বিশ্ব নেতৃত্বকে আহ্বান জানানোর জন্য দিল্লিতে ভারত-আয়োজিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনকে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ভঙ্গুর ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতীক বলে মনে করা হচ্ছে। এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন গত তিন বছর ধরে সীমান্তে অচলাবস্থা বিদ্যমান। শীর্ষ সম্মেলনের আগে সীমান্ত অচলাবস্থার অগ্রগতি সম্পর্কে গণমাধ্যমে জল্পনা ছিল তুঙ্গে। শি-র পরিবর্তে প্রিমিয়ার লি কিয়াং সম্মেলনে যোগদান করেন এবং অধিকাংশ বিষয়ে তাঁর ভাষ্যে বেজিংয়ের শিক্ষার স্পষ্ট ছাপ পাওয়া গিয়েছে। যাই হোক, এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে শি-র পরিবর্তিত বিশ্বদৃষ্টিকেই তুলে ধরে।
শি প্রায় সব জি২০ শীর্ষ সম্মেলনেই যোগদান করেছেন। কারণ তা তাঁকে ‘চিনের আখ্যান আরও ভাল করে তুলে ধরা’র জন্য একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ প্রদান করেছিল। যাই হোক, গত কয়েক বছরে শি এই বিষয়ে নিশ্চিত যে, তিনি ‘গত এক শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভূতপূর্ব পরিবর্তন’-এর সাক্ষী থাকছেন, যা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন নির্দেশকারী একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি হিসাবে তিনি চিনের উত্থান সম্পর্কেও দ্বিধাহীন। অতীত যদি নজির স্থাপন করে, তা হলে একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি হিসাবে চিনও কূটনৈতিক ইতিহাসে নিজস্ব পদচিহ্ন রেখে যেতে ইচ্ছুক এবং তার নিজস্ব সুবিশাল চিন্তাভাবনা তুলে ধরতে আগ্রহী।
অপশ্চিমী অবকাঠামো নির্মাণ
এ ভাবে চিনের সঙ্গে যুক্ত কোনও গোষ্ঠী অথবা যেখানে চিন নেতৃত্বের ভূমিকায় রয়েছে, সেখানে নতুন উৎসাহ এবং উদ্দীপনা রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সম্মেলনের সময়ে তাঁর আচরণের সঙ্গে দিল্লি জি২০ সম্মেলনে শি-র অনুপস্থিতি তুলনা করা যেতে পারে। শি ব্রিকস এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন-এর (এসসিও) মতো একাধিক দেশের গোষ্ঠীগুলিকে বিশ্ব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চিনের সাফল্যের প্রমাণ রূপে মনে করেন। আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ব্রিকস-এ যোগদান করেছে, যে ঘটনাকে উচ্ছ্বসিত শি ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করেছেন। পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় আগ্রহী দেশগুলি চিনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, যেখানে ইরান এসসিও-তে যোগদান করছে এবং বেলারুশ যোগদানের অপেক্ষায় রয়েছে। অন্য দেশগুলি এই গোষ্ঠীগুলিতে যোগদানের জন্য আগ্রহী এবং এ সব কিছুই শি-কে এ হেন আস্থা প্রদান করেছে যে, চিন অন্য মেরু হয়ে উঠতে পারে অর্থাৎ মার্কিন আধিপত্যের বিরোধী চিন নেতৃত্বাধীন ব্লক সৃষ্টি করতে পারে। এ ভাবে ব্রিকস কনক্লেভ গ্লোবাল সাউথের দেশগুলির কাছে শি- র বক্তব্য প্রচার করার একটি সুযোগ হয়ে উঠেছে। শি দেশগুলির জন্য সাদা-কালো বিকল্প উপস্থাপন করেছেন: এক দিকে সমন্বিতকরণ এবং সহযোগিতা এবং অন্য দিকে বিভাজন ও সংঘর্ষ। একটি বিধ্বংসী অতিমারি দেশগুলিকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দ্রুততম পথ অন্বেষণের দিকে চালিত করেছে। এখানে শি চান যে, উন্নয়নশীল দেশগুলি এ কথাই বিশ্বাস করুক যে, চিন একাই ‘সমৃদ্ধির পথের’ চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চিনের প্রতিযোগিতার মাঝে পরোপকারী উদ্দেশ্যের মোড়কে চিনের আসল স্বার্থ সিদ্ধির প্রচেষ্টা রয়েছে। শি গ্লোবাল সাউথের স্থিতিশীল উন্নয়নে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, একটি ‘দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা তহবিল’ স্থাপনের জন্য মোট চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছেন এবং একই সঙ্গে চিনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি শি-র গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ বাস্তবায়নের জন্য ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল গঠনে করেছে। চিনের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী দৃষ্টিভঙ্গি সাম্প্রতিক সময়ে গ্লোবাল সাউথের কেন্দ্রস্থলে থাকা ভারত দ্বারা গৃহীত ক্রমবর্ধমান বিষয়গুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
চিনের ভারত সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা
নিজের জি২০ সভাপতিত্বের অধীনে ভারত খাদ্য ও শক্তি নিরাপত্তার বিষয়গুলি নিয়ে একটি ‘ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ’ শীর্ষ সম্মেলনে ১২৫টি দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য বৃহত্তর প্রতিনিধিত্বের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাঙ্কের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কারকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে জি২০ সভাপতিত্বকে ব্যবহার করেছে। গ্লোবাল সাউথের দেশগুলিও ভূ-রাজনৈতিক প্রবাহ এবং প্রকৃতিগত অস্পষ্টতার মুখোমুখি হয়েছে। ভারত রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে সার ও শস্য সরবরাহের শৃঙ্খল সুরক্ষিত করার চেষ্টা করছে এবং দ্রুত জলবায়ু অর্থায়নের বণ্টনে ব্রতী হয়েছে।
একটি বিধ্বংসী অতিমারি দেশগুলিকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দ্রুততম পথ অন্বেষণের দিকে চালিত করেছে।
জি২০ সভাপতিত্বে ভারত তার বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত দশকে ভারত পাকিস্তানের মতো একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং বর্তমানে ভারত চিনের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। তার জি২০ প্রেসিডেন্সির অধীনে নয়াদিল্লি জম্মু ও কাশ্মীর এবং অরুণাচল প্রদেশে বিদেশি প্রতিনিধিদের আতিথেয়তা করেছে, যে কূটনীতিক সাফল্য কয়েক বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল। এ ভাবে ভারতের গর্বের মুহূর্তটি বেজিংয়ের জন্য একটি চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে এবং সম্ভবত চিনকে তার কূটনৈতিক উপস্থিতি হ্রাস করতে বাধ্য করেছে।
ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য বন্ধুর পথ
শি-এর অপরিণত আচরণ বৃহত্তর ভারত-চিন সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক নয় এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর শি-র আচরণকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ভারতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা সংক্রান্ত সমাধান আরও দুরূহ হয়ে উঠতে পারে। নিঃসন্দেহে বেজিং ক্রমাগত ভাবে অরুণাচলের স্থানগুলির নাম পরিবর্তন করে, রাজ্যের বাসিন্দাদের স্টেপেলড ভিসা প্রদান করে এবং বর্তমানে এমন একটি মানচিত্র প্রকাশ করছে, যা ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতি ও ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের মতো চিনের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলি সেটিকে তীব্র আগ্রাসনের দিকে চালিত করবে। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হল তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর বিদেশ সফর সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া, যা বেজিংকে সামরিক মহড়া পরিচালনা করতে প্ররোচিত করেছিল। শি ফুকুশিমা পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র থেকে পরিশ্রুত বর্জ্যকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার জন্য জাপানের (একজন কোয়াড সদস্য) বিরুদ্ধে মৌখিক আক্রমণ চালিয়েছেন। অন্য দিকে জাপান টাইমস দেখিয়েছে যে, চিনের পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রগুলি থেকে উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয় ট্রিটিয়াম-সহ বর্জ্য জল অকার্যকর উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে রাখার বদলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়।
উপসংহারে বলা যায়, শি এক প্রতিদ্বন্দ্বী আন্তর্জাতিক অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, যার অর্থ হল চিনের সঙ্গে যুক্ত ব্লকগুলিতে আরও বেশি পরিমাণে বিনিয়োগের লক্ষ্যে কাজ করা। দ্বিতীয়ত, চিনের দৃষ্টিভঙ্গিকে এখন গ্লোবাল সাউথের কাছে ভারতের নিজস্ব প্রসারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। তৃতীয়ত, শি-র অনুপস্থিতি তাঁর চিন্তাভাবনার উপরেও আলোকপাত করে, যা ‘এক পর্বতে দু’টি বাঘ একত্রে থাকতে পারে না’ এ হেন চিনা প্রবাদকেই তুলে ধরে। শি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁর পদক্ষেপে এই ধারণাকে প্রকট করে তুলেছেন এবং বর্তমানে ক্রমশ উত্থিত ভারতের সঙ্গেও তার কূটনৈতিক সম্পৃক্ততায় এই প্রবাদটির প্রয়োগ করছেন বলে মনে হচ্ছে। চিনের আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়াদিল্লির তরফে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ পাওয়ার দরুন চিন কিছুটা অস্বস্তিতেই পড়েছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.