উদ্বেগের জাহাজ
যখন চিনা গবেষণা জাহাজ ইউয়ান ওয়াং ৫ শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরে ‘চিন ও শ্রীলঙ্কার বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক’ ব্যানার নিয়ে নোঙর করেছিল, তখন নয়াদিল্লিতে, পশ্চিমের রাজধানীগুলিতে, এবং এমনকি শ্রীলঙ্কায় উদ্বেগ দেখা দেয় যে এই ঘটনাটি কীসের ইঙ্গিত বহন করছে। ভারত আপত্তি তোলার পরে কলম্বো প্রাথমিকভাবে বেজিংকে জাহাজটির সফর পিছিয়ে দিতে বলেছিল। পরে, এটি কোনও গবেষণা সংক্রান্ত কাজ করবে না, এই শর্তে শ্রীলঙ্কা জাহাজটিকে জ্বালানি ভরে নেওয়ার জন্য নোঙর ফেলার অনুমতি দেয়। ইউয়ান ওয়াং ৫–কে যে মহাকাশ, উপগ্রহ এবং আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ট্র্যাকিংয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, তা ভারতে এবং অন্যত্র ভালভাবেই অনুধাবিত হয়। এই ঘটনাটি নয়াদিল্লি এবং বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ভারত মহাসাগরে চিনের দখল কীভাবে সুসংহত হচ্ছে।
প্রত্যাশামাফিকই শ্রীলঙ্কা এই ঘটনাটিকে ছোট করে দেখিয়েছে। তারা দেখাতে চেয়েছে যে শ্রীলঙ্কায় প্রচুর আন্তর্জাতিক জাহাজ নোঙর করছে, এবং কলম্বো বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলির সঙ্গে তার কোনও সংঘাত না–থাকা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে চলেছে। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে চিন বলেছে, ইউয়ান ওয়াং ৫–এর সফর ছিল ‘দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক বিনিময়ের’ অংশ। অথচ ঘটনা হল, কয়েকদিন আগে বেজিং কলম্বোর উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল এই যুক্তি দিয়ে যে ‘‘কিছু কিছু দেশের তথাকথিত ‘নিরাপত্তা উদ্বেগ’–এর কথা বলে শ্রীলঙ্কাকে চাপ দেওয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।’’
চিনের জাহাজ এর আগেও শ্রীলঙ্কার জলসীমায় ছিল, যা ভারত–শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ২০১৪ সালে দুটি চিনা সাবমেরিন পর্যায়ক্রমে স্বল্প ব্যবধানে কলম্বো বন্দরে এসেছিল, যা নয়াদিল্লিতে যথেষ্ট উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। ২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিংহে ভারতীয় সংবেদনশীলতার কারণে নরেন্দ্র মোদীর সফরের সময় একটি চিনা সাবমেরিনকে কলম্বোতে আসার অনুমতি দেননি।
অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া কলম্বো যখন সাহায্য চাইছে, সেই মুহূর্তটি চিন এই বিষয়টি দেখিয়ে দিতে ব্যবহার করেছে যে সে কীভাবে তার সামরিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্যে নির্মিত পরিকাঠামো ব্যবহার করতে চায়।
কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। ভারত এমন এক সময়ে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে এগিয়ে গিয়েছিল যখন দ্বীপরাষ্ট্রটি তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। শোধ করা সম্ভব নয় এমন ঋণ দিয়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটে চিন আংশিকভাবে অবদান রাখা সত্ত্বেও, সঙ্কট যখন তীব্র হল তখন চিন কোথাও ছিল না। বরং শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব স্পষ্টভাবে অনুরোধ করার পরেও তারা ঋণ পুনর্গঠন করতে অস্বীকার করেছে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির উপর চিনের দমবন্ধ করা ফাঁস একটি বাস্তবতা। হাম্বানটোটা হয়ে উঠেছে ‘চিনের ঋণ–ফাঁদের অর্থনৈতিক কূটনীতির’ সবচেয়ে বিশিষ্ট উদাহরণ। চাপের মুখে শ্রীলঙ্কাকে ১.১২ বিলিয়ন ডলারে ৯৯ বছরের লিজে এই বন্দরটি চিনাদের দিতে হয়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া কলম্বো যখন সাহায্য চাইছে, সেই মুহূর্তটি চিন এই বিষয়টি দেখিয়ে দিতে ব্যবহার করেছে যে সে কীভাবে তার সামরিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্যে নির্মিত পরিকাঠামো ব্যবহার করতে চায়।
নয়াদিল্লি শ্রীলঙ্কার উপর তার অর্থনৈতিক ঔদার্য বর্ষণ করেছে এটা স্পষ্ট করতে যে ভারত তার সংযোগের কেন্দ্রস্থলে রাখে সাধারণ শ্রীলঙ্কাবাসীর স্বার্থ। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে শ্রীলঙ্কায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জ্বালানি, খাদ্য ও সার সরবরাহের পাশাপাশি ভারত ক্রেডিট এবং মুদ্রার অদলবদল হিসাবে ৩.৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রদান করেছে৷
শ্রীলঙ্কা যখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় সেই সময়ই যে চিনকে তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে হল, তা এই দ্বীপরাষ্ট্রে ভারতের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি সম্পর্কে বেজিংয়ের উদ্বেগ প্রতিফলিত করে। কিন্তু এর প্রভাব পড়বে ভারতের উপর, এবং ভারত–শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের উপর। পিপলস লিবারেশন আর্মি নৌবাহিনীর ঘাঁটি তৈরি করে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে অনেক দূর পর্যন্ত নিজের উপস্থিতি জাহির করতে চাইছে। হাম্বানটোটায় যা ঘটছে তা বিস্তৃত অঞ্চলে পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য চিনা অভিপ্রায়ের একটি সংকেত।
শ্রীলঙ্কা যখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় সেই সময়ই যে চিনকে তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে হল, তা এই দ্বীপরাষ্ট্রে ভারতের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি সম্পর্কে বেজিংয়ের উদ্বেগ প্রতিফলিত করে।
ইউয়ান ওয়াং ৫–এর আগমনের একদিন আগে ভারত শ্রীলঙ্কাকে একটি ডর্নিয়ার ২২৮ নজরদারি বিমান উপহার দিয়েছে, যাতে সে দেশের সামুদ্রিক নজরদারির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। নতুন দিল্লির এখন চিনের সীমানার চারপাশে নিজের সামুদ্রিক উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য দ্বিগুণ কঠোর পরিশ্রম করা উচিত। আর শ্রীলঙ্কার নীতিনির্ধারকেরা ভাল করবেন যদি তাঁরা মনে রাখেন যে ভারত এমন একটি গণতন্ত্র যেখানে সরকারের পদক্ষেপ করার ক্ষমতা জনসমর্থনের উপর নির্ভরশীল। ভারতের জনগণ যদি মনে করে যে কলম্বো বারবার লক্ষ্মণরেখা উপেক্ষা করছে, তাহলে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের পরের বার সাহায্যের হাত বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।
এই ভাষ্যটি প্রথমে ‘দ্য হিন্দু’তে প্রকাশিত হয়েছিল।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.