চাল হল একটি প্রধান কৃষিপণ্য যা সারা বিশ্বে খাদ্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। এটি প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে এশিয়ায়, যেখানে এটি একটি প্রধান খাদ্য এবং জীবিকা নির্বাহের একটি প্রধান উৎস। চালের মূল্যশৃঙ্খল স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯০০ মিলিয়ন দরিদ্র ব্যক্তিকে সহায়তা করে, যার মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন সক্রিয়ভাবে এর উৎপাদনে জড়িত। বিশেষ করে এশিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য হ্রাস, এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড–১৯ অতিমারির মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ এবং ক্রমবর্ধমান ভূ–রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে চালের দাম বেড়েছে, যা বিশ্বব্যাপী কৃষিক্ষেত্রকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই সময়ে, প্রধান রপ্তানিকারকদের যে কোনও বাণিজ্য হস্তক্ষেপ বিশ্বব্যাপী মূল্য ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। ভারতীয় চাল রপ্তানির উপর সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা— ভারত হল দ্বিতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদক এবং ২০১২ সাল থেকে চালের বৃহত্তম রপ্তানিকারক—বিশ্বব্যাপী দামকে প্রভাবিত করবে এবং ফলস্বরূপ যে ঘাটতি দেখা দেবে তা খাদ্য সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে৷
ভারত সরকার তার ভোক্তা ও কৃষকদের সুরক্ষার সঙ্গে দুর্বল দেশগুলিতে খাদ্য নিরাপত্তাকে সমর্থন করার প্রয়োজনের ভারসাম্য বজায় রাখছে। এই ঘটনা জাতীয় নীতি ও বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে তুলে ধরে। স্থানীয় ও বৈশ্বিক উভয় অংশগ্রহণকারীদের উপর এর রপ্তানি বিধিগুলির সম্পূর্ণ প্রভাব বোঝার জন্য ভারতের চাল বাণিজ্য কৌশল এবং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিগুলির একটি যত্নশীল বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। এই নিবন্ধটি অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তার মৌলিক কারণ হিসাবে ভারতের নিম্ন উৎপাদনশীলতার বিষয়টিকে তুলে ধরেছে, এবং পরে আন্তর্জাতিক প্রযোজক ও ভোক্তাদের উপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছে।
ভারত সরকার তার ভোক্তা ও কৃষকদের সুরক্ষার সঙ্গে দুর্বল দেশগুলিতে খাদ্য নিরাপত্তাকে সমর্থন করার প্রয়োজনের ভারসাম্য বজায় রাখছে।
ধান উৎপাদন—ভারত ও বিশ্ব
বিশ্বের আবাদযোগ্য জমির ১১.২ শতাংশের অধিকারী এবং তৃতীয় বৃহত্তম শস্য উৎপাদনকারী হওয়ায় বিশ্বব্যাপী কৃষিতে ভারত একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে। ধান চাষের অধীনে সর্বোচ্চ এলাকা থাকা সত্ত্বেও, যা চিনের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক, কারণ তার কম ফলনের হার — ২,৮০৯ কেজি/হেক্টর। মূল সমস্যা হল নিম্ন উৎপাদনশীলতা, যা স্বাধীনতার পর থেকে উন্নতি সত্ত্বেও বৈশ্বিক মানদণ্ডের নীচে রয়ে গেছে।
বিশ্বের আবাদযোগ্য জমির ১১.২ শতাংশের অধিকারী এবং তৃতীয় বৃহত্তম শস্য উৎপাদনকারী হওয়ায় বিশ্বব্যাপী কৃষিতে ভারত একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে।
চিত্র ১: ভারত এবং বিশ্বে ধানের ফলন
সূত্র: ইন্ডিয়া স্ট্যাট, আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা
বিভিন্ন কারণ এই উৎপাদনশীলতার ব্যবধানে অবদান রাখে— আঞ্চলিক বৈষম্য, বাস্তুতন্ত্রের প্রকারের অমিল, অসম সার ব্যবহার, স্থবির প্রযুক্তি, অত্যধিক বন্যা, এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও সেচ। এই বাধাগুলি শুধুমাত্র ফলনকে প্রভাবিত করে না, বরং চালের চূড়ান্ত মজুদ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করে, যার জন্য বাজারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নিতে হয়। পরিস্থিতিটি উৎপাদনশীলতার সমস্যা সমাধানের জন্য এবং ভারতের বিশাল কৃষি সম্পদের পূর্ণ সম্ভাবনা উপলব্ধি করার জন্য নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে।
চাল ব্যবসায় ভারতীয় আধিপত্য
বিশ্বব্যাপী চাল বাণিজ্য, যা মোট ধান উৎপাদনের মাত্র ১০ শতাংশ, এশিয়ার দেশগুলি দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়। এই দেশগুলি উৎপাদনে ৮৬ শতাংশের বেশি অবদান রাখে। শীর্ষ উৎপাদক হওয়া সত্ত্বেও চিনের রপ্তানির অংশ কম, এবং দেশীয় চাহিদার কারণে এটি একটি বড় আমদানিকারক। পাকিস্তান, তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং এর স্বাভাবিক সরবরাহকারীরা এর চাহিদা মেটাতে না পারায় কোভিড–পরবর্তী রাজনৈতিক উত্তেজনা পিছনে ফেলে চিন ভারত থেকে চাল আমদানি করছে। সাব–সাহারান আফ্রিকা বিশ্বব্যাপী চাল আমদানিতে সবার আগে আছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা প্রতিফলিত করে: চাল প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল অঞ্চলের প্রধান খাদ্য, এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এর ভূমিকা খুবই বেশি।
চিত্র ২: ২০২২ সালে শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশ
সূত্র: আইটিসি
ভারত বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির সঙ্গে ২০১২ সাল থেকে দেশটি এই অবস্থান বজায় রেখেছে, যা ২০২২ সালে ২২.১ মিলিয়ন টন রপ্তানির সঙ্গে শীর্ষে পৌঁছয়। সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি দেশের ক্রমবর্ধমান ও ক্রমশ বেশি সমৃদ্ধ জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতকে সুষম বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করতে হবে।
চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা
ভারতের চাল রপ্তানি, যার মধ্যে আছে প্রধানত বাসমতি, সিদ্ধ চাল, বাসমতি বাদে সাদা এবং ভাঙ্গা চাল, একত্রে ২০২২–২৩ অর্থবছরে তার মোট চাল রপ্তানির ৯৮ শতাংশ ছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে অ–বাসমতি সাদা চালের উপর ২০ শতাংশ রপ্তানি কর আরোপ করা সত্ত্বেও, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে আন্তর্জাতিক চাহিদা এর রপ্তানি বৃদ্ধির দিকে চালিত করে। যাই হোক, স্থানীয় মূল্য স্থিতিশীল করার জন্য ২০ জুলাই ২০২৩–এ একটি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। উপরন্তু, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২–এ ভাঙা চালের রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এটি করা হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় ঘাটতি মোকাবিলা করার জন্য, যা পশুসম্পদ এবং ইথানল উৎপাদন খাতে প্রভাব ফেলছিল।
এই বিধিনিষেধ ও শুল্কগুলি নেপাল, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং বিশেষ করে আফ্রিকান দেশগুলির মতো ভারতীয় চালের প্রধান আমদানিকারকদের উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে, যা সম্ভাব্যভাবে বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির দিকে চালিত করবে এবং এই অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করবে৷ এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককেও চাপে ফেলতে পারে, বিশেষ করে যেহেতু এই পরিবর্তনগুলি ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সি এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ)–কে জি২০–তে যোগদানের আমন্ত্রণের সময়ের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল।
বিশ্বের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
কম দাম ও অর্থনৈতিক গুণমানের জন্য সাব–সাহারান আফ্রিকা ভারতীয় অ–বাসমতি সাদা চালের সবচেয়ে বড় আমদানিকারকদের মধ্যে একটি। রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজারে ঘাটতি দেখা দেবে, যার ফলে দাম বাড়বে। এটি আন্তর্জাতিক ভোক্তাদের উদ্বৃত্তের উপর দ্ব্যর্থহীন সঙ্কোচন–প্রভাব ফেলবে। দাম বাড়লে আমদানিকারক দেশগুলির উৎপাদকেরা বেশি উদ্বৃত্ত ভোগ করবে। আফ্রিকা ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে, যারা গড়ে চাল আমদানিকারক, বাণিজ্য থেকে এই লাভ দিয়ে ভোক্তা–উদ্বৃত্তের ক্ষতি পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা কম, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা সামগ্রিক কল্যাণ কমিয়ে দেবে। যদিও এটি প্রত্যাশিত, ভারতের নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি করবে বলে দাবি করা অর্থহীন।
চালের বৈশ্বিক বাণিজ্য মোট উৎপাদনের মাত্র ১০ শতাংশ, যার মধ্যে ভারত ৪০ শতাংশ রপ্তানি করে। যাই হোক, এই ৪০ শতাংশ বাণিজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ বাসমতি চালের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে, যেখানে রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ হল অ–বাসমতি সাদা চাল। যদিও এটি অনিবার্যভাবে বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধি ঘটাবে, তবে শুধুমাত্র রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে পারে না, এমনকি খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যাঘাতও ঘটাতে পারে না।
যদিও বিভিন্ন গুণমানের চালের মধ্যে ক্রস–প্রাইস ইলাসটিসিটি খুব কম (অর্থাৎ ঘাটতির জন্য এক ধরনের চালের দাম বাড়লে সবগুলিই তেমন বাড়ে না), তবে দামের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব বাসমতির বাজারে আসতে পারে। এতে বাসমতি চাষিরা অধিক মুনাফা ভোগ করতে পারবেন, কিন্তু ভোক্তাদের উদ্বৃত্ত হ্রাস করবে। বেশিরভাগ ধনী দেশগুলি এটি আমদানি করে এবং উচ্চ আয়ের পরিবারের মানুষ এর ভোক্তা বলে বাসমতির প্রিমিয়াম গুণমান খাদ্য নিরাপত্তার প্রেক্ষিতে এর তাৎপর্য হ্রাস করে। বাণিজ্য থেকে লাভের পুনর্বণ্টন হবে, কিন্তু তা ধনী ভোক্তাদের থেকে বড় মাপের উৎপাদকদের মধ্যে।
উপসংহার
ভারতের চাল রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্বের বাজারে সরবরাহ হ্রাস এবং সেই কারণ দামের বৃদ্ধি ঘটবে, কিন্তু তার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম। যারা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া চালের প্রধান ভোক্তা সেই আফ্রিকান ও পূর্ব এশীয় দেশগুলিতে এটি খাদ্য মূল্যশৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটাবে। তবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেমন ক্ষতিগ্রস্ত দেশে চালের চালান পাঠানো এবং নিষেধাজ্ঞার নেতিবাচক প্রভাবহ্রাস নিশ্চিত করা। ভারত বাসমতি রপ্তানিতে শুল্ক ব্যবস্থা বজায় রাখলে, এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে রাজস্ব পুনরায় বিনিয়োগ করলে এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত। যদিও এটি খাদ্য নিরাপত্তার প্রতি ভারতের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করবে, দক্ষ প্রযুক্তির অভিযোজন দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য মজুদের অনিশ্চয়তা দূর করতে পারে। সরকারের উচিত উন্নত সেচ কৌশল এবং উচ্চমানের সার ব্যবহারের উপর মনোযোগ দিয়ে দেশীয় ফলন বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
আর্য রায় বর্ধন অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একজন গবেষণা সহকারী
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.