‘নয়া পাকিস্তান’-এর উন্মোচন
২০১৬ সালে ইমরান খান ও তাঁর পার্টি তেহরিক-এ-ইনসাফ (পি টি আই) পাকিস্তানি রাজনীতিতে সুবর্ণ দিনের আশা জাগিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল দেশটিকে ‘বংশানুক্রমিক শাসন’ এবং দুর্নীতির মারাত্মক প্রভাব থেকে উদ্ধার করা। ইমরান খান ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হন, যে নির্বাচনটি ১৯৭০ সালের পর থেকে হওয়া নির্বাচনগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা কলঙ্কিত বলে মনে করা হয়। কারণ সেই সময়ে পাকিস্তানি সেনা প্রবল ভাবে নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিল। সেনার মতে নওয়াজ শরিফ খুব জোরালো ভাবে বেসামরিক শাসনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব আরোপের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণা করা এবং বন্দি করার মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনা নির্বাচনের আবহ তৈরি করে। এমনটা করার ফলে নওয়াজের দল দুর্বল হয়ে পড়ে। জঙ্গ এবং ডনের মতো গণমাধ্যম সংস্থাগুলির উপরে আক্রমণ চালানো হয় এবং একই সঙ্গে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য উপযুক্ত লোক খোঁজার কাজ চলতে থাকে।
ইমরানের অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত, দেশের প্রধান শক্তি অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনার সমর্থন তিনি কেন হারালেন এবং শেহবাজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এবং বিলওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির মতো যুযুধান দুই দল পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ভুলে তাঁকে উৎখাত করতে সহমত হল। মওলানা ডিজেলের (পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট প্রধান মওলানা ফজলুর রজমান) মতো ছোট শক্তিরা সাধারণত প্রবাহের অনুকূলে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করেন। ইমরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও গুরুতর শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন এবং দাবি করেছেন যে, আমেরিকা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। তাঁর পেশ করা ‘প্রমাণ’ অর্থাৎ ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত এবং দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আদান-প্রদানের দায়িত্বে থাকা বরিষ্ঠতম স্টেট ডিপার্টমেন্ট সদস্য ডোনাল্ড লু-এর মধ্যে কথোপকথন মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইমরান আস্থা ভোটে জয়ী হলে ‘অস্থিরতা’ সৃষ্টি হতে পারে… লু-এর এই জাতীয় মন্তব্য আদৌ কোনও সঙ্কেত বহন করে না। খুব বেশি হলে এ হেন মন্তব্যকে হঠকারী বলা যেতে পারে। যদিও এ কথা সত্যি যে, ভুল সময়ে মস্কো পরিদর্শনে গিয়ে ইমরান ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে জটিল করে তোলেন। যে দিন তিনি মস্কো সফরে যান, সে দিনই পুতিন ইউক্রেন আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
এত চাপ সত্ত্বেও অনাস্থা প্রস্তাবটি অপেক্ষাকৃত কম ব্যবধানে সাফল্যের মুখ দেখেছে। এখনও পর্যন্ত ইমরানের পি টি আই তাঁর পাশে আছে বলেই মনে হচ্ছে।
সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি সাধারণত এ রকম ভাবে ঘটে না। পাকিস্তানি সেনার নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণের নেপথ্যে ওয়াশিংটনের হাত থাকার সম্ভাবনা থাকলেও ইমরান এবং সেনার মধ্যে সর্বজনবিদিত চাপানউতোরের কথা মাথায় রাখলে এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, ইমরানের অপসারণের জন্য আমেরিকাকে বিশেষ চেষ্টা করতে হয়নি। আসন্ন পট পরিবর্তনের আভাস অনেক দিন ধরেই স্পষ্ট হচ্ছিল। গত দু’বছর ধরে ইমরানের পি টি আই অভ্যন্তরীণ ভাবে এবং এম কিউ এম-এর সঙ্গে মতানৈক্যের সঙ্গে যুঝছে। এ রকমটা ঘটার নেপথ্যে অন্যতম কারণ হল সরকারের খারাপ ফলাফল, যে কারণে জোটের একাধিক শক্তি পি টি আই-এর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে। তবে এ খেলার মূল চালিকাশক্তি হল পাকিস্তানি সেনা যারা প্রথমে ২০১৮ সালে পি টি আই-এম কিউ এম জোট গঠনে সাহায্য করেছিল এবং বর্তমানে যারা সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘হস্তক্ষেপ না করার’ নীতি গ্রহণ করেছে।
এমনটা করার কারণও ছিল। ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর বাজওয়ার মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগে তাঁর মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে এক্সিকিউটিভ এবং সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। পি টি আই সরকার আগস্ট মাসে বাজওয়ার ক্ষমতায় আসীন থাকার মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে দিলেও এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং সুপ্রিম কোর্ট এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ২০১০ সালে জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানির মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার চ্যালেঞ্জ ইসলামাবাদ হাই কোর্ট খারিজ করে দেয়।
অবশেষে কোর্টের তরফে ছয় মাসের মেয়াদ বৃদ্ধির সুযোগ দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনেট এর ফলে একটি বিল পাশ করতে সমর্থ হয় এবং তাঁর মেয়াদ ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বর্ধিত হয়। পরবর্তী কালে শেহবাজ শরিফ অভিযোগ তোলেন যে, ইমরান ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রক্রিয়াটিকে বিলম্বিত করেন অথবা তিনি নিজে অন্তত পক্ষে অন্য বিরোধী দলগুলির তুলনায় এই মেয়াদ বৃদ্ধিতে অধিক অনাগ্রহী ছিলেন।
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে অর্থাৎ তালিবানের কাবুল দখলের প্রেক্ষিতে আই এস আই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফইজ আহমেদের আত্মগর্ব প্রকাশ করার এক মাস পরে তাঁকে পেশাওয়ার কোর কমান্ডারের পদে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং তাঁর পরিবর্তে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আনজুমকে ক্ষমতায় আনা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেই আই এস আই প্রধানকে নিয়োগ করেন। খবরে প্রকাশ, হামিদের বরখাস্ত হওয়া এবং আনজুমের নিয়োগের আগে ইমরান ও সেনাপ্রধানের মধ্যে তিন সপ্তাহ যাবৎ এক অচলাবস্থা বিদ্যমান ছিল। এমনটা শোনা যায় যে, হামিদ ইমরানের বিশ্বস্ত ছিলেন এবং আই এস ই প্রধানের পদে তাঁর বহাল থাকা ইমরানের জন্য লাভদায়ক ছিল।
পি টি আই সরকার আগস্ট মাসে বাজওয়ার ক্ষমতায় আসীন থাকার মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে দিলেও এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং সুপ্রিম কোর্ট এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
ইমরানের নিয়োগের নেপথ্যে থাকা সেনাচালিত প্রক্রিয়াটির একটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পি পি পি) মতো দুই ঘোষিত প্রতিপক্ষের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা। এর ফলে পাকিস্তানে রাজনীতির ক্রমবর্ধমান সীমাবদ্ধতা এবং তা অতিক্রমণে ইমরানের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়।
সেনার তরফে আশা করা হয়েছিল যে, ইমরানের সরকার পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে এবং দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সদর্থক ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু পি টি আই সরকারের অনভিজ্ঞতা এবং কোভিড সঙ্কট এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। ইমরান এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি নির্মাণ করার চেষ্টা করেন যে, তিনি এক ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ে তুলবেন, যেখানে দুর্নীতি নির্মূল করা হবে এবং সকলের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকবে।
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে, বাস্তবে তাঁর শাসনকালে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রতিশ্রুতিমাফিক হারে কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি। পাশাপাশি, মুদ্রাস্ফীতির ফলে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নাটকীয় ভাবে টাকার মূল্য কমেছে। অর্থনীতির এই বিদ্যমান সমস্যাগুলিই সুপ্রিম কোর্ট এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
ইমরান এই লড়াইয়ের শেষ দেখতে চাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘সরকার বদলের বিদেশী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আজ আরও এক বার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হল।’ কিন্তু তাঁর এই ঘোষণা নির্বাচনী ফলাফলে প্রতিফলিত হয় কি না সেটাই এখন খেয়াল করার মতো বিষয়। এ কথা লক্ষ্যণীয় যে, এত চাপ সত্ত্বেও অনাস্থা প্রস্তাবটি অপেক্ষাকৃত কম ব্যবধানে সাফল্যের মুখ দেখেছে। এখনও পর্যন্ত ইমরানের পি টি আই তাঁর পাশে আছে বলেই মনে হচ্ছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.