বাল্টিক সাগরের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি সাবমেরিন কেবল সিকিউরিটি বা সমুদ্রগর্ভস্থ কেবলের নিরাপত্তাকে আলোচনার কেন্দ্রে তুলে এনেছে। সমুদ্রের তলদেশের দু’টি ফাইবার-অপটিক কেবলকে – যার মধ্যে একটি ফিনল্যান্ডকে জার্মানির সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং অপরটি লিথুয়ানিয়াকে সুইডেনের সঙ্গে সংযুক্ত করে – নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, যার ফলে উল্লেখযোগ্য যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়েছিল। ফিনল্যান্ড এবং জার্মানি এক যৌথ বিবৃতিতে এই ঘটনা স্বীকার করেছে ও নাশকতার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছে। ফিনল্যান্ড-জার্মানি কেবলের ক্ষতি করার জন্য সন্দেহজনক জাহাজটি চিনের ছিল… এ হেন জল্পনা তীব্রতর হয়েছে, যা এই উদ্ঘাটিত আখ্যানে চক্রান্তের এক মাত্রা যোগ করেছে। আইরিশ সাগরে উল্লেখযোগ্য সাব-সি কেবল এবং পাইপলাইনের কাছে একটি রুশ গোয়েন্দা জলযান দেখা যাওয়ার কয়েক দিন পরেই এই ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে, যা ইচ্ছাকৃত ভাবে মিশ্র ধরনের আক্রমণের উদ্বেগ বৃদ্ধি করেছে। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার বিদ্যমান যুদ্ধ এবং ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক অবকাঠামোর উপর রাষ্ট্র-অর্থায়িত নাশকতার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে।
ফিনল্যান্ড-জার্মানি কেবলের ক্ষতি করার জন্য সন্দেহজনক জাহাজটি চিনের ছিল… এ হেন জল্পনা তীব্রতর হয়েছে, যা এই উদ্ঘাটিত আখ্যানে চক্রান্তের এক মাত্রা যোগ করেছে।
ট্রান্স-আটলান্টিক কৌশলগত সম্প্রদায়ের উদ্বেগ ন্যায়সঙ্গত। সমুদ্রের তলদেশের কেবলগুলি হল বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের প্রাণশক্তি, যা আন্তর্জাতিক তথ্য প্রবাহের ৯৯%-এর বেশির জন্য দায়বদ্ধ এবং এ হেন কেবলগুলি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক লেনদেন ও নিরাপদ যোগাযোগকে সক্ষম করে তোলে। এই কেবলগুলি ইন্টারনেটের মেরুদণ্ডসম। যথেষ্ট গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও সেগুলি দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি এবং ইচ্ছাকৃত নাশকতা উভয়ের সামনে মূলত অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। বাল্টিকের ঘটনাগুলি এই ভঙ্গুরতার এক তীব্র অনুস্মারক, যা ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে প্রয়োজনীয় জনঅবকাঠামোর জন্য ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিকেই দর্শায়।
তা সত্ত্বেও এই সন্দেহ জাগতে পারে যে, এই ঘটনাগুলি আসলে অপশক্তিগুলির তরফে এক বৃহত্তর মিশ্র যুদ্ধকৌশলের অংশবিশেষ, যা নিবিড় পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। একটি সমুদ্রগর্ভস্থ কেবল-এর তার বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা কোনও সামান্য ঘটনা নয়। অগভীর জলে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য কেবলগুলি সমুদ্রতলের নীচে লুকিয়ে রাখা হয়। অন্য দিকে গভীর জলে এ হেন কেবল খুঁজে না পাওয়ার ঘটনা একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধক। ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনও কেবল ছিন্ন করার জন্য প্রয়োজন বিশেষ সরঞ্জাম, কেবলপথ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান এবং গভীর সমুদ্রের চরম পরিস্থিতিতে কাজ করার ক্ষমতা। এর অর্থ হল ব্যাপক চাপ ও সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যে পথ খুঁজে নেওয়া — যে কাজের জন্য উন্নত ও ব্যয়বহুল প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রাশিয়া ও চিনের মতো রাষ্ট্রীয় শক্তিদের কাছে এই ধরনের অভিযান চালানোর দক্ষতা ও সংস্থান থাকলেও তারা ততক্ষণ এ হেন
পদক্ষেপ নেবে না, যতক্ষণ না তারা উল্লেখযোগ্য উস্কানির সম্মুখীন হয় এবং তাদের অভিযান একটি সুস্পষ্ট কৌশলগত প্রতিদান দেয়।
রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলির তরফে কেবলের উপর নাশকতার সম্ভাবনা প্রায়শই বাড়িয়ে দেখানো হয়। কারণ এ হেন কর্মকাণ্ডের সম্ভাব্য ফলাফল নিতান্তই অস্পষ্ট, বিশেষ করে যখন প্রভাবিত দেশগুলি যুদ্ধরত নয়। সমুদ্রের তলদেশে কেবলগুলি বিচ্ছিন্ন করা যথেষ্ট ঝুঁকিমূলক অভিযান এবং এর ফলে মুখোশ খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ও প্রতিশোধের অনুভূতি জন্ম নেয়। এ হেন কাজে জড়িয়ে পড়লে কূটনৈতিক পতন থেকে শুরু করে নিষেধাজ্ঞা, এমনকি দেশটির বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার হতে পারে যা আসলে কেবল বিচ্ছিন্ন করার ফলে যেটুকু লাভ হত, তার চেয়ে পাল্লায় অনেক বেশি ভারী। সর্বোপরি, অ-যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলির যোগাযোগ শৃঙ্খলগুলিকে ব্যাহত করার ফলে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ অবকাঠামোর আন্তঃসংযুক্ত প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি থাকে, যা সম্ভাব্য ভাবে নাশকতার নিজস্ব স্বার্থেরই ক্ষতি করতে পারে।
এ হেন কাজে জড়িয়ে পড়লে কূটনৈতিক পতন থেকে শুরু করে নিষেধাজ্ঞা, এমনকি দেশটির বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার হতে পারে … যা আসলে কেবল বিচ্ছিন্ন করার ফলে যেটুকু লাভ হত, তার চেয়ে পাল্লায় অনেক বেশি ভারী।
এ কথা মোটেই আশ্চর্যের নয় যা, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সমুদ্রগর্ভস্থ কেবল বিঘ্নের ঘটনা ঘটেছে নোঙর টেনে নিয়ে যাওয়া এবং মাছ ধরার জন্য। গত বছরের মার্চ মাসে লোহিত সাগরে এ হেন একটি ঘটনার জন্য প্রাথমিক ভাবে ইয়েমেনি হুতিদের উপর দোষারোপ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে দেখা যায়, একটি বাণিজ্যিক জাহাজের উপর হামলার সময় একটি নোঙর টেনে নিয়ে যাওয়ার কারণে এই কেবল বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ ভাবে বেশির ভাগ আপাতদৃষ্টিতে ইচ্ছাকৃত কেবল ছিন্ন করার ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে এ হেন পদক্ষেপের কারণ অনুসন্ধানই আসল চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতির বিপরীতে এ হেন নাশকতা আসলে গুটিকয়েক নির্দিষ্ট চিহ্ন রেখে যায়, যা প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টি কঠিন করে তোলে। অর্থাৎ নাশকতার সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখা নয়, বরং সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে সতর্কতার সঙ্গে তদন্তের গুরুত্বের উপর জোর দেওয়া দরকার।
ভারতের জন্য বাল্টিক সমুদ্রের ঘটনাগুলি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বয়ে আনে। ভারত মহাসাগরে তার বিস্তীর্ণ উপকূলরেখা ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে, ভারত সংযোগের জন্য সমুদ্রের তলদেশের কেবলের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। যাই হোক, এই সম্পদগুলিকে রক্ষা করার জন্য দেশের পদ্ধতি উদ্বেগজনক রকমের শিথিল। আইনগত ও নিয়ন্ত্রকমূলক ব্যবধান ও এক্তিয়ার সংক্রান্ত অস্পষ্টতার দরুন ভারতের আশপাশের সমুদ্রগর্ভস্থ কেবলগুলি ঝুঁকিপূর্ণই থেকে গিয়েছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে ভারতের টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটির একটি সুপারিশ সত্ত্বেও সমুদ্রের তলদেশের কেবলগুলিকে এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসাবে মনোনীত করা হয়নি এবং ভারতের আঞ্চলিক জলসীমা ও একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে এ হেন নিয়মাবলি প্রয়োগের ব্যবস্থাও দুর্বল রয়ে গিয়েছে।
কেবলের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে ভারত একাই অনিচ্ছুক নয়। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক উপকূলীয় দেশ সমুদ্রগর্ভস্থ কেবলগুলি সুরক্ষিত করার জন্য একই রকম লাইসেজ-ফেয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করে। এই মনোভাব প্রায়শই পদ্ধতিগত সমস্যা থেকে উদ্ভূত হয়। কারণ আঞ্চলিক সরকারগুলি সমুদ্রের নীচের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রক্ষার খরচ ও জটিলতা এড়িয়ে যেতে যায় এবং নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সংস্থার হাতেই ছেড়ে দেয়। এই ধরনের হাত তুলে নেওয়ার মনোভাব অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। একটি বড় কেবলের ক্ষতি ইন্টারনেট পরিষেবা, আর্থিক ব্যবস্থা এবং এমনকি সামরিক যোগাযোগকেও মারাত্মক ভাবে ব্যাহত করতে পারে।
যেহেতু চিন ভারত মহাসাগরে তার সামুদ্রিক উপস্থিতি প্রসারিত করছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর অনুসন্ধান চালাচ্ছে, তাই ভারতও আত্মতুষ্টিতে ভুগতে পারে না।
ভারতের প্রতিবেশে ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ এই দুর্বলতাগুলিকে মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তাকে দর্শায়। যেহেতু চিন ভারত মহাসাগরে তার সামুদ্রিক উপস্থিতি প্রসারিত করছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর অনুসন্ধান চালাচ্ছে, তাই ভারতও আত্মতুষ্টিতে ভুগতে পারে না। নিজের গবেষণা ও জরিপ সংক্রান্ত জাহাজের বহর-সহ চিনা নৌ ও সামুদ্রিক সম্পদের ক্রমবর্ধমান কার্যকলাপ ইউরোপীয় জলরাশিতে ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত বিন্যাসেরপ্রতিফলন ঘটায়। এই জাহাজগুলিকে প্রায়শই বৈজ্ঞানিক অন্বেষণের সরঞ্জাম হিসাবে তুলে ধরা হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর মানচিত্রায়ন এবং সম্ভাব্য বিঘ্নের জন্য প্রস্তুতির জন্য ব্যাপক ভাবে সন্দেহ করা হয়। ইউরোপের জলরাশিতে হওয়া ঘটনার সঙ্গে এই সব কিছুর মিল নজর এড়াতে পারে না।
অবশেষে, এ কথাও স্বীকার করে নিতে হবে যে, সমুদ্রগর্ভস্থ কেবলগুলি সুরক্ষিত করার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যা আইনি সংস্কার, প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মিশেলকেই দর্শায়। সমুদ্রগর্ভস্থ কেবলগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার চেয়েও ভারতকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক গুণমানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ করে তোলার জন্য দেশীয় আইনের সংস্কার করতে হবে। ভারতকে উন্নত নজরদারি ও পর্যবেক্ষণমূলক ব্যবস্থাগুলিতেও বিনিয়োগ করতে হবে এবং কেব্লপথের কাছাকাছি অস্বাভাবিক কার্যকলাপ শনাক্ত করতে অংশীদার রাষ্ট্রগুলির দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে।
নয়াদিল্লির জন্য এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না। যেহেতু ভারত নিজেকে ডিজিটাল ও সামুদ্রিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাই বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের ধমনী রক্ষা করা অবশ্যই একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হয়ে ওঠা উচিত। তাই আর একটি কেবল বিচ্ছিন্ন হল কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; তবে যদি সত্যিই কেবল বিচ্ছিন্ন হয়, তা হলে কি ভারত আদৌ প্রস্তুত থাকবে… তা সে নাশকতার ঘটনা হোক বা না হোক।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.