাপী ভূচিত্রকে উল্লেখযোগ্যভাবে রূপান্তরিত করেছে। কাঠামোগতভাবে এটি বৈশ্বিক মেরুকরণের প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের বৈরিতা বর্তমানে বৃহত্তর মার্কিন-চিন প্রতিযোগিতাকে উস্কে দেওয়ার পাশাপাশি রাশিয়া-চিন অক্ষকে আরও মজবুত করেছে। ইউরোপ তার নিরাপত্তামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামরিক সক্ষমতাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি চিনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছে। পুতিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় ব্যবস্থার ভিত্তিকে নাড়া দিয়েছেন এবং বর্তমানে মনে করা হচ্ছে যে, দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উদ্ভূত হতে পারে, যেখানে শি জিনপিং আক্রমণ চালানোর একটি উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় রয়েছেন। অর্থাৎ এই অস্থির সময়ের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়ার জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান এবং কাঠামো প্রয়োজন। বিদ্যমান বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা বর্তমানে ধুঁকছে এবং কাঠামোগত মেরুকরণ সুনিশ্চিত করবে যাতে এটিকে পুরনো ব্যবস্থার নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়। বহুপাক্ষিক এবং অনুপাক্ষিকতার নতুন মডেলের দিকে এগিয়ে যাওয়া এই সময়েরই প্রতিক্রিয়া মাত্র। সমমনস্ক দেশগুলির ছোট জোট বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে আরও কার্যকর হতে চলেছে।
বিদ্যমান বহুপাক্ষিক ক্রম বর্তমানে ধুঁকছে এবং কাঠামোগত মেরুকরণ সুনিশ্চিত করবে যাতে এটিকে পুরনো ব্যবস্থার নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়।
ইউক্রেন-যুদ্ধ ভবিষ্যতের সামরিক বাহিনী কীভাবে লড়াই চালাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এই পদক্ষেপের কার্যকারিতা হ্রাসে নতুন প্রযুক্তির ভূমিকাকে তুলে ধরেছে। এটি দুই প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম সবচেয়ে বড় সাইবার দ্বন্দ্বও, যেখানে ইউক্রেন ডিজিটাল তথ্যের যুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার সংঘাত যুদ্ধক্ষেত্রকে আকার দেওয়ার পাশাপাশি অ-সামরিক জবরদস্তিমূলক করেছে। বিকেন্দ্রীভূত আদেশ এবং নিয়ন্ত্রণ অনুশীলনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে রাশিয়ার ব্যর্থতাও প্রকাশ্যে এসেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ আগামী বছরগুলিতে বিশ্ব রাজনীতির রূপদান করবে। ভারতের জন্যও এটি তার বিদেশ এবং নিরাপত্তা নীতির সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে এবং একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধগুলিতে লড়াই চালানোর জন্য ভারতের সামরিক বাহিনীর পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তাকেও দর্শিয়েছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.