ভারত সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে দ্বিতীয় বিমস্টেক (বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন) ফরেন মিনিস্টারস রিট্রিটের আয়োজন করে। ‘বঙ্গোপসাগরের মধ্যে সংযোগ, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতার উপায় ও দিশা নিয়ে আলোচনা করা এবং তা ত্বরান্বিত করার জন্য একটি অনানুষ্ঠানিক মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে’ এই রিট্রিটের আয়োজন করা হয়। সেপ্টেম্বরে নির্ধারিত ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্য রিট্রিট অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে বিমস্টেক নেতারা অতিমারি-পরবর্তী যুগে প্রথম বারের মতো ব্যক্তিগত ভাবে সাক্ষাৎ করবেন। তাঁরা আঞ্চলিক সংযোগের উন্নতির জন্য সমুদ্র পরিবহণ সহযোগিতা সংক্রান্ত বিমস্টেক চুক্তিতেও স্বাক্ষর করবে্ন বলে আশা করা হচ্ছে, যা এই গোষ্ঠীটির মূল লক্ষ্য।
পূর্ব অভিমুখের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা
বিমস্টেক হল বঙ্গোপসাগরে নিবেদিত একটি আঞ্চলিক সংস্থা, যার সদস্যপদে রয়েছে পাঁচটি দক্ষিণ এশীয় এবং দু’টি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ এবং সাতটি দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে। এটি নয়াদিল্লিকে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের সেই দেশগুলির সাথে বহুপাক্ষিক ভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়, যেগুলি তার পূর্ব দিকের প্রতিবেশী এবং তাই এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতির প্রয়োজনীয়তার জন্য অত্যাবশ্যক। বঙ্গোপসাগরে চিনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য সম্ভাব্য হুমকি এবং এই জলসীমায় একটি পছন্দের নিরাপত্তা অংশীদার হিসাবে নয়াদিল্লির অবস্থানের জন্য ভারত তার পূর্ব প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার অভিপ্রায় বহন করে।
বিমস্টেক হল বঙ্গোপসাগরে নিবেদিত একটি আঞ্চলিক সংস্থা, যার সদস্যপদে রয়েছে পাঁচটি দক্ষিণ এশীয় এবং দু’টি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ এবং সাতটি দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে।
বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা ভারতকে তার স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে সমুদ্রে প্রবেশের সুবিধা প্রদান করে। উপরন্তু, মায়ানমার এবং তাইল্যান্ডের সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক ভারতকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আরও গভীর উপস্থিতির সুযোগ করে দেবে। কারণ আসিয়ান (অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস) এই অঞ্চলেরই অংশ, যেখানে এই দু’টি দেশ সহ-সদস্য হওয়ায় ইন্দো-প্যাসিফিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব বহন করে। তাইল্যান্ড বিমস্টেক এবং আসিয়ানের মধ্যে একটি সেতু হিসাবে নিজেকে চিহ্নিত করে রিট্রিটে এই ধারণাটিকে সশক্ত করেছে। এই অগ্রাধিকারগুলি ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের দেওয়া উদ্বোধনী ভাষণেও প্রতিফলিত হয়েছিল, যখন তিনি বলেছিলেন যে বিমস্টেক ভারতের ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশ প্রথম’ দৃষ্টিভঙ্গি, ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ বা ‘পূর্ব অভিমুখী নীতি’ এবং সাগর (সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন অর্থাৎ অঞ্চলের সকলের জন্য নিরাপত্তা ও বৃদ্ধি) দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।
রিট্রিটের দু’টি অংশ
রিট্রিট দু’টি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীরা বিমস্টেকের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ন করেন। প্রথম রিট্রিটের মূল ফলাফলের বাস্তবায়নের উপর ভারতের একটি উপস্থাপনাকে ভিত্তি করে এই মূল্যায়ন করা হয়। কৃষি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, এবং সামুদ্রিক পরিবহণের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সদস্য রাষ্ট্রগুলিতে সেন্টার অফ এক্সিলেন্স প্রতিষ্ঠা-সহ সদস্য রাষ্ট্রগুলি দ্বারা একাধিক ধারণা ভাগ করে নেওয়া হয়। ভারত সমস্ত বিমস্টেক রাষ্ট্রের রোগীদের জন্য ক্যান্সার গবেষণা, চিকিত্সা এবং ই-ভিসা প্রদানের উদ্দেশ্যে সমর্থন ঘোষণা করেছে, যেখানে শ্রীলঙ্কা কিডনির রোগের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবনা দিয়েছে। বাণিজ্যে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের উন্নত করার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হয়েছিল। সংযোগ, সাইবার-নিরাপত্তা এবং মাদকদ্রব্য ও অবৈধ অস্ত্রের পাচার প্রতিরোধে গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ ব্লু ইকোনমি অর্থাৎ নীল অর্থনীতিতে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছে এবং উপসাগরে মাছ ধরার সমস্যা মোকাবিলায় প্রজনন মরসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার জন্য সদস্য দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
দ্বিতীয় অধিবেশনে আসন্ন শীর্ষ সম্মেলন থেকে প্রতিটি দেশের প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা করা হয়। শ্রীলঙ্কা বিমস্টেক দেশগুলিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া খনিজ সম্পদের মানচিত্র তৈরি করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে এবং দেশগুলির অর্থনীতিতে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের মধ্যে উত্পাদনের পর্যায়ে উল্লম্ব সমন্বিতকরণের সুযোগ তৈরি করে, তাদের উত্পাদন কাঠামোকে বৈচিত্র্যময় করার কথা বলেছে। বাংলাদেশ ব্লু ইকোনমি অর্থাৎ নীল অর্থনীতিতে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছে এবং উপসাগরে মাছ ধরার সমস্যা মোকাবিলায় প্রজনন মরসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার জন্য সদস্য দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ভুটান পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছে এবং নেপাল সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন ও বিমস্টেককে একটি ফলাফল-ভিত্তিক আঞ্চলিক মঞ্চে রূপান্তরিত করার জন্য তার ‘সম্পূর্ণ অঞ্চলভিত্তিক’ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। তাইল্যান্ড অপ্রচলিত নিরাপত্তা পরিসরে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে এবং মায়ানমার এই তালিকায় অনলাইন জালিয়াতির বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রয়োজনীয়তা যুক্ত করেছে। সেপ্টেম্বরের শীর্ষ সম্মেলনের আগে এই প্রস্তাবগুলি রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে পেশ করা হবে।
দ্বিপাক্ষিক গুণাবলি
রিট্রিট ভারতের জন্য একটি বহুপাক্ষিক মাইলফলক হলেও এর দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততাও বর্তমান। মাননীয় জয়শঙ্কর এই রিট্রিটের পাশাপাশি একাধিক বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি, মাদকদ্রব্য এবং মায়ানমারের সীমান্তের ওপারে অস্ত্রের প্রবাহ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ ভাগ করে নিয়েছেন এবং বেআইনি ভাবে আটক ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে একটি বৈঠক করেছেন, যিনি তাঁকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সুষ্ঠু সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে এবং তিস্তা প্রকল্পের জন্য একটি প্রযুক্তিগত দল পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন, যা এই দীর্ঘকালের অমীমাংসিত উদ্বেগ কমানোর দিকে আরো একটি পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। রিট্রিটের শেষে বিদেশমন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
এই বছরটি ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট এবং নেবারহুড ফার্স্ট নীতিগুলির এক দশক চিহ্নিত করে এবং বিমস্টেকের উপর জোর দেওয়া হল জাতীয় ও আঞ্চলিক কল্যাণের জন্য সহযোগিতামূলক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে নয়াদিল্লির প্রচেষ্টার একটি প্রকাশ। এই ভাবে জয়শঙ্কর নতুন জ্বালানি, সংস্থান এবং সহযোগিতার জন্য পুনর্নবীকৃত অঙ্গীকারের মাধ্যমে ভবিষ্যতের সহযোগিতাকে উৎসাহিত করেছেন।
এই প্রস্তাবগুলির মধ্যে কতগুলি আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে চূড়ান্ত পরিণতি পায়, তা সময়ই বলবে। তবে এই অঞ্চলের জন্য একটি সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সদস্য দেশগুলির উদ্দেশ্য রিট্রিটে স্পষ্টতই উঠে এসেছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.