Published on Nov 10, 2021 Updated 0 Hours ago

হাতের নাগালের ফলগুলো পেড়ে নেওয়া হয়েছে। আগামী দিনে আরও গভীর ও প্রভাব বিস্তারকারী সংস্কার করতে হবে সরকারের সব স্তরে — কেন্দ্র, রাজ্য ও স্থানীয়।

ভারতের নিয়ামক কোলেস্টেরোল থেকে মুক্তির জন্য ৮টি সংস্কার

এই নিবন্ধটি ‘৩০ বছর পরে: সংস্কার কর্মসূচির পর্যালোচনা ও পুনর্নবীকরণ’‌ নামক একটি সিরিজের অংশ‌।


প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসিংহ রাওয়ের ১৯৯১ সালের সংস্কারসমূহ ভারতীয় অর্থনীতির ব্যবসায়িক পরিবেশ বদলে দিলেও তা মাটির নীচের সেই স্তরকে ছুঁতে পারেনি যার উপর দাঁড়িয়ে একটা অর্থনীতি আর ও চাঙ্গা হয় বা সঙ্কুচিত হয়। গৃহীত নীতিসমূহ লাইসেন্স রাজ শেষ করলেও ইনস্পেক্টর রাজ–এর কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি। তিরিশ বছর পরেও তার বাড়বাড়ন্ত চলছে। একটা মজবুত কার্যনির্বাহী ব্যবস্থা, যার লক্ষ্য হল ফয়দা তোলা আর দুর্নীতিতে ইন্ধন দেওয়া, তার ঘাড়ে চেপে থাকা আমলাতন্ত্রের হাতে আছে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা। রাও একা এই বোঝা সরাতে পারেননি। আর তাঁর পরের প্রধানমন্ত্রীরা সংস্কার তো দূরের কথা, এই বাড়াবাড়ির দিকে নজরও দেননি। ভারতীয় অর্থনীতি এখনও অবৈধ ক্ষমতার পরিকাঠামোয় ভারাক্রান্ত, যা অর্থনৈতিক উন্নতি ও কর্মসংস্থানের গতি রোধ করে। তিন দশক ধরে সংস্কারের মাধ্যমে ভারতে ব্যবসা করার চরিত্র বদলে গেছে ঠিকই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যদি ভারতীয় অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন আনতে চান তা হলে তাঁকে এই ক্ষমতার অপব্যবহারের সমস্যার সমাধান করতে হবে, এবং এই অত্যাচার বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় স্তরে এমন সমর্থ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যা অনুসরণ করতে পারবে রাজ্যগুলো।

নিয়ামক কোলেস্টেরোলএর ৬৯,২৩৩ স্তর

এই সমস্যার পরিমাপ করতে গেলে দেখা যাবে তা সুবিশাল এবং একবিংশ শতাব্দীর ভারতে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। প্রথমে আয়তনটা দেখুন। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ৬ কোটি ৩০ লক্ষ উদ্যোগের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রের নিয়োগকর্তা মাত্র ১০ লক্ষ। দেশের ৯৮ শতাংশ নিয়োগকর্তা ইচ্ছা করেই ‘‌ক্ষুদ্র’‌। তার ফলে এঁরা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ, সুযোগ্য কর্মী, এবং প্রযুক্তি বা জোগানের শৃঙ্খলের নাগাল পান না। অন্য দিকে তাঁরা গড়ে তিনজনের কম কর্মী নিয়োগ করেন, আর তার ফলে কাম্য স্তরের চেয়ে কম কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু ‘‌ক্ষুদ্র’ থাকার ইচ্ছার একটা জোরালো যুক্তি আছে, যা টিঁকে থাকতে সাহায্য করে। কারণ এই সংস্থাগুলো চায় আইন ও বিধির নিয়ামক গণ্ডি এড়িয়ে যেতে। তা হলে ন্যূনতম মজুরি দেওয়া, সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা বা কাজের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়ার দায় ঘাড়ে চাপে না। এর কারণ এই নয় যে এরা আইনের রাজনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য এড়িয়ে যেতে চায়। কারণটা হল আইনগুলো দানবীয় এবং তা ভাঙার দায় ঘাড়ে চাপলে তা থেকে বেরনো অসম্ভব।

এই সংস্থাগুলো চায় আইন  বিধির নিয়ামক গণ্ডি এড়িয়ে যেতে। তা হলে ন্যূনতম মজুরি দেওয়াসামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা বা কাজের নিরাপদ  স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়ার দায় ঘাড়ে চাপে না।

যখনই একজন উদ্যোগপতি তাঁর সংস্থাকে বড় করতে চাইবেন এবং সেটি আয়তনে প্রসারিত হবে, তখনই তা আনুষ্ঠানিক বিধিবদ্ধ ক্ষেত্রের অংশ হয়ে যাবে। তখন তাঁকে ৪০০–র বেশি নিয়ম মানতে হবে। সংস্থা বিধিবদ্ধ হলেই রাতারাতি এগুলো চালু হয়ে যায়। ফলে আয়তন ছোট রাখার ও প্রশাসনিক স্তরে বিধিবদ্ধ না হওয়ার স্পষ্ট লাভ রয়েছে। এই বহুমাত্রিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সমস্যার শিকড় রয়েছে ভারতের পুরনো, জটিল নিয়ামকশাসিত পরিবেশের মধ্যে। আমরা এগুলোকে বলি সংস্থা বা নিয়োগকর্তার ‘‌ফরমালাইজেশন ট্যাক্স’‌। এটাই আয়তনে বড় হওয়ার প্রশ্নে সব থেকে বড় বাধা, এবং দুর্নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

নীতিগত প্রশ্নে ভারতের চ্যালেঞ্জ শুধু নতুন উদ্যোগ নিয়ে আসা নয়, একই সঙ্গে বর্তমান উদ্যোগগুলো যাতে অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পদের ক্ষেত্রে বড় হতে পারে এবং রাজনৈতিক দিক থেকে আরও কর্মসংস্থান করতে পারে তার চেষ্টা করা। নীতিপ্রণেতারা একবার এই প্রয়াস শুরু করলে, যা আমাদের চোখে অনিবার্য, রাজনৈতিক লাভ আসবে দ্রুত এবং অর্থনৈতিক লাভ বেড়ে যাবে। এগুলো হল দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির হাতের নাগালে থাকা ফল। যদি নিয়ামক পরিকাঠামো সহজ করে ৬ কোটি ৩০ লক্ষ উদ্যোগের ১০ শতাংশকে অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্র থেকে আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে তুলে আনা যায়, তা হলে ১০ কোটি আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান হতে পারে। তবে মূল বাধা হল যাকে আমরা বলি নিয়ামক কোলেস্টেরোল, যার মধ্যে আছে ১,৫৩৬ আইন, ৬৯,২৩৩ নিয়মবিধি এবং ৬,৬১৮ রকমের ফর্ম জমা দেওয়া। কোনও ব্যবসায়িক সংস্থাকে মোট এতগুলো বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়।

এই বাধার জটিল জালের সঙ্গে যুক্ত হয় আর একটা ঘটনা:‌ এইগুলো প্রশাসনিক ভাবে আশ্চর্যজনক দ্রুত গতিতে বদলে যায়। নিয়ামক বিধির পরিবর্তন হয়েছে গত মাসে ৩২২টি, গত তিন মাসে ৮৫৬টি এবং গত এক বছরে ৪,১০৪টি। ফাইল রাখা তো দূরের কথা, শুধু কী পরিবর্তন হচ্ছে তার খোঁজ রাখতেই প্রতিটি সংস্থার একটা করে অনুবর্তিতা–সেনা তৈরি করা দরকার। সমস্যাটা কী বলার পর এখানে কিছু সংস্কারের সুপারিশ করা হল যা দেশে ব্যবসা করার পথ আরও মসৃণ করবে।

মূল বাধা হল যাকে আমরা বলি নিয়ামক কোলেস্টেরোলযার মধ্যে আছে ,৫৩৬ আইন৬৯,২৩৩ নিয়মবিধি এবং ,৬১৮ রকমের ফর্ম জমা দেওয়া। কোনও ব্যবসায়িক সংস্থাকে মোট এতগুলো বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়।

এবং এই অবস্থা থেকে বেরনোর জন্য ৮টি সংস্কার

আমরা সব মিলিয়ে সংস্কারের এমন ৮টি উপনদীর সন্ধান পেয়েছি যেগুলো অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের নদীগুলিকে পুষ্ট করতে পারে এবং তার মাধ্যমে অতীতের ধ্বংসাবশেষ ধুয়ে সাফ করতে পারে। এই নিবন্ধে প্রশাসনিক পদ্ধতির পরিবর্তনের কথা যেমন বলা হয়েছে, তার পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়ানো এবং অনুবর্তিতা (‌কমপ্লায়েন্স)‌ রক্ষা ও ফাইল দাখিল করার সময় কমানোর লক্ষ্যে যুক্তি দিয়ে বোঝানো হয়েছে কেন অনুবর্তিতা ও ফাইল দাখিল করার কাজ হতে হবে কাগজহীন, উপস্থিতিহীন, নগদবিহীন এবং মুখাবয়বহীন পদ্ধতিতে।

১.‌একটি জাতীয় অনুবর্তিতা কমিশন গঠন: ভারতের নিয়ামক বিধিগুলি জরুরি ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা দরকার। অনুবর্তিতার দায় অন্তত ৫০ শতাংশ কমানোর জন্য একটি ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় অনুবর্তিতা কমিশন গঠন করতেই হবে। এই কমিশনকে নজর দিতে হবে অনুবর্তিতার প্রয়োজনীয় কাজের মধ্যে যে সব অপ্রাসঙ্গিক কাজ ও একই জিনিস বার বার করার কাজ রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা। কমিশনকে অস্পষ্টতা দূর করতে হবে, রূপায়ণের নির্দিষ্ট পথ বাতলাতে হবে, এবং নথিপত্র রাখার ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। আলাদা আলাদা আইনে দশটা আলাদা রকম ওয়েজ রেজিস্টার ও পাঁচটা আলাদা আলাদা মাস্টার রোল রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট ও সংশ্লিষ্ট নিয়মবিধিতে মোট ৯,১২৯ রকমের অনুবর্তিতার বিষয় আছে, যা দেশের মোট এমন নিয়ামক বিধির ১৩ শতাংশ। ইলেকট্রিসিটি অ্যাক্ট ও সংশ্লিষ্ট নিয়মবিধিতে মোট ৪,২৫৭ রকমের অনুবর্তিতার বিষয় আছে, যা দেশের মোট নিয়ামক বিধির ছয় শতাংশ। এই সহজ সমস্যাগুলোর সমাধান কোনও কঠিন কাজ নয়।

আলাদা আলাদা আইনে দশটা আলাদা রকম ওয়েজ রেজিস্টার  পাঁচটা আলাদা আলাদা মাস্টার রোল রাখার কোনও প্রয়োজন নেই।

২. একটা ইউনিক এন্টারপ্রাইজ নাম্বার (‌ইউইএন)‌ দেওয়া হোক: ভারতের উদ্যোগপতিদের নানা ধরনের সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে হয়, যেমন প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে এমপ্লয়িজ স্টেট ইনসিওরেন্স কর্পোরেশন, পার্মানেন্ট অ্যাকাউন্ট নাম্বার থেকে কর্পোরেট আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার, কর ছাড় ও কর সংগ্রহের অ্যাকাউন্ট নাম্বার। এগুলো দেয় বিভিন্ন রাজ্যের এজেন্সিগুলো এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের দপ্তরগুলো। সেই কারণে অভিন্ন কর্পোরেট প্রোফাইল তৈরি করা যায় না। ব্যক্তিকে যেমন আধার দেওয়া হচ্ছে সে ভাবেই ইউইএন নাম্বার দিলে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। সরকারের সব বিভাগ এবং সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই নাম্বারের ভিত্তিতে প্রত্যেকটি উদ্যোগকে নথিভুক্ত করবে। তা হলে প্রশাসন, ঋণদান, ঝুঁকি পরিমাপ ও নিয়মানুবর্তিতার প্রশ্নে একটা সামগ্রিক কর্পোরেট প্রোফাইল তৈরি হবে।

৩. এন্টারপ্রাইজ ডকুমেন্ট ভল্ট তৈরি করতে হবে: ভারতে কাজকর্ম হতে হবে কাগজবিহীন। কাগজপত্র রাখা অদক্ষতার পরিচায়ক, খরচসাপেক্ষ ‌এবং তা টেকসই নয়। যদিও সরকার অনেক কিছু ডিজিটাল করছে, এই সাধারণ বিষয়টা নীতিনির্ধারকদের নজরে পড়েনি। ইলেকট্রনিক ডকুমেন্ট ভল্ট বা ডিজিলকার–এর সাফল্যের ভিত্তিতে এখন ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোর জন্যও এই সুযোগটা নিয়ে আসতে হবে। লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন, অনুমতি, সম্মতিপত্র, নোটিস এবং এই ধরনের যা কিছু সরকারের বিভাগগুলোর তরফ থেকে একটা সংস্থাকে দেওয়া হবে, তা সবই ওই ভল্টে থাকবে। ডেটা প্রোটেকশন ল অনুযায়ী ইনস্পেক্টররা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বা সরকারের বিভিন্ন বিভাগ প্রয়োজনীয় সম্মতি নিয়ে এই ডেটা দেখতে পাবে। ইউইএন–ভিত্তিক ঋণ ও ঝুঁকি সংক্রান্ত কর্পোরেট প্রোফাইল আর ইলেকট্রনিক ডকুমেন্ট ভল্ট, এই দুটো থাকলে দলিল জাল করা ও প্রতারণা কমবে, এবং তার ফলে ঋণদানের গভীরতা বাড়বে এবং নিষ্ফলা সম্পদ (‌এনপিএ)‌ কমবে। এভাবে সংস্থাগুলোর নিয়ামক প্রোফাইল একই ধাঁচের হয়ে যাবে।

ইউইএনভিত্তিক ঋণ  ঝুঁকি সংক্রান্ত কর্পোরেট প্রোফাইল আর ইলেকট্রনিক ডকুমেন্ট ভল্টএই দুটো থাকলে দলিল জাল করা  প্রতারণা কমবেএবং তার ফলে ঋণদানের গভীরতা বাড়বে এবং নিষ্ফলা সম্পদ (‌এনপিএ)‌ কমবে।

৪. বাণিজ্যিক আদালতের পরিকাঠামো মজবুত করা: দেশের বাণিজ্যিক আদালত ব্যবস্থা ঢেলে সাজা দরকার। সিঙ্গাপুরে যেখানে বাণিজ্যিক মামলা নিষ্পত্তির জন্য ১২০ দিন লাগে, সেখানে ভারতে লাগে ১,৪৪৫ দিন। যদিও বিশ্ব ব্যাঙ্কের ব্যবসা করার স্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠিতে ভারত ৬৩তম স্থানে আছে, চুক্তির মান্যতার নিরিখে দেশের স্থান খুবই নীচে, ১৬৩তম জায়গায়। লক্ষ লক্ষ বাণিজ্যিক মামলা অন্যান্য মামলার সঙ্গে একাসনে বসে যাওয়ায় নিয়মিত আদালতে সেগুলো ওঠার অপেক্ষায় মাসের পর মাস কেটে যায়, আর ক্রমাগত দেরি হতে থাকে। সরকারকে এই ক্ষেত্রে দেশের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্রগুলোতে ধারণক্ষমতা (‌বিচারক, কর্মী, আদালতকক্ষ ও ই–হিয়ারিং) বাড়াতে হবে, যাতে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পত্তির সময় অন্তত ৫০ শতাংশ কমাতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক ডিজিটাল উদ্যোগ এক্ষেত্রে সহায়ক হবে। যারা দেরি করতে চায়, তারা অবশ্য উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রশ্নে টালবাহানা করবে। কাজেই এই ব্যবস্থা তৈরিতে পাশে থাকতে হবে বিচার বিভাগকে, যা অর্থনীতির অঙ্গ না–হয়েও অর্থনীতিকে সব থেকে বেশি আঘাত করে অতীতকে আঁকড়ে থাকা ও দেশের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে অনীহার কারণে।

৫. অনুবর্তিতা পরিচালন ডিজিটাইজ করতে হবে: ‌স‌ব অনুবর্তিতা ফাইলিং সংক্রান্ত কাজ ডিজিটাল করতে হবে। এখন একটা ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট খুলতে হলে একজন উদ্যোগপতিকে ৭০–এর বেশি বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন ও অনুমোদনের (সত্তা, জমি, ব্যবসা, নির্মাণ, আগুনের থেকে সুরক্ষা, বিদ্যুৎ, শ্রমিক, পরিবেশ, ওজন ও পরিমাপ ইত্যাদি সংক্রান্ত)‌ জন্য অপেক্ষা করতে হয় । একটা এমএসএমই (‌অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ)‌–কে প্রতি বছর অন্তত ৪০০ অনুবর্তিতা সংক্রান্ত নথি জমা করে যেতে হয়। আর পুরো পদ্ধতিটা হল কায়িক, কাগজ–নির্ভর, এবং এর জন্য সরকারি অফিসারদের কাছে যেতে হয়। ফলে বিলম্ব ও দুর্নীতির রাস্তা খুলে যায়। অনুবর্তিতা সংক্রান্ত সব কাজ হতে হবে ডিজিটাল, উপস্থিতিহীন, নগদবিহীন ও মুখাবয়বহীন পদ্ধতিতে। এর ফলে স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও সময়ানুবর্তিতা বাড়বে। সরকারকে ভাবতে হবে একটা জন–উপযোগ (পাবলিক ইউটিলিটি)‌ সৃষ্টির কথা, যা অনুবর্তিতা সংক্রান্ত সব কিছু ডিজিটাইজ করে রাখার জন্য প্রকাশ করবে এপিআই (‌অ্যাপলিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস, একটি সফটঅয়্যার যা দু’‌টি অ্যাপলিকেশনের মধ্যে সংলাপের সুযোগ করে দেয়)‌। বেসরকারি অ্যাপ প্রোভাইডারদের একটি সজীব ব্যবস্থা এই এপিআই–গুলো ব্যবহার করতে পারবে।

৬. নিয়ামক সংক্রান্ত নতুন তথ্যাদি ডিজিটাইজ করা:‌ দেশের ব্যবসায়িক উদ্যোগকে প্রভাবিত করে বছরে এমন ৪ হজারের বেশি নিয়ামক বিধি সংক্রান্ত পরিবর্তন করা হলে প্রয়োজন একটা ভান্ডারের যেখানে সব নতুন তথ্য থাকবে। এখন কেন্দ্র, রাজ্য ও পুর পর্যায়ের ২,২৩৩টি ওয়েবসাইটে এই তথ্য দেওয়া হয়। এই পরিবর্তনগুলো ব্যবসায়িক উদ্যোগের আবশ্যক কাজকর্মকে প্রভাবিত করে, কারণ এগুলোর মাধ্যমে তথ্য, শুল্ক কাঠামো, পেনাল্টি, তারিখ পরিবর্তন, ফর্ম–এর রদবদল ও হিসাব কষার পদ্ধতি ইত্যাদির নানা পরিবর্তন সূচিত করা হয়। এখন উদ্যোগপতিদের দায়িত্ব হল নিয়মিত ওয়েবসাইটগুলো দেখা, কী পরিবর্তন হয়েছে তা লক্ষ করা ও বিষয়টা তাঁর সংশ্লিষ্ট কি না তার মূল্যায়ন করা। সরকারের উচিত একটা কেন্দ্রীয় ভান্ডার বা ইলেকট্রনিক গেজেট তৈরি করা যেখানে উদ্যোগপতিদের প্রভাবিত করে এমন সব নিয়ামক সংক্রান্ত পরিবর্তন সূচিত হবে। সেখানে নোটিস দিতে হবে এমন ভাবে যাতে সেটির সংশ্লিষ্ট শিল্প, মন্ত্রক, বিভাগ, রাজ্য, ধরন সব কিছুর স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ থাকে। এটি এমন হতে হবে যা সার্চ করা সহজ, ব্যবহারকারীর পক্ষে সুবিধাজনক এবং মেশিন পাঠযোগ্য।

৭. ইনস্পেকশন ব্যবস্থাকে ডিজিটাইজ করা:‌ ভারতে একটা এমএসএমই যে কোনও সময় ২০ জন পর্যন্ত ইনস্পেকটরের পর্যবেক্ষণের সম্মুখীন হতে পারে। একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে কেরলের কাইটেক্স গ্রুপের কথা বলা যায়, যারা এক মাসে ১১ জন ইনস্পেকটরের তল্লাশির মুখোমুখি হয়েছিল। তারপর সংস্থাটি ব্যবসা তেলেঙ্গানায় নিয়ে চলে গিয়েছিল। এখনকার ইনস্পেকশন ব্যবস্থা কায়িক, কাগজ–নির্ভর এবং এর জন্য মুখোমুখি যোগাযোগের প্রয়োজন হয়। এই ইনস্পেকটর রাজ–এর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে সেগুলোকে বদলে একটা সংহত, ঝুঁকি–নির্ভর ডিজিটাল ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন।

৮. সেল্ফ সার্টিফিকেশন বা থার্ড পার্টি সার্টিফিকেশন চালু করা দরকার: অনুবর্তিতা ব্যবস্থাদি মানতে বাধ্য করতে হলে সরকারের নিয়ামক সামর্থ্য প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যের কথা হল এখন সরকারের যে সামর্থ্য আছে তা শিল্পের প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। এই পরিষেবার চাহিদা যত বাড়ছে সেই অনুযায়ী সরকারি বিভাগগুলির সামর্থ্য বাড়ছে না। ফলে সরকারি এজেন্সিগুলি অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত ভাবে বিলম্বের কারণ হচ্ছে এবং অসাধু উদ্দেশ্যে চাপ তৈরির সুযোগ করে দিচ্ছে। একজন উদ্যোগপতিকে রেজিস্ট্রেশন, পারমিট, ইনস্পেকশন, ভেরিফিকেশন, সার্টিফিকেশন ও নো–অবজেকশন সার্টিফিকেটের জন্য অনেকগুলি এজেন্সির মুখোমুখি হতে হয়, যেমন জেনারেটর বসানোর জন্য ইনস্পেকশন ও সার্টিফিকেশনের জন্য একজন ইলেকট্রিকাল ইনস্পেক্টর, লিফ্‌ট বসানোর পর ইনস্পেকশন ও সার্টিফিকেশনের জন্য আর একজন ইনস্পেক্টর, বাড়ি ও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থার ইনস্পেকশন ও সার্টিফিকেশনের জন্য ফায়ার ইনস্পেক্টর, ওজনের যন্ত্রপাতির সার্টিফিকেশনের জন্য লিগাল মেট্রোলজি অফিসার, ইত্যাদি। এখন জরুরি ভিত্তিতে সামর্থ্য বাড়ানো প্রয়োজন পিপিপি (‌সরকারি–বেসরকারি অংশীদারি)‌ মডেলে, ঠিক যেমনটা করা হয়েছে মোটর ভেহিকল্‌স আইনে পিইউসি (‌পলিউশন আন্ডার কনট্রোল)‌ সার্টিফিকেশনের জন্য। সরকারের উচিত সেল্ফ সার্টিফিকেশন, থার্ড পার্টি সার্টিফিকেশন এবং প্যানেলভুক্ত ভেন্ডরদের দিয়ে সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করা। তা করা হলে নিয়ম মানতে বাধ্য করার ক্ষমতাও বাড়বে এবং জন–সুবিধাও উন্নততর হবে।

সরকারের উচিত একটা কেন্দ্রীয় ভান্ডার বা ইলেকট্রনিক গেজেট তৈরি করা যেখানে উদ্যোগপতিদের প্রভাবিত করে এমন সব নিয়ামক সংক্রান্ত পরিবর্তন সূচিত হবে।

ব্যবসার স্বাচ্ছন্দের দিক থেকে গত ছ’‌বছর ছিল খুবই ভাল। এই ক্ষেত্রে ভারতের র‌্যাঙ্কিং আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। ২০১৪ সালে ভারত ছিল ১৪২তম স্থানে, আর ২০১৯ সালে উঠে এসেছে ৬৩তম স্থানে। হাতের কাছের ফলগুলো পেড়ে নেওয়া হয়েছে। সামনের দিনে আরও গভীর ও আরও প্রভাব বিস্তারকারী সংস্কার করতে হবে সরকারের সব স্তরে—কেন্দ্র, রাজ্য ও স্থানীয়। এই সংস্কারগুলোর জন্য প্রয়োজন আরও কড়া সিদ্ধান্ত, লক্ষে স্থির থাকা, এবং আরও সম্পদের বরাদ্দ। কোভিড সঙ্কটের কাঁধে ভর দিয়ে মধ্যপ্রদেশ এই পথে যাত্রা শুরু করেছে, আর উত্তরপ্রদেশ শুরু করার চেষ্টা করছে;‌ তামিলনাড়ু ও তেলেঙ্গানা রওনা হয়ে গিয়েছে;‌ বাকি রাজ্যগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল, কেন্দ্রীয় সরকারের মাথা হিসেবে ও সংসদে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী হওয়ার কারণে নিয়ামক সংস্কারের (‌যাকে বলা যায় তৃতীয় স্তরের সংস্কার)‌ প্রয়োজনীয় কাজগুলো শুরু করতে হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দলকে।

১৯৯১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তার ফলে ভারতের অনেকটা ভাল হয়েছে:‌ ১৯৯০ সালে ভারত পৃথিবীর ১০টা বড় অর্থনীতির মধ্যে ছিল না;‌ ২০২১–এ ভারত পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। এই দশকের মধ্যেই ভারত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ও বছর বারোর মধ্যে ১০ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতি হয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশিত। এই সংখ্যাগুলোর মধ্যে দুটো স্পষ্ট কিন্তু অসংলগ্ন ধারণা জড়িত আছে। একদিকে আছে প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা;‌ আর অন্য দিকে আছে কাজের সুযোগ, কর ও সম্পদ সৃষ্টির প্রয়োজন। এই দুটোকে যুক্ত করার সহজ ও আশু উপায় হল নিয়ামক ক্ষেত্রের সংস্কারগুলো শুরু করা।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Authors

Gautam Chikermane

Gautam Chikermane

Gautam Chikermane is a Vice President at ORF. His areas of research are economics, politics and foreign policy. A Jefferson Fellow (Fall 2001) at the East-West ...

Read More +
Rishi Agrawal

Rishi Agrawal

Rishi Agrawal is co-founder and CEO at Avantis RegTech.

Read More +