Published on Nov 27, 2021 Updated 0 Hours ago

সমাজতন্ত্র যে একটা ব্যর্থ দর্শন তা স্পষ্ট হয়ে গেলেও ভারতের সংবিধান সব অনুচ্ছেদের মুখবন্ধ হিসেবে তাকেই ধরে রেখেছে। সম্ভবত এটাই গণতন্ত্রের প্রকৃতি — একজন যখন পরিবর্তনের জন্য অধৈর্য, অন্যজন তখন অনড়। এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, এবং এখনও দাঁড়িয়ে আছেন, ভারতের সংস্কারকেরা।

ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার পর্যবেক্ষণের ৮টি জানলা:‌ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

এই নিবন্ধটি ‘‌৩০ বছর পরে:‌ সংস্কার কর্মসূচির পর্যালোচনা ও পুনর্নবীকরণ’ নামক একটি সিরিজের অংশ।


৮৯ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের একটা অর্থনীতি ইউ–টার্ন নেয় কী ভাবে?‌ ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও যত পরিবর্তন নিয়ে এলেন, তার প্রেক্ষাপটে ছিল ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির একটা গলাপচা বাস্তুতন্ত্র, ঘুষখোর ইন্সপেক্টররা, গেঁড়ে বসে থাকা ব্যবসাবাণিজ্য, যেগুলো সব কিছু মিলে তৈরি করেছিল কায়েমি স্বার্থের একটা ‘‌সিস্টেম’‌। এর মুখপাত্র ছিল বম্বে ক্লাব, যেটাকে ভেঙে ফেলার দরকার ছিল। একদিকে ছিল নতুন উদ্যোগপতিদের নেতৃত্বে নতুন অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রাজনীতির উদয়, আর মাঝখানে ছিল সুযোগের সমুদ্র। ১৯৯১ সালের শিল্পনীতি সংক্রান্ত বিবৃতির প্রতিটি ধারার মধ্যে যদি লক্ষ লক্ষ না–ও হয়, অন্তত হাজার হাজার অতীতের অচলতার মধ্যে ডুবে–থাকা মানুষের জন্য ছিল নানা সুবিধার প্রকরণ। এঁদের অনেকেরই ছিল অর্থশক্তি — শুধু মুষ্টিমেয় শিল্পপতির নয়, সেই সঙ্গেই আমলাতন্ত্রের, রাজনীতিকদের, ‘‌সিস্টেম’‌–এর। ভারত এই পরিবর্তনটা এনেছিল কী ভাবে?‌ এই প্রবন্ধে সেই ঘটনাটা দেখা হয়েছে আটটি জানলা দিয়ে, এবং তুলে ধরা হয়েছে অর্থনীতির সচল অংশগুলি ও তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া। আর তার মধ্যে দিয়ে গত তিরিশ বছরের ঘটনাবলি যেমন খতিয়ে দেখা হয়েছে, তেমনই সামনের দিনে কী আছে তার পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছে।

১. ভবিষ্যৎ হিসেবে ইতিহাস

প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের অপরিবর্তিত অঙ্গ হিসেবে থাকে প্রতিবাদ। তিরিশ বছর আগে প্রতিবাদ ছিল আর্থিক, এবং তা সামনে এসেছিল ১৯৯৩ সালে বম্বে ক্লাবের মাধ্যমে। সে সময় বাজাজ অটোর প্রধান রাহুল বাজাজের নেতৃত্বে কায়েমি বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতিভূ একটি গোষ্ঠী শিল্পনীতির বিরোধিতা করেছিল। তারা রাজনৈতিক সমর্থন পেল না, এবং ধীরে ধীরে তাদের দম ফুরিয়ে গেল। তারপর প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সংস্কারের হুড়োহুড়ির সময় রাহুল বাজাজ হেরে গেলেন, কিন্তু তাঁর বাজাজ অটো জিতে গেল। রাও শিল্পের ক্ষেত্রে যা করেছিলেন ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তা করেছেন কৃষির ক্ষেত্রে। কৃষি হল এমন একটি ক্ষেত্র যা ১৯৯১ সালে সংস্কার প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ে গেছিল। তিনটে কৃষি আইন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এখন যাঁরা বিরোধিতা করছেন সেই ধনী কৃষক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের শুধু টাকাই নেই, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সমর্থনও আছে। রাতারাতি, কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েতের রাজনীতি হেরে যাবে, কিন্তু টিকায়েত সহ লক্ষ লক্ষ কৃষক জিতবেন।

তিনটে কৃষি আইন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এখন যাঁরা বিরোধিতা করছেন সেই ধনী কৃষক  মধ্যস্বত্বভোগীদের শুধু টাকাই নেইসেই সঙ্গে রাজনৈতিক সমর্থনও আছে।

২. ওজন হিসেবে রাজনীতি

পি ভি নরসিংহ রাও থেকে নরেন্দ্র মোদী, পরপর পাঁচ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ছয়টি সরকার নয়টি মেয়াদে তাদের রাজনৈতিক কথন বদলে ফেলে নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতার পথে হেঁটেছে। অর্থনৈতিক সংস্কারে নানা ধরনের স্বাক্ষর দেশের অর্থনীতির দাবি সম্পর্কে আমাদের একটা অন্তর্দৃষ্টি দেয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল রাজনৈতিক ভাবে। বিতর্কসাপেক্ষে, রাজনীতিকরা হলেন এই গ্রহের সব থেকে অভিযোজন–সক্ষম প্রাণী, যাঁরা দ্রুত বুঝে নেন ভোটাররা কী চাইছেন, এবং সেই অনুযায়ী পরিবর্তিত পটের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেন। রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল হাইওয়েজ অথরিটি অফ ইন্ডিয়া তৈরি করেন, অটলবিহারী বাজপেয়ী তার ক্ষমতায়ন করেন, মনমোহন সিংহ আরও ওজন যুক্ত করেন, আর নরেন্দ্র মোদী বিশাল সংখ্যায় তার ফল প্রদান করছেন। সব সময়েই রাজনীতিকরা সেগুলোই পৌঁছে দিচ্ছেন যা মানুষ চায় — জাতীয় ও রাজ্য সড়ক, শহর ও গ্রামের মধ্যে সংযোগকারী রাস্তা। বিভিন্ন ক্ষেত্র, শিল্প ও ভৌগোলিক অঞ্চলব্যাপী এই প্রবণতা চলতেই থাকবে।

৩. নৈতিক শক্তি হিসেবে দর্শন

জরুরি অবস্থার সময় ১৯৭৬ সালে সংবিধানের মুখবন্ধে ‌‘‌সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হল — এ ছিল এমন একটা সংশোধনী যার মধ্যে আশ্চর্য ভাবে বিচারবিভাগ স্বপরিকল্পিত, স্বঘোষিত, এবং কখনও কখনও স্বীয় উদ্দেশ্যসাধনে লিপ্ত ‘‌মূল কাঠামো’‌র থেকে কোনও বিচ্যুতি দেখতে পায়নি — এবং ভারত নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলল সেই ব্যবস্থায় যাকে প্রথমে বলা হত ‘‌সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ’‌, কিন্তু পরে যা সাংবিধানিক বন্ধনে পরিণত হল। এই শব্দটি ঢুকিয়ে দেওয়াটা ছিল একটা চক্রাকার গতি, সরকারের কার্যনির্বাহী শাখা নিয়ন্ত্রিত যোজনা কমিশন থেকে কার্যনির্বাহী শাখা নিয়ন্ত্রিত ১৯৫৬–র শিল্পনীতি প্রস্তাব থেকে কার্যনির্বাহী শাখা নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে কার্যনির্বাহী শাখা দ্বারা চালিত কিন্তু আইনসভা নিয়ন্ত্রিত সংসদ, যা তৎকালীন বিচারবিভাগের আশীর্বাদধন্য ছিল। পি ভি নরসিংহ রাও অধুনা–ক্ষয়িত সেই দর্শনের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজও তার অক্টোপাসের মতো আকর্ষ জড়িয়ে রাখে নীতিনির্ধারক মনকে। ভারতের নীতিনির্ধারক মহলে ধনতন্ত্র এখনও পতিত জমিতেই পড়ে আছে, আর মূলগত ভাবে ভারত এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা পরীক্ষানিরীক্ষার জায়গা যেখানে সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র এই দুই দর্শনের ট্যাঙ্গো নাচ চলছে সমকেন্দ্রীক বৃত্তে, আর মানুষ অপেক্ষা করে আছেন সমৃদ্ধির ভরতনাট্যমের জন্য। বিনিয়োগ থেকে শুরু করে যোগাযোগ, ভ্রমণ ও সুযোগের ক্ষেত্রে বাজার নাগরিকদের কাছে বিশাল মূল্য পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু যত বার আমরা সংবিধান হাতে তুলে নিই, একটা বাতিল–হয়ে–যাওয়া চিন্তনশাখা ও ‘‌সমাজতান্ত্রিক’‌ শব্দটি আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, আমাদের ভারতীয়ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে, এবং আমাদের সম্ভাব্য সমৃদ্ধির গতি রোধ করে। একে বদলানো দরকার এবং ভারতের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ছন্দোবদ্ধ করা দরকার।

ভারতের নীতিনির্ধারক মহলে ধনতন্ত্র এখনও পতিত জমিতেই পড়ে আছেআর মূলগত ভাবে ভারত এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা পরীক্ষানিরীক্ষার জায়গা যেখানে সমাজতন্ত্র  ধনতন্ত্র এই দুই দর্শনের ট্যাঙ্গো নাচ চলছে সমকেন্দ্রীক বৃত্তেআর মানুষ অপেক্ষা করে আছেন সমৃদ্ধির ভরতনাট্যমের জন্য।

৪. কৌশলগত সক্রিয়তা হিসেবে গতিবেগ

বিগ ব্যাং সংস্কার যা ১৯৯১–এর প্রয়াসকে শক্তিশালী করছে, না পরের তিরিশ বছরে যে শনৈঃ শনৈঃ গতিতে কাজ চলছে, কোনটা ঠিক তা নিয়ে এই ২০২১–এও বিতর্ক চলছে। দুটোই ফলপ্রসূ হয়েছে। ১৯৯১–এর শিল্প নীতি সংক্রান্ত বিবৃতি যেমন আর্থিক নীতির ভিতটাকে নতুন করে গড়ে তুলল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা বা বাড়ানো বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ায় রাষ্ট্রের খবরদারি বন্ধ করল, তেমনই পরবর্তী সংস্কারগুলিতে দুটো পথেরই মিশ্রণ ছিল। বিভিন্ন সরকারের সময়ে ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ আয়কর কমানো বা ফলপ্রসূ নিয়ন্ত্রক বসানো (‌মূলধনী বাজারে পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সময়, বিমা ও পেনশনে অটল বিহারী বাজপেয়ীর এবং রিয়েল এস্টেটে নরেন্দ্র মোদীর সময়), এ সবই ‌হল ধীরে ধীরে চলার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক, এবং তার ফলও হয়েছে মিশ্র। পণ্য ও পরিষেবা কর (‌জিএসটি)‌ বা কৃষি আইনগুলি হল দশকের পর দশক ধরে ধীরে চলার যুক্তি এবং আইনের মাধ্যমে তার কার্যনির্বাহী পরিসমাপ্তির মিশ্রণ। অন্য দিকে এই গতিবেগ বর্ণচ্ছটার অন্য প্রান্তে আছে মনমোহন সিংহের মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম যা আইনে পরিণত হয়ে কোটি কোটি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা দিয়েছে, এবং নরেন্দ্র মোদীর জনধন যোজনা যা রাতারাতি ৩০ কোটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে সম্পর্কহীন নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। কোনটা বেশি কাজের পন্থা তা স্থির করা কঠিন। অর্থনীতিবিদরা হয়তো বিগ ব্যাং চাইতে পারেন, কিন্তু রাজনীতির প্রয়োজন ধীরে চলার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কথাবার্তা চালানো। অন্য দিকে ধীরে চলার জন্য বেছে নেওয়া নীতিগুলো নিয়ে আলোচনা চলতে পারে অনন্তকাল, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ভারতের প্রয়োজন তৎপর নীতিগত সিদ্ধান্ত। এই মুহূর্তে তৎপরতা দূরাগত স্বপ্ন হয়ে গিয়েছে;‌ কিন্তু চলতি অতিমারি ও তার ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর ভারতের রাজনীতিই হয়তো নতুন বৃদ্ধির কক্ষপথে পৌঁছে দেবে।

এই মুহূর্তে তৎপরতা দূরাগত স্বপ্ন হয়ে গিয়েছে;‌ কিন্তু চলতি অতিমারি ও তার ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর ভারতের রাজনীতিই হয়তো নতুন বৃদ্ধির কক্ষপথে পৌঁছে দেবে।

৫. ভূগোল যখন খেলার মাঠ

১৯৯১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংস্কারের কাহিনিতে মুখ্য ভূমিকা ছিল কেন্দ্রের। ১৯৯১ সালে বিলগ্নীকরণের সূচনা করা (‌প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বে) ও ২০০৩ সালের ফিসকাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (‌অটল বিহারী বাজপেয়ীর সময়) থেকে ১৯৯৭ সালে ত্রিস্তরীয় ১০–২০–৩০ শতাংশ আয়কর হার (দেব গৌড়ার সময়)‌, এবং ২০১৬ সালের ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্‌টসি ‌কোড (‌নরেন্দ্র মোদীর সময়), সংস্কারের ভূগোলে মুখ্য হয়ে থাকে কেন্দ্র। কিন্তু এখন সংস্কার চলে যাবে রাজ্যের হাতে, বা হবে কেন্দ্র–রাজ্যের যৌথ প্রয়াসে। যেমন নরেন্দ্র মোদীর আনা পণ্য ও পরিষেবা কর (‌জিএসটি)‌ এমন একটা সংস্কার যার জন্য চার দশক অপেক্ষা করা হয়েছিল, এবং কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে করের হার নিয়ে দড়ি–টানাটানি চললেও জিএসটি কাউন্সিলের মাধ্যমে তা এখন সংযুক্ত শাসন–ভারসাম্যের মডেল হয়ে উঠেছে। একই ভাবে কৃষি আইনগুলি, যা এখন স্থগিত রাখা হয়েছে, কেন্দ্র অনুমোদন করালেও মান্ডি স্তরে সেগুলো রূপায়ণের দায়িত্ব রয়েছে রাজ্যের হাতে। সামনের দিনে ক্রমশ বেশি করে সংস্কারের ক্ষেত্র সরে যাবে রাজ্যগুলোর কাছে। এমনটাই ঘটেছে অতিমারির সময়, যখন মধ্যপ্রদেশ ব্যবসার স্বাচ্ছন্দ্য‌ বাড়িয়েছে আর তেলেঙ্গানা উদ্যোগপতিদের আকর্ষণ করতে মরিয়া প্রয়াস শুরু করেছে। ভারতকে ১০ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্র হয়ে উঠতে হলে দেশের চারটে রাজ্যকে হতে হবে ইন্দোনেশিয়া, অর্থাৎ লক্ষ কোটি ডলার সমৃদ্ধ:‌ মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ ও কর্নাটক, আর এদের খুব কাছাকাছি থাকবে গুজরাত ও পশ্চিমবঙ্গ। এই জায়গায় সংস্কার ভারতীয় অর্থনীতির ওজন বাড়াবে।

কৃষি আইনগুলিযা এখন স্থগিত রাখা হয়েছেকেন্দ্র অনুমোদন করালেও মান্ডি স্তরে সেগুলো রূপায়ণের দায়িত্ব রয়েছে রাজ্যের হাতে।

৬. সক্ষম করার অস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলি

ভারত যেখানে এসেছে সেখানে পৌঁছতে পারত না প্রতিষ্ঠানগুলির পরিবর্তন ছাড়া। একটা বড় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন হল সরকারি নিয়ন্ত্রণের জায়গায় সরকার নিযুক্ত স্বাধীন নিয়ন্ত্রকদের নিয়ে আসা। ১৯৯১–২০২১–এর মধ্যে ভারত দেখেছে অনেকগুলি নতুন নিয়ন্ত্রকের সৃষ্টি:‌ ১৯৯২ সালে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া, ১৯৯৭ সালে টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, ১৯৯৯ সালে ইনসিওরেন্স রেগুলেটরি ডেভলপমেন্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, ২০০২ সালে কম্পিটিশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া, এবং ২০০৩ সালে পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া। অন্য যে বড় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো হয়েছে তা হল কেন্দ্র–রাজ্য পর্যায়ে জিএসটি কাউন্সিল, আর রাজ্যগুলোতে রিয়েল এস্টেট নিয়ন্ত্রক। আরও এগিয়ে এবার ভাবতে হবে ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়ে। যেমন শিল্প–নির্দিষ্ট কাঠামোগুলোর পরিবর্তে উপভোক্তা–তাড়িত প্রয়োজনের দিকে এগনো:‌ মিউচুয়াল ফান্ড, বিমা ও পেনশন ফান্ডগুলোর প্রতিটির আলাদা ফান্ড ম্যানেজারের বদলে পেশাদার অ্যাসেট ম্যানেজার। একই ভাবে রাজ্যগুলি যেমন এখন তাদের সীমানার মধ্যে সংস্কারের চেষ্টা করবে, তেমনই পুঁজি যেখানে খুশি যাবে। ফলস্বরূপ রাজ্যগুলোকে নিজেদের আরও বেশি প্রতিযোগী করে তুলতে সম্পদ, অনুবর্তিতা, ফাইলিং ও বাজারের প্যাকেজ তৈরির উপযোগী বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। আমরা জানি না এই প্রয়াস রাজ্যগুলোকে কোথায় নিয়ে যাবে, তবে তামিলনাড়ুর সম্প্রতি নিযুক্ত অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ সঠিক লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ। আর যে দুটি বড় পরিবর্তন প্রয়োজন তা হল উদ্যোগপতিদের দৈনন্দিন হয়রানি রুখতে প্রশাসনিক সংস্কার এবং চুক্তিবিবাদ দ্রুত মেটাতে বিচারবিভাগীয় সংস্কার। এই দুটোই সংস্কারের লেখচিত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে। বাধার পরিবর্তে সক্ষমতাদায়ী হয়ে উঠে নতুন প্রতিষ্ঠানগুলিকে নতুন ভারতের গতি ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে।

আর যে দুটি বড় পরিবর্তন দরকার তা হল উদ্যোগপতিদের দৈনন্দিন হয়রানি রুখতে প্রশাসনিক সংস্কার এবং চুক্তিবিবাদ দ্রুত মেটাতে বিচারবিভাগীয় সংস্কার। এই দুটোই সংস্কারের লেখচিত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে।

৭. চালক হিসেবে ভূরাজনীতি

একবিংশ শতাব্দী চিন নামক এক দুর্বৃত্তের উত্থান দেখেছে। এখনও পর্যন্ত সুপ্ত থাকার পর অর্থনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি, সরকারি সক্রিয়তার নিয়ন্ত্রণে সক্ষম, এবং অভূতপূর্ব আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে পৃথিবীতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় স্পষ্টতই আগ্রহী ভারতকে আগের থেকে বৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে। বেজিংয়ের আগ্রাসী উচ্চাকাঙ্ক্ষা যখন একের পরে এক ক্ষেত্রে, একের পর এক দেশে বাধা পাচ্ছে, সে সময় বিশ্বের প্রয়োজন নতুন বাজার, নতুন উপভোক্তা, নতুন উৎপাদন, নতুন সরবরাহ শৃঙ্খল। সভ্য দেশগুলির সমিতিতে পুনর্বিন্যাস ঘটছে। ভারত ভৌগোলিক ভাবে (‌বর্ধিষ্ণু ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থানের কারণে)‌ ও রাজনৈতিক ভাবে (‌চিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের গণতান্ত্রিক প্রতিপক্ষ হিসেবে)‌ নিরাপত্তা, শান্তি ও বাণিজ্যের সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি বৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। এর জন্য প্রথমে প্রয়োজন শক্তিশালী অর্থনীতি। সব পূর্বাভাস অনুযায়ী ভারত বছর বারোর মধ্যে ১০ লক্ষ মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্র হয়ে উঠবে। কিন্তু সেখানে পৌঁছতে হলে কিছু কাজ করতে হবে। যা সেখানে পৌঁছে দেবে তার একটা উপায় হল আরও অর্থনৈতিক সংস্কার। যে শীঘ্রই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে সেই ভারতের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া নতুন পৃথিবী যেমন তৈরি হবে না, তেমনই এটাও সত্য যে সংস্কারই আমাদের অভীষ্টে পৌঁছে দেবে, কল্পনাবিলাস নয়।

৮. পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে উৎসাহদান

গত তিরিশ বছরে সংস্কারের রূপান্তর ঘটেছে, বাধা ও দ্বিধার দ্বারা চালিত হওয়ার পরিবর্তে তা হয়ে উঠেছে বিশ্বাস ও পছন্দের বিষয়। ১৯৯১ সালে পি ভি নরসিংহ রাও যে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেছিলেন তা ঘটেছিল সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আয়ব্যয়ের ভারসাম্যের সঙ্কটের কারণে। সোনা বিক্রি সহ সব বিকল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পর সব দিক ভেবেচিন্তে সরকার শুধু সঙ্কটমুক্তির পথেরই সংস্কার করল না, সেই সঙ্গে সঙ্কটটিকেই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুযোগে পরিণত করল। পরের পর প্রধানমন্ত্রীরা সংস্কারের পথেই হাঁটলেন। সবগুলো নিশ্চয়ই সফল হয়নি। সঙ্কট ও তার সদর্থক পরিণতি একটি প্রয়োজনীয় শর্ত, কিন্তু যথেষ্ট শর্ত নয়। রাজনৈতিক স্থায়িত্ব অতীতের মতোই এখনও সংস্কারের অতি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। পি ভি নরসিংহ রাও‌, অটল বিহারী বাজপেয়ী ও মনমোহন সিংহের মতো কিছু নেতা জোটও চালিয়েছেন, সংস্কারও করেছেন। এখনকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপর জোটের চাপ নেই। তিনি বিশ্বাসের দ্বারা চালিত হয়ে সংস্কার করছেন। রাজ্যগুলোর ভোট অবশ্যই কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করে। তবে সব মিলিয়ে মোদী তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে আরও বেশি অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস ও রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে এগোচ্ছেন। চ্যালেঞ্জের ধরনধারণ কিন্তু বদলে গেছে। ১৯৯১–এ ভারত সঙ্কটের মোকাবিলা করেছিল;‌ আর এখন ২০২১–এ করছে সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষার। কাজেই বিপদকে প্রতিস্থাপিত করছে উৎসাহদান।

এখনকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপর জোটের চাপ নেই। তিনি বিশ্বাসের দ্বারা চালিত হয়ে সংস্কার করছেন। রাজ্যগুলোর ভোট অবশ্যই কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করে। তবে সব মিলিয়ে মোদী তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে আরও বেশি অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস  রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে এগোচ্ছেন।

এই আটটি জানলা একত্র করলে আমরা শুধু প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গির — ইতিহাস থেকে ভূরাজনীতি হয়ে গতিবেগ বা দর্শনের — জটিলতা বুঝতেই সক্ষম হব না, সেই সঙ্গেই বুঝতে পারব তারা কী ভাবে অ্যামিবার মতো একত্র হয়ে একে অন্যকে প্রভাবিত করে। সবটা একই সঙ্গে ঘটে। এ যেন ধারণা, ঘটনা ও জাড্যের ক্ষেত্রে নিজেকেই–শক্তি–জোগানো অবিরত–চলা এক ব্রাউনিয়ান মোশান:‌ সবাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন গতিতে চলেছে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে। চিনের উত্থানের অর্থ এক মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের উত্থান। নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো এত ধীর গতিতে আসছে যা পরিবর্তনের জন্য সমাজের ব্যাপক চাহিদাকে পেছন থেকে টেনে ধরছে। সমাজতন্ত্র যে একটা ব্যর্থ দর্শন তা স্পষ্ট হয়ে গেলেও ভারতের সংবিধান সব অনুচ্ছেদের মুখবন্ধ হিসেবে তাকেই ধরে রেখেছে। সম্ভবত এটাই গণতন্ত্রের প্রকৃতি — একজন যখন পরিবর্তনের জন্য অধৈর্য, অন্যজন তখন অনড়। এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, এবং এখনও দাঁড়িয়ে আছেন ভারতের সংস্কারকেরা। তাঁরা কী ভাবে পরের পর নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে, একটি সময়ে একটি নীতি নিয়ে এগিয়ে ভারতকে একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝির মধ্যে ২০,০০০ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশে পরিণত করতে রাজনীতি ও অর্থনীতির মোকাবিলা করেন সেটাই দেখার, কারণ সেটাই সংস্কারের ধরনধারণ নির্দিষ্ট করে দেবে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.