২০২৩-এর ৭ অক্টোবরের হামলা এবং তার পরে ইজরায়েলের একটি সমন্বিত সামরিক প্রতিশোধের পর একাধিক ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী থেকেছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটি। সম্প্রতি ইজরায়েল এবং লেবাননে ঘাঁটি গেড়ে থাকা হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রকৃত যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিপদের ঘণ্টা বেজে উঠেছে।
আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি আধা-সামরিক সংস্থা হিসাবে চিহ্নিত হিজবুল্লাহ ১৯৮২ সালে ইরানের নির্দেশনায় এবং সমর্থনে লেবাননে ইজরায়েলি আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে গঠিত হয়েছিল। গত দুই দশক ধরে ইরানের মিত্রদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সিরিয়া ও ইরাকে ইউনিট মোতায়েনকারী বিশাল আর্থিক ও সামরিক সম্পদ-সহ এক লক্ষ যোদ্ধার একটি বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এই গোষ্ঠীটি সেই সময় থেকেই ক্রমশ বেড়ে উঠেছে।
হামাসকে নির্মূল করার জন্য ইজরায়েল গাজায় আক্রমণ শুরু করার পর থেকে হিজবুল্লাহ ইজরায়েলের উপর চাপ বজায় রাখতে এবং দেশটিকে বিভ্রান্ত করার জন্য ক্রমাগত স্বল্প মাত্রার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
হামাসকে নির্মূল করার জন্য ইজরায়েল গাজায় আক্রমণ শুরু করার পর থেকে হিজবুল্লাহ ইজরায়েলের উপর চাপ বজায় রাখতে এবং দেশটিকে বিভ্রান্ত করার জন্য ক্রমাগত স্বল্প মাত্রার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই আক্রমণগুলিকে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া এবং বড় আক্রমণ শুরু করা থেকে অন্যকে নিবৃত্ত করার জন্য হলেও হামলার মাত্রা এবং তীব্রতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ক্রমশ এই উদ্বেগও বেড়ে উঠছে যে, হিজবুল্লাহ এবং ইজরায়েল একে অপরের সঙ্গে একটি পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে। লেবানন এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশে যুদ্ধের সম্প্রসারণ হলে তা মারাত্মক ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ব্যর্থতা বৃদ্ধির আধিপত্য
ইজরায়েলের জন্য যুদ্ধে প্রবেশের যুক্তির একটি বড় অংশ তার ‘বাড়তি আধিপত্যের’ কৌশলের মধ্যে নিহিত। এটি এই ধারণাটিকেই দর্শায় যে, ইজরায়েল প্রায়শই তার নিজের উপর সামান্য সামরিক অনুপ্রবেশ বা আক্রমণ ঘটলে যে কোনও দেশের বিরুদ্ধে খুব কঠোর ভাবে প্রতিশোধ নেয়। হিজবুল্লাহর জন্য এমনটা ২০০৬ সালে দেখা গিয়েছিল, যখন হিজবুল্লাহ দুই ইজরায়েলি সৈন্যকে অপহরণ করেছিল এবং এর ফলে ইজরায়েলের তরফে পাল্টা ধ্বংসাত্মক আক্রমণের দরুন ১০০০ জন লেবানিজ নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। সে সময়ে হিজবুল্লাহ এই ঘোষণাও করেছিল যে, ইজরায়েলের প্রতিশোধের পরিমাণ সম্পর্কে তারা অবগত থাকলে হয়তো এই অপহরণ-কাণ্ড এড়িয়ে যেত। একই নীতি গাজায় ইজরায়েলের আক্রমণকে আরও বৃহত্তর পরিসরে পরিচালিত করেছে।
ইজরায়েলের জন্য যুদ্ধে প্রবেশের যুক্তির একটি বড় অংশ তার ‘বাড়তি আধিপত্যের’ কৌশলের মধ্যে নিহিত। এটি এই ধারণাটিকেই দর্শায় যে, ইজরায়েল প্রায়শই তার নিজের উপর সামান্য সামরিক অনুপ্রবেশ বা আক্রমণ ঘটলে যে কোনও দেশের বিরুদ্ধে খুব কঠোর ভাবে প্রতিশোধ নেয়।
যাই হোক, ইজরায়েলের প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্য - যিনি ৭ অক্টোবরের অনেক আগে থেকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং যিনি এখন যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছেন - এই কৌশলটি গাজায় ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর গাজায় ইজরায়েল বিজয় দাবি করেছে এবং সেখানে বিজয় দাবি করা সত্ত্বেও ইজরায়েলি সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়ার পর হামাস ফের আবির্ভূত হয়েছে, যা কিনা ইজরায়েলের তরফে আরও সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য করেছে। এই উত্তর গাজার ঘটনাকেই গেরিলা যুদ্ধে সিসিফাস প্রভাব নামে অভিহিত করা যেতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহু লেবাননের সঙ্গে অভিন্ন সাধারণ সীমা ভাগ করে নেওয়া ইজরায়েলের উত্তর সীমানার দিকে তাকাতে বাধ্য হয়েছেন এবং তার নেপথ্যে প্রধান উদ্দেশ্যই হল নিজের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের মতবাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। হিজবুল্লাহ ও ইজরায়েলের মধ্যে আক্রমণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইজরায়েলি সরকারের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করার জন্য ৩৫০০০-এরও বেশি ইজরায়েলি নাগরিককে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। যেমন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে জয় ইজরায়েলকে তার শত্রুদের চোখে তার সামরিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করতে পারে।
সম্ভাব্য পরিস্থিতি
বর্তমান অবস্থায় তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা ভাবা যেতে পারে। প্রথমত, একটি বর্ধিত যুদ্ধের আঞ্চলিক ও সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে (নীচে বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা উভয়ের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করছে। এই কূটনীতি যদি সফল হয়, তা হলে নিশ্চয়ই উত্তেজনা কমবে। দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের ক্ষেত্রে লেবানন এবং ইজরায়েলকে গুরুতর সমান্তরাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বলে উভয় পক্ষের জন্য এটিই সবচেয়ে লাভজনক পরিস্থিতি হবে। যাই হোক, এ হেন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা কঠিন বলে মনে হচ্ছে। কারণ হিজবুল্লাহ দাবি করেছে যে, গাজায় ইজরায়েল কোনও যুদ্ধবিরতি কার্যকর না করা পর্যন্ত তারা কোনও শান্তি আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে না, হামাসকে পরাজিত না করে নেতানিয়াহু এবং তাঁর মন্ত্রিসভা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে… এ হেন একটি অকল্পনীয় দৃশ্যও অস্বাভাবিক হবে না।
দ্বিতীয় সম্ভাব্য পরিস্থিতি অনুযায়ী ইজরায়েল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে একটি সীমিত আগ্রাসন দেখা যেতে পারে, যা দক্ষিণ লেবানন অঞ্চলের মধ্যে ঘটতে পারে। এ হেন পরিস্থিতিতে দু’টি দল তাদের নিজেদের জনসাধারণের কাছে এই কথা প্রদর্শন করার জন্য কোনও না কোনও যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে যে, তারা যথেষ্ট শক্তিশালীই আছে, তবে ধ্বংসাত্মক ক্ষয়ক্ষতি থেকে বিরত রয়েছে। বিশেষত, উভয় পক্ষই সংঘর্ষের গতি সীমিত রেখে বেসামরিক নাগরিকদের উপর আক্রমণ না করে নিজেদের প্রতিপক্ষের সামরিক কেন্দ্রগুলিতে বিমান হামলা চালাবে। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একটি বিপথগামী ক্ষেপণাস্ত্র উভয় দেশের বেসামরিক কেন্দ্রগুলিতে আঘাত করলে চাপ ও উত্তেজনা বাড়াতে পারে এবং তা একটি পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধের দিকে চালিত করতে পারে। যাই হোক, কূটনীতি কাজ না করলে এই পরিস্থিতিকেও একেবারে খারিজ করে দেওয়া যায় না।
দ্বিতীয় সম্ভাব্য পরিস্থিতি অনুযায়ী ইজরায়েল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে একটি সীমিত আগ্রাসন দেখা যেতে পারে, যা দক্ষিণ লেবানন অঞ্চলের মধ্যে ঘটতে পারে। এ হেন পরিস্থিতিতে দু’টি দল তাদের নিজেদের জনসাধারণের কাছে এই কথা প্রদর্শন করার জন্য কোনও না কোনও যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে যে, তারা যথেষ্ট শক্তিশালীই আছে, তবে ধ্বংসাত্মক ক্ষয়ক্ষতি থেকে বিরত রয়েছে।
তৃতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হবে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ, যা শুধু দু’টি পক্ষকেই অন্তর্ভুক্ত করবে না, বরং হিজবুল্লাহর আঞ্চলিক মিত্র যেমন ইয়েমেনের হুতি এবং ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াকেও (যারা ইরাকে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল) অন্তর্ভুক্ত করবে। লেবানন এবং ইজরায়েলে জীবন ও সম্পত্তির সুস্পষ্ট ধ্বংসের পাশাপাশি হুতিরা নিজেদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক পথগুলি বিনষ্ট করতে পারে। কারণ হুতিরা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে যে, চাইলে তারা এমনটা করতে যথেষ্ট সক্ষম। এই পরিস্থিতি সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমী দেশকেও উদ্বিগ্ন করবে, যার ফলে উত্তেজনা কমানোর উদ্দেশ্যে বিদ্যমান কূটনীতির আশ্রয় নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
উপসংহার: একটি ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ
ইজরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ এবং এর প্রভাব এখন বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার সুপ্ত সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে হিজবুল্লাহ ও লেবাননের দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকটি পরিস্থিতি সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে: উত্তেজনা প্রশমিত করা, সীমিত করা বা সর্বাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া। ইজরায়েলের জন্য হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বকে সরিয়ে নেওয়ার চাপ যথেষ্ট স্পষ্ট। এই দিকটি ছাড়া, যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করাকে কেবল দুর্বলতার চিহ্ন হিসাবেই দেখা হবে এবং তা এমন একটি পরিস্থিতি যা নেতানিয়াহু এড়িয়ে যেতে মরিয়া এবং অন্ততপক্ষে লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইজরায়েলের সংগঠিত হওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টিতে এ কথাই স্পষ্ট।
এই অবস্থার ফলাফল যা-ই হোক না কেন, ফিলিস্তিনের সংঘাত শেষ হয়নি এবং সহিংসতা বেড়ে চলা ও তার আপেক্ষিক হ্রাসের চক্র অব্যাহত রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। প্রতিটি চক্রের সঙ্গে হতাহতের সংখ্যা এবং অর্থনৈতিক ও ভৌত ক্ষতি বাড়ছে। এই পটভূমিতে ইজরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে আর একটি যুদ্ধ হলে, তার প্রভাব চার পাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য নিজেকে আটকাতে পারবে না।
মোহাম্মদ সিনান সিয়েচ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নন-রেসিডেন্ট অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.