Published on Apr 08, 2022 Updated 7 Days ago

রাশিয়া কি বুদ্ধি করে তার নিজের শর্তে ইউক্রেন যুদ্ধে ইতি টানতে পারবে, না কি এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পরিণত হবে?

পুতিনের ইউক্রেন কৌশলই কি নির্ণায়ক হবে?
পুতিনের ইউক্রেন কৌশলই কি নির্ণায়ক হবে?

বিশ্বব্যাপী জল্পনাকল্পনা এবং রুশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে অস্বীকার করার পরে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের উপরে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ চালান। এই আক্রমণের ঘটনাটির নেপথ্যে রয়েছে আট বছর আগে ঘটা দু’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা: রাশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনে ক্রিমিয়া এবং তার অব্যবহিত পরেই দোনবাস অঞ্চলের দনেৎসক এবং লুহানসক অঞ্চলগুলির দখল নেওয়া। এই অঞ্চলগুলি প্রধানত রুশভাষী মানুষ দ্বারা অধ্যুষিত ছিল এবং বর্তমান আক্রমণের ঠিক পূর্বেই ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট পুতিন উক্ত অঞ্চলগুলিকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করেন। এই অঞ্চলগুলির দখল নেওয়ার নেপথ্যে পুতিনের যুক্তি ছিল যে, মস্কো স্থানীয় রুশ জনসাধারণকে কিভের শাসকদের খপ্পর থেকে বাঁচিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে অঞ্চলটিতে অভ্যুত্থান চলেছে যার ফলে ১৫,০০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এমনকি এই পরিসংখ্যানকে বর্তমান সময়ের বৃহত্তর আক্রমণের নেপথ্য যুক্তি হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের প্রথম পর্যায় শুরু হয় যখন ইউক্রেনীয় আকাশ প্রতিরক্ষা (এয়ার ডিফেন্স), বিমান ঘাঁটি এবং কমান্ড ও কন্ট্রোল নোডগুলিতে রাশিয়া আকাশপথ, সমুদ্রপথ এবং ভূ্মিভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে সমন্বিত ভাবে গোলাবর্ষণ শুরু করে।

বেশ কয়েক মাস যাবৎ প্রস্তুতির পরে রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে তার সীমান্ত বরাবর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে প্রায় ১,৯০,০০০ সেনা মোতায়েন করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের প্রথম পর্যায় শুরু হয় যখন ইউক্রেনীয় আকাশ প্রতিরক্ষা (এয়ার ডিফেন্স), বিমান ঘাঁটি এবং কমান্ড ও কন্ট্রোল নোডগুলিতে রাশিয়া আকাশপথ, সমুদ্রপথ এবং ভূ্মিভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে সমন্বিত ভাবে গোলাবর্ষণ শুরু করে। রুশবাহিনী চারটি অক্ষ বরাবর আক্রমণ চালায়। এগুলির মধ্যে প্রথমটি হল খারকিভ, যা ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং উত্তর-পূর্বে রুশ সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। আক্রমণের দ্বিতীয় পথটি হল বেলারুশ থেকে ইউক্রেনীয় রাজধানী কিভকে লক্ষ্য করে। তৃতীয়টি দোনবাস অঞ্চল থেকে এবং সর্বশেষ অর্থাৎ চতুর্থ আক্রমণের উৎসস্থলটি ছিল ক্রিমিয়া এবং নৌঘাঁটি সেবাস্তোপোল, যেগুলি ২০১৪ সাল থেকেই রাশিয়ার দখলে ছিল।

অনুমান করা হচ্ছে এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত উভয় তরফেই হতাহতের সংখ্যা যথেষ্ট। যদিও সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে এখনও বেশ ধোঁয়াশা রয়েছে। মস্কোর প্রাথমিক লক্ষ্য হল জেলেনস্কি পরিচালিত সরকারের অপসারণ, রুশপন্থী পুতুল সরকার বহাল করা এবং ইউক্রেনের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ। এমনটা করার অর্থ হল সব ক’টি প্রতিরোধী প্রচেষ্টাকে সমূলে ধ্বংস করা। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে এখনও পর্যন্ত রাশিয়া তার সামগ্রিক শক্তির সামান্য অংশই এই যুদ্ধে ব্যবহার করেছে। আগামিদিনে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধকে অতিক্রম করার জন্য রাশিয়া উল্লেখযোগ্য রকমের শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। তবুও পুতিনের ইউক্রেন অধিগ্রহণের পথে একাধিক অনিশ্চয়তা এবং প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। রুশ সেনার সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাটি হল যে, তারা ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের এমন একটি দেশকে আয়ত্তে আনতে চাইছে যার একটি বড় অংশই রাশিয়ার তীব্র বিরোধী এবং যে দেশটি আয়তনে ইউরোপে রাশিয়ার পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম। ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং এক অনুপ্রাণিত প্রতিপক্ষ ছাড়াও ইউক্রেনে নগরায়ণের উচ্চ মাত্রা শহুরে যুদ্ধের জন্য অনুকূল। ইউক্রেনের শহরগুলির রাস্তায় রুশ স্থলবাহিনী এবং ইউক্রেনীয় সেনা ও মিলিশিয়ার সঙ্গে লড়াই রুশ সেনার গতিকে মন্থর করে দেবে। সর্বোপরি, যদি ইউক্রেনের সেনা ডিফেন্সিভ ইন্টিরিয়র লাইনস বা প্রতিরক্ষা সীমানা গড়ে তুলতে পারে, তা হলে তারা রাশিয়াকে এক দীর্ঘায়িত এবং অশেষ যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (নেটো) পূর্বের সদস্য দেশ, যেমন পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এবং স্লোভাকিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত থাকায় এই সম্ভাবনা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই দেশগুলি সেনা প্রশিক্ষণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং সীমান্ত দিয়ে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধী সেনার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে আন্তঃসীমান্ত কার্যকলাপে সহায়ক হতে পারে। আক্ষরিক অর্থেই নেটো রুশ সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে দুর্বলতর করে তুলতে অর্থায়ন, অস্ত্র সরবরাহ এবং রুশ সেনার বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থানকে ইন্ধন জোগানোর জন্য সর্বতো ভাবে চেষ্টা চালাবে। এমনটা আগামী সপ্তাহ, মাস এবং সম্ভবত বছরগুলিতে ঘটতে দেখা যাবে, যা রুশ আক্রমণের সামনে উপস্থিত তীব্র প্রতিবন্ধকতাগুলিকে তুলে ধরে। অন্য দিকে, রাশিয়া ইতিমধ্যেই স্থানীয় অধিবাসীদের ছদ্মবেশে ইউক্রেনীয় শহরগুলিতে তার সেনার অনুপ্রবেশ ঘটাতে শুরু করেছে, যার লক্ষ্য ইউক্রেনীয় সেনা এবং প্রতিরোধবাহিনীকে নির্মূল করা। তবে রাশিয়ার সামরিক কৌশল কতটা সফল হবে, তা অবশ্য সময়ই বলবে।

রুশ সেনার সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাটি হল যে, তারা ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের এমন একটি দেশকে আয়ত্তে আনতে চাইছে যার একটি বড় অংশই রাশিয়ার তীব্র বিরোধী এবং যে দেশটি আয়তনে ইউরোপে রাশিয়ার পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম।

ইতিমধ্যে রুশ সেনা চের্নোবিল পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দখল নেওয়া, দোনবাস অঞ্চলটিকে সম্পূর্ণ দখল করে ফেলা, নেপর নদী পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া, উপকূলীয় শহর ওডেসার দখল নেওয়া এবং ইউক্রেনের রাজধানী কিভের প্রতি অগ্রসর হওয়া ও তার সম্ভাব্য দখল নেওয়ার মতো সাফল্যগুলি পেয়ে থাকলেও ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ যথেষ্ট দৃঢ় এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত। এই অনিশ্চয়তার ফলে সংঘাতটির সমাধান কঠিন হয়ে পড়বে, এবং রাশিয়া তার নিজের শর্তে সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারবে না।

ধরে নেওয়া যাক, পুতিন রাশিয়ার একটি দীর্ঘায়িত গেরিলা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার কথা আঁচ করতে পেরেছেন। সে ক্ষেত্রে তিনি খুব সম্ভবত প্রধান ইউক্রেনীয় শহরগুলিকে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করবেন এবং সমগ্র ইউক্রেনকে পশ্চিম ও পূর্ব দুটি ভাগে বিভক্ত করবেন, যার মধ্যে পূর্ব ভাগটি রাশিয়ার জন্য একটি বাফার জোন হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এমন পরিস্থিতির সম্ভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করলেও রুশ সেনার সামনে উপস্থিত সমস্যাগুলি হ্রাস পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ এমনটা হলেও দেশের একটি বৃহৎ অংশ, খুব সম্ভবত পশ্চিমের দিকে, অভ্যুত্থানের উদ্ভব এবং সশক্তিকরণের জন্য এক উর্বর ভূখণ্ড হিসেবে কাজ করবে যাকে নেটো ক্রেমলিন দ্বারা কিভে স্থাপিত যে কোনও রকমের প্রশাসনের বিরুদ্ধে সর্বতো ভাবে কাজে লাগাবে।

২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক অধিগ্রহণের কথা ধরা যেতে পারে, যেটি সফল হলেও দেশটির দখল নেওয়ার মতো সেনা সংখ্যা ছিল অপ্রতুল।

১,৯০,০০০ সেনার রুশ আক্রমণকারী বাহিনী আপাতত যথেষ্ট হলেও অধিগ্রহণ-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় সেনার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে অধিক হবে, যা মস্কোকে অভ্যুত্থান দমনে কঠোর চাপে ফেলবে। কিভে যে কোনও রুশপন্থী সরকারের জনসমর্থন পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ফল স্বরূপ, রুশ সামরিক উপস্থিতি এবং তার ইউক্রেনীয় প্রক্সিদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সামরিক প্রতিরোধে সহায়তা করার সাম্প্রতিক সামরিক অভিজ্ঞতা এই সত্যকেই দর্শায়। ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক অধিগ্রহণের কথা ধরা যেতে পারে, যেটি সফল হলেও দেশটির দখল নেওয়ার মতো সেনার সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। কোনও সামরিক পরিকল্পনাই সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়ে যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হয় না। কারণ যে কোনও যুদ্ধে শত্রুপক্ষই সর্বদা শেষ কথা বলে। এই ভাবে ২০১৪ সালে রাশিয়ার লুহানস্ক, দোনেৎস্ক এবং ক্রিমিয়ান উপদ্বীপ দখল করার বিষয়টি নির্ণায়ক হলেও সেটির নিখুঁত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল প্রক্রিয়াটির সীমিত উদ্দেশ্যাবলির জন্য। এমনটা কিন্তু সমগ্র ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বর্তমান রুশ সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। আর রুশ সেনা ইউক্রেনীয় প্রতিপক্ষের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত হলেও একটি উদ্দীপিত এবং যথেষ্ট পরিমাণে সমরাস্ত্রবিশিষ্ট প্রতিপক্ষ পরাক্রমশালীকেও পরাজিত করার ক্ষমতা রাখে। যেমনটা তালিবানদের হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পরাজয়, আফগান মুজাহিদিনের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয় এবং ভিয়েতনামের মানুষের কাছে আমেরিকার পরাজয়ের একাধিক উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.