প্রধানমন্ত্রী মোদী সবেমাত্র ফ্রান্সে দুদিনের সফর শেষ করেছেন, যেখানে তিনি ফ্রান্সের বাস্তিল ডে প্যারেডে অতিথি ছিলেন। এটি একটি বিরল সম্মান, কারণ প্রতি বছর কুচকাওয়াজে বিদেশি প্রধান অতিথি থাকেন না — শেষবার ২০১৮ সালে সম্মানিত অতিথি ছিলেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং। এটি ফ্রান্সে মোদীর পঞ্চম সফর, এবং ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ নিজেই তাঁকে চারবার আতিথ্য দিয়েছেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় এই অংশীদারিকে দুই দেশ কতটা গুরুত্ব দেয়। মোদী–ম্যাক্রোঁর ‘ব্রোম্যান্স’ এখানে সম্পূর্ণভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল, তবে এই সফরটির প্রতীকী গুরুত্ব যতটা ছিল, প্রকৃত অর্জনও ততটাই।
শক্তি রূপান্তরের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা পুরোদমে চলছে। এক্ষেত্রে ২০১৫ সালে দুটি দেশ আন্তর্জাতিক সৌর জোট চালু করেছিল, যা ১০০র মতো দেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
এই বহুমুখী অংশীদারিত্বে সহযোগিতা বিস্তৃত রয়েছে প্রতিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, শক্তির রূপান্তর, মহাকাশ সহযোগিতা, নীল অর্থনীতি, বহুপাক্ষিকতা এবং এমনকি সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ–সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ফ্রান্স রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী আসনের ধারাবাহিক সমর্থক। এটি রাষ্ট্রপুঞ্জের পাশাপাশি ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)–এর মতো সংস্থাগুলিতে কাশ্মীর ও সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে ভারতের অবস্থানকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছে। শক্তি রূপান্তরের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা পুরোদমে চলছে। এক্ষেত্রে ২০১৫ সালে দুটি দেশ আন্তর্জাতিক সৌর জোট চালু করেছিল, যা ১০০র মতো দেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
কেন্দ্রে নিরাপত্তা সহযোগিতা
এটা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয় যে প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, কারণ প্রতিরক্ষা ঐতিহ্যগতভাবে অংশীদারিত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ। ফ্রান্স হল রাশিয়ার পরে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী, এবং ইউক্রেন সংঘাতের কারণে রাশিয়ার ক্ষয়প্রাপ্ত সামরিক অস্ত্রাগার এই সহযোগিতাকে আরও নিবিড় করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আরও ২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমানের জন্য একটি চুক্তির কাজ চলছে, এবার ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য; এবং এর পাশাপাশি তিনটি স্করপেন সাবমেরিন নিয়েও কথা হচ্ছে। ফাইটার জেটের জন্য যৌথভাবে ইঞ্জিন তৈরিরও কথা আছে। এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের একটি মূল অংশীদার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যার লক্ষ্য প্রতিরক্ষা উৎপাদনের স্বদেশীকরণ। এই নিরাপত্তা সহযোগিতা অস্ত্র চুক্তির বাইরেও প্রসারিত, এবং দুই দেশ নিয়মিত যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিময়ও করে।
ফ্রান্সের জন্য এই লাভজনক চুক্তিগুলি ব্যবসার দুর্দান্ত সুযোগ তো তৈরি করেই, কিন্তু সেইসঙ্গে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতার মতো নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে পূর্ণ মতৈক্যও প্রাসঙ্গিক। উভয় দেশই এই অঞ্চলের আবাসিক শক্তি, যেখান দিয়ে বিশ্বের বাণিজ্যের একটি বড় অংশ চলে এবং যেখানে চিনের আগ্রাসী পদক্ষেপ উদ্বেগের কারণ। এই অঞ্চলে ১.৫ মিলিয়ন ফরাসি নাগরিক বসবাস করেন, এবং ফ্রান্স এখানে সবচেয়ে সক্রিয় ইউরোপীয় শক্তি। ২০২২ সালের গোড়ার দিকে ইইউ কাউন্সিলে ফ্রান্সের সভাপতিত্বের সময়ও ইন্দো–প্যাসিফিক একটি প্রধান অগ্রাধিকার ছিল। ফ্রান্স ও ভারতের মধ্যে কৌশলগত জোট অস্ট্রেলিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (ইউএই) এর মতো সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থাকেও সক্ষম করেছে। এছাড়াও, এই অঞ্চলে উদ্ভাবনভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলিকে সহজতর করার লক্ষ্যে দুই দেশ ২০২২ সালে একটি ইন্দো–প্যাসিফিক ত্রিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল চালু করেছে।
২০২২ সালের গোড়ার দিকে ইইউ কাউন্সিলে ফ্রান্সের সভাপতিত্বের সময়ও ইন্দো–প্যাসিফিক একটি প্রধান অগ্রাধিকার ছিল। ফ্রান্স ও ভারতের মধ্যে কৌশলগত সারিবদ্ধতা অস্ট্রেলিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (ইউএই) এর মতো সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থাকেও সক্ষম করেছে।
পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ভারতের প্রতি তাদের দুর্বলতার একটি কেন্দ্রীয় কারণ হল চিন। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপীয় দেশগুলিকে চিনের উপর তাদের অত্যধিক অর্থনৈতিক নির্ভরতার বিপদের বিষয়ে সচেতন করেছে। ইউরোপের জন্য চিনের থেকে বৈচিত্র্যকরণ ও ‘ঝুঁকিমুক্তকরণের’ পাশাপাশি নীতি নির্ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার জন্য প্রচেষ্টা এবং ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। ভারতকে এমন একটি দেশ হিসাবে দেখা হয় যেটি চিন–এর সঙ্গে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনতে পারে এবং ইন্দো–প্যাসিফিকে নিরাপত্তা দিতে পারে। মার্কিন–চিন কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও গভীর হওয়ার ফলে মধ্যম শক্তি হিসাবে ভারত ও ফ্রান্স একটি বহুমুখী বিশ্বের অন্বেষণে আরও নিয়োজিত হতে বাধ্য হচ্ছে।
কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের অনুসরণ
তাদের বিদেশনীতিতে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’–এর অনুসরণ দুটি দেশকে সংযুক্ত করে। এটি এমন একটি ধারণা যা ভারত তার স্বাধীনতা–পরবর্তী বছর থেকে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় অনুশীলন করেছে, এবং যা ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বে ফ্রান্স ইউরোপীয় দেশগুলিতে আবেগের সঙ্গে প্রচার করেছে।
ফ্রান্স ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের প্রতি একটি স্বাধীন নীতি অনুসরণ করেছে—ভারত ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র হওয়ার পর ফ্রান্সই প্রথম পশ্চিমী দেশ ছিল যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদের দ্বারা আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে কথা শুরু করে। একই বছর ভারত ফ্রান্সের সঙ্গে তার প্রথম কৌশলগত অংশীদারি স্বাক্ষর করে। এই বিশেষ বন্ধন, এবং সেটাও সেই যুগ থেকে যখন বাকি পশ্চিমী বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা ইতিবাচক ছিল না, বর্তমান দিন পর্যন্ত এগিয়ে চলেছে। দুই দেশের মধ্যে এই সখ্য, এবং ভারতের অধিকার ও নিজের পছন্দগুলি অনুশীলন করার প্রয়োজন সম্পর্কে ফ্রান্সের সচেতনতা, রাশিয়া–ইউক্রেন দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে বিপরীত অবস্থানের মতো সম্ভাব্য সংঘাতের বিন্দুগুলিকে সরিয়ে দিয়েছে। সফরের জন্য যৌথ বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, এটি এমন একটি সম্পর্ক যা ‘তীব্র ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেও অটল এবং সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারে সাহসী ও উচ্চাভিলাষী’।
ভারত ও ফ্রান্স আগামী ২৫ বছরে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে একটি রোডম্যাপ ‘হরাইজন ২০৪৭’ প্রকাশ করেছে, যা ভারতের স্বাধীনতার ১০০ বছর ও ভারত–ফ্রান্স কৌশলগত অংশীদারিত্বের ৫০ বছর চিহ্নিত করবে।
যাই হোক, এই সম্পর্কের মধ্যে নিরাপত্তার সমস্যাগুলির আধিপত্য অব্যাহত রয়েছে, এবং বাণিজ্য পিছিয়ে রয়েছে। এটি জার্মানির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে অর্থনীতিই অংশীদারিত্বের সিংহভাগ। পরিসংখ্যান বলছে, ফ্রান্স হল ভারতের ১১তম বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ২০২২ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৫.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও তা প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু এখনও তা পূর্ণ সম্ভাবনার নিচের স্তরে রয়েছে। অন্যদিকে জার্মানির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য একই বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। উভয় পক্ষের ব্যবসার প্রধানদের সঙ্গে এই সফরের সময় অনুষ্ঠিত সিইও ফোরাম এই ব্যবধান কমানোর প্রচেষ্টার একটি অংশ ছিল। তবে একটি ইইউ–ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমেই শুধু ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে সর্বাধিক বাণিজ্য সম্ভাবনা উন্মুক্ত করা যেতে পারে।
ভারত ও ফ্রান্স আগামী ২৫ বছরে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে একটি রোডম্যাপ ‘হরাইজন ২০৪৭’ প্রকাশ করেছে, যা ভারতের স্বাধীনতার ১০০ বছর এবং ভারত–ফ্রান্স কৌশলগত অংশীদারিত্বের ৫০ বছর চিহ্নিত করবে। এই ভবিষ্যৎ দৃষ্টি সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
রাশিয়া–ইউক্রেন সংঘাতের আগেই ফ্রান্স ভারতের সেরা বন্ধু হিসেবে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপন করেছিল। সম্ভবত, এই সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হল এর গভীরে প্রোথিত বিশ্বাস এবং উভয়ের মধ্যে অতীতের বোঝা না–থাকা। একটি দীর্ঘস্থায়ী ভাল প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারিত্ব থাকা সত্ত্বেও মোদী ও ম্যাক্রোঁর মধ্যে ব্যক্তিগত রসায়ন অবশ্যই সাহায্য করছে।
শায়রি মলহোত্র অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রাম–এর অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.