ইউক্রেন সংকট থেকে চিন যা শিখেছে এবং যা শেখেনি
এই নিবন্ধটি ‘ইউক্রেন সংকট: কারণ ও গতিপথ’ সিরিজের অংশ।
কয়েক মাস আগে যখন ইউক্রেন সংকট শিরোনামে এসেছিল, তখন প্রচলিত প্রজ্ঞা অনুযায়ী মনে হয়েছিল যে পরিস্থিতি যে ভাবেই বিকশিত হোক না কেন চিন তার সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হবে। কোভিডের শুরু থেকে চিনের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি পড়তে শুরু করেছিল। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি তার পরিধির বহিঃসীমায় কঠোর নীতি অবলম্বন করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই এই অঞ্চলে প্রতিস্পর্ধিতার জন্ম দিয়েছে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে। ২০১০ সালে যখন অতিমারি আঘাত হানে, তখন অনেকেই চিনকে এমন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করেন যে তার সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার জন্য সব কিছু করতে পারে। উদীয়মান বিশ্বব্যবস্থাও এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যেখানে প্রধান শক্তিগুলি চিনের ক্ষেত্রে তাদের নীতি অগ্রাধিকারগুলি পুনর্মূল্যায়ন করতে শুরু করে। বিশ্ব উপলব্ধি করছিল যে চিনের নেতৃত্বে একটি বৈশ্বিক শৃঙ্খলা বেশ ক্ষতিকারক হতে পারে, এবং সেই কারণেই আরও ভাল ভারসাম্য আনার জন্য পদক্ষেপের প্রয়োজন আছে।
আর ঠিক সেই সময়েই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হল। যতক্ষণ পর্যন্ত তা ছিল ইউরোপীয় নিরাপত্তার বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য প্রাথমিক ভাবে রাশিয়ার সামরিক উদ্যোগ, ততক্ষণ তা চিনের জন্য ভালই কাজ করেছিল। কিন্তু যখন আক্রমণ শুরু হয়ে গেল এবং সংঘাত বেড়ে গেল, যখন রাশিয়ার পক্ষে দ্রুত কিছু অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ল, তখন চিনও নিজের প্রতিক্রিয়া কী ধরনের হবে তা নিয়ে সমস্যায় পড়ল। এখন রাশিয়া পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চিনের কাছে সামরিক ও অন্যান্য সহায়তা চেয়েছে বলে জানা গিয়েছে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেজিংকে সতর্ক করে বলেছে যদি তারা এমন কিছু করার চেষ্টা করে তবে তার পরিণতি ভয়ানক হবে।
গত সপ্তাহে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে একমত হয়েছেন যে ইউক্রেনের পরিস্থিতি ‘উদ্বেগজনক’ ছিল, এবং কথা দিয়েছেন চিন ‘ফ্রান্স, জার্মানি ও ইইউ-এর সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় বজায় রাখবে, এবং জড়িত পক্ষগুলির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে কাজ করবে’। বেজিং ঘোষণা করেছে যে সে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনকে প্রায় ৭৯০,০০০ ডলার মানবিক সহায়তা দেবে।
যদিও ইউক্রেনের অনুরোধমতো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে শি অস্বীকার করেছেন, তবে এটি স্পষ্ট যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে রক্ষা করতে গিয়ে চিনকে ক্রমশই বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। কারণ রাশিয়া আটকা পড়ে গিয়েছে, এবং নিষেধাজ্ঞাগুলি ক্ষতি করছে চিনের অর্থনীতির, যা এখন ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি ভাল জায়গায় পৌঁছনোর পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। তবে বেজিং আগ্রাসনের নিন্দা করেনি। রুশ বাহিনী যে পরিস্থিতিতে পড়েছে তাতে চিনের অস্বস্তি বাড়ছে। তার সঙ্গে যুদ্ধের ফলে তৈরি হওয়া ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক চিনের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও চিন এই অবস্থান বজায় রেখেছে যে চিন-রাশিয়ার বন্ধুত্ব ‘পাথরের মতো শক্ত’।
এই যুদ্ধের আগেই বিশ্বব্যাপী চিনের সুনামের ক্ষতি হয়েছে, এবং পুতিন কী করেন বা না করেন তার ফলে তা খুব বেশি প্রভাবিত হবে না।
যদিও পশ্চিমের কেউ কেউ মনে করেন যে পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে সুনামের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হবে তা নিয়ে শি–র চিন্তিত হওয়া উচিত, বাস্তবে কিন্তু এর তেমন কোনও তাৎপর্য নেই। এই যুদ্ধের আগেই বিশ্বব্যাপী চিনের সুনামের ক্ষতি হয়েছে, এবং পুতিন কী করেন বা না করেন তার ফলে তা খুব বেশি প্রভাবিত হবে না। তবে চিনের নেতৃত্বের পক্ষে উদ্বেগের বিষয় হল রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, কারণ এখন চিনের বৃদ্ধির হার তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। যতই পশ্চিমের অবক্ষয়ের কথা আলোচিত হোক না কেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ধাক্কা দিয়ে ওয়াশিংটন বুঝিয়ে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে এখনও তার ওজন কতটা। শুধু ইউরোপের মার্কিন মিত্ররাই নয়, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের মিত্ররাও নিষেধাজ্ঞা, রফতানি নিয়ন্ত্রণ এবং রুশ অলিগার্কদের লক্ষ্যবস্তু করার প্রশ্নে মার্কিন প্রচেষ্টার পিছনে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চিন তার সুবিধার জন্য পশ্চিমী দেশগুলির মতপার্থক্যকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এই সঙ্কট তাদের সবাইকে অভূতপূর্ব মাত্রায় কাছাকাছি নিয়ে এসেছে, এবং এরপর ইইউ-এর সঙ্গে চিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হতে পারে।
অতিমারি যেমন বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে চিনের উপর অত্যধিক নির্ভরতার চ্যালেঞ্জগুলি সমস্ত দেশের জন্য কতটা বিপদস্বরূপ তা তুলে ধরেছে, তেমনই ইউক্রেন সংকট শক্তি সরবরাহের জন্য রাশিয়ার উপর ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতার ভঙ্গুরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। অর্থনীতির বাইরে, পশ্চিমী শক্তিগুলির মধ্যে কৌশলগত ঐকমত্য বৈশ্বিক ভূ–রাজনীতিকে নতুন আকার দেবে। ন্যাটো এবং ইইউ নতুন জীবন পেয়েছে, এবং ইউরোপীয় দেশগুলি এখন তাদের নিরাপত্তা কাঠামো শক্তিশালী করতে আগের চেয়ে আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। কোয়াডের নেতারা সম্প্রতি একটি ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলন করেছেন, এবং সেখানে তাঁরা ইউক্রেনের সংঘাতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা সত্ত্বেও একসঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। এটা যেন বেজিংকে সংকেত দেওয়া যে চিন সব সময় তাঁদের রাডারে রয়েছে।
চিন রাশিয়া নয়। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। ক্রমহ্রাসমান বৃদ্ধির সময়ে যা সবচেয়ে বেশি পরিহার্য তা হল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা। চিন দুটি মূল বাজারের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। শি ও পুতিন পশ্চিমী প্রভাবের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের শরিক হতে পারেন, এবং উভয়েরই এর সম্প্রসারণবাদী কর্মসূচি প্রতিহত করায় আগ্রহ থাকতে পারে, কিন্তু চিনের জন্য স্থিতিশীলতা তার বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি পূরণের মূল চাবিকাঠি। অন্যদিকে, রাশিয়া অর্থনৈতিক দিক থেকে কমজোরি, এবং সে যতই ভান করুক না কেন ইউক্রেন সংঘাত তার দুর্বলতাগুলিকেই প্রকাশ করে দিয়েছে। তার জন্য পারমাণবিক তর্জন-গর্জনই বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একমাত্র উপায় বলে মনে হচ্ছে।
ন্যাটো এবং ইইউ নতুন জীবন পেয়েছে, এবং ইউরোপীয় দেশগুলি এখন তাদের নিরাপত্তা কাঠামো শক্তিশালী করতে আগের চেয়ে আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছে।
চিন যে এখন ইউক্রেনের উদ্বেগ এবং ইউরোপীয় অনুরোধের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছে, তার একটি কারণ রয়েছে। চিন এভাবে স্বীকার করে নিয়েছে যে দ্বন্দ্বের বিষয়ে সে কিছু না–করলে পশ্চিমের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে পড়তে পারে। চিন পুতিনের বিরুদ্ধে একটি সীমা অতিক্রম করবে, তা অসম্ভব। তবে এটি স্পষ্ট যে এই সংকট থেকে চিন পাঠ নিচ্ছে, যেমনটি সে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন থেকে নিয়েছিল।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.