Published on Jan 03, 2022 Updated 0 Hours ago

চিন ও কোয়াড থেকে উদ্ভূত ভারত–রাশিয়া সম্পর্কের স্ববিরোধগুলো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে অতিক্রম করা কঠিন হবে।

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ভারত সফরে এলেন কেন?‌

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারত সফরে এসেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই সফরটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, অংশত এই কারণে যে পুতিন সাম্প্রতিক সময়ে সশরীরে কোনও শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বিদেশ যাননি, এমনকি অক্টোবরের শেষের দিকে রোমে জি-২০ বা নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ২৬ শীর্ষ সম্মেলনেও না। সেই পুতিন কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ২১তম বার্ষিক ভারত-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের জন্য ভারতে এলেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সম্ভবত এটা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ভারত ও চিনের পারস্পরিক সম্পর্কের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে মস্কো এই দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম। গত কয়েক বছরে সম্পর্কের যে ক্ষতি হয়েছে পুতিনের সফরকে তা মেরামত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ রাশিয়া ও ভারত একে অন্যের থেকে দূরে চলে গিয়েছে।

আড়ম্বর এবং দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা পত্র (এমওইউ) ও চুক্তির সংখ্যা দিয়ে দেখলে পুতিনের ভারত সফর দু’‌দেশের সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য কিছুটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে দুই নেতা তাঁদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ‘‌দীর্ঘস্থায়ী অগ্রগতিতে সন্তুষ্টি’‌ প্রকাশ করেছেন, যার বৈশিষ্ট্য হল ‘বিশেষ এবং অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারি’‌। ভারত ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ও বিদেশ মন্ত্রীদের নিয়ে দুই দেশ প্রথম ২+২ মন্ত্রী–পর্যায়ের সংলাপের সূচনাও করেছে। সফরের সময় সামরিক ও সামরিক-প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি কমিশনের একটি বৈঠকও হয়।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে দুই নেতা তাঁদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ‘‌দীর্ঘস্থায়ী অগ্রগতিতে সন্তুষ্টি’‌ প্রকাশ করেছেন, যার বৈশিষ্ট্য হল ‘‌বিশেষ এবং অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারি’‌।

এত ধুমধাম সত্ত্বেও ভারত ও রাশিয়া তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ স্ববিরোধগুলোর সমাধান খুঁজে পেয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। শীর্ষ বৈঠকের পরে ৯৯ পয়েন্ট যৌথ বিবৃতিতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার অগ্রগতির জন্য অসামরিক পারমাণবিক ও মহাকাশ, প্রতিরক্ষা, পরিবহণ ও সংযোগ সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র তুলে ধরা হয়েছে।

রাশিয়ার জন্য চিন সর্বাত্মক কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে পশ্চিম থেকে মস্কোর বিচ্ছিন্নতার পটভূমিতে। কিন্তু ভারতের জন্য চিন একটি প্রাথমিক বিপদস্বরূপ হয়ে উঠেছে, আর কিছু দিন আগে ভারতের এখন–প্রয়াত চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত সে কথা বলেওছিলেন। এর ফলে ভারতের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত অংশীদারি গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই অন্য দেশগুলোর মধ্যে আছে অস্ট্রেলিয়া ও জাপান, যারা চিনের থেকে একই রকম বিপদ আসতে পারে বলে মনে করে। কিন্তু অন্যদিকে, এর ফলে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, যদিও এই দু’‌দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, এবং সেই সঙ্গেই রাশিয়া-ভারত-চিন (আরআইসি)‌ গোষ্ঠীর মতো ত্রিপাক্ষিক এবং ব্রিক্‌স ও সাংহাই সহযোগিতা সংগঠন (এসসিও)-এর মাধ্যমে এই দুই দেশের বৃহত্তর যোগাযোগও আছে। ভারত-রাশিয়ার এই যোগাযোগ সম্পর্কের অ–মসৃণতা দূর করার পক্ষে যথেষ্ট হবে কিনা তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়।

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও চিন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-রাশিয়ার মতপার্থক্য এই দুই দেশের সম্পর্কের একটি তাৎপর্যপূর্ণ সীমাবদ্ধতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালে বার্ষিক শীর্ষ বৈঠক বাতিল হওয়ার ঘটনাই তাদের বহু দশকের পুরনো সম্পর্কে এখনকার জটিলতার প্রতিফলন। ভারতের বিদেশমন্ত্রক বলেছিল কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে শীর্ষ সম্মেলন বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু যে হেতু অন্যান্য আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলন ও বৈঠক ২০২০ সালে ভারচুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাই শীর্ষ সম্মেলন পুরোপুরি বাতিলের ব্যাখ্যাটি পুরোটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না।

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও চিন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-রাশিয়ার মতপার্থক্য এই দুই দেশের সম্পর্কের একটি তাৎপর্যপূর্ণ সীমাবদ্ধতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, সেই সময়ে একটি ভারতীয় সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে ‘‌ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় উদ্যোগ ও কোয়াডে যোগদানের জন্য নয়াদিল্লি সম্পর্কে [মস্কোর] গুরুতর আপত্তির কারণে’‌ শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়নি। রাশিয়ার বিবৃতি এবং ভারতের পাল্টা বিবৃতি থেকে সম্পর্কের এই সমস্যাগুলো প্রকাশ্যে এসেছে। রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বার্ষিক রাইসিনা সংলাপের সময় ভারতের ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীতি ও কোয়াডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে তাঁর মতামত বেশ খোলামেলা ভাবে জানিয়েছিলেন। গত বছরেই পরবর্তী সময়ে, ডিসেম্বরে রুশ আন্তর্জাতিক বিষয় পরিষদের একটি সাধারণ সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘‌ভারত বর্তমানে পশ্চিমী দেশগুলির অবিরত, আক্রমণাত্মক, ও বিভ্রান্তিকর নীতির কবলে পড়েছে যারা তাকে চিন-বিরোধী খেলায় টানার চেষ্টায় নিয়ে এসেছে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল, তথাকথিত ‘‌কোয়াড’-এ‌, এবং একই সঙ্গে পশ্চিমীরা ভারতের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ অংশীদারি ও বিশেষ সম্পর্ককে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।”

এই বিবৃতির জবাবে সাধারণত–সতর্ক ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক এই বলে প্রতিক্রিয়া জানায় যে ভারত সব সময়েই নিজের স্বাধীন বিদেশনীতি বজায় রেখেছে, যার ভিত্তি তার নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ, এবং ভারতের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দৃষ্টিভঙ্গি কোনও নির্দিষ্ট দেশের কথা ভেবে তৈরি হয়নি। ভারত আরও বলেছে যে একটি নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্ক অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার সম্পর্কের থেকে স্বতন্ত্র, এবং তা অবশ্যই সকলের বোঝা উচিত।

রাজনৈতিক মতপার্থক্য সমস্যার একটি দিক হলেও চিনকে রাশিয়ার উন্নত অস্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা প্ল্যাটফর্ম বিক্রি করা ভারতের জন্য উদ্বেগের আরেকটি বড় কারণ। গত কয়েক বছরে রাশিয়া চিনকে উন্নত কিলো-শ্রেণির সাবমেরিনের পাশাপাশি সু-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি করেছে, যা উল্লেখযোগ্য ভাবে চিনের পক্ষে সামরিক ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে।

ভারত তার প্রতিরক্ষা বাণিজ্য অংশীদারদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করা সত্ত্বেও রাশিয়া এখনও তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনও রাশিয়া এ ক্ষেত্রে আধিপত্য বজায় রেখেছে, কারণ ভারতীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের তালিকার প্রায় ৭0 শতাংশ তাদেরই।

এই চ্যালেঞ্জগুলো সত্ত্বেও, পুতিনের সফরের সময় ভারত ও রাশিয়া আউটার স্পেস, প্রতিরক্ষা, এবং উভয় দেশের সরকারি বিভাগগুলো ও বাণিজ্যিক সংস্থাসমূহের সঙ্গে জড়িত শক্তি–সুরক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৮টি সমঝোতা পত্র সই করেছে। সফরের সময় স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা পত্রগুলোর মধ্যে ছিল উত্তর ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের একটি উৎপাদন কেন্দ্রে ৬ লাখের মতো একে–২০৩ অ্যাসল্ট রাইফেল যৌথ ভাবে উৎপাদনের জন্য এখনকার একটি চুক্তি এবং ২০২১ থেকে ২০৩১ পর্যন্ত ১০ বছরের জন্য সামরিক সহযোগিতার একটি বর্ধিত চুক্তি। ভারত তার প্রতিরক্ষা বাণিজ্য অংশীদারদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করা সত্ত্বেও রাশিয়া এখনও তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনও রাশিয়া এ ক্ষেত্রে আধিপত্য বজায় রেখেছে, কারণ ভারতীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের তালিকার প্রায় ৭0 শতাংশ তাদেরই।

কাউন্টারিং আমেরিকা’‌জ আ্যাডভারসারিজ থ্রু স্যাংশন্‌স অ্যাক্ট–এর আওতায় নিষেধাজ্ঞার হুমকি সত্ত্বেও ভারত যে রাশিয়া থেকে এস–৪০০ কেনার পথে এগিয়ে গিয়েছিল, তা অবশ্যই পুতিনকে খুশি করেছে এবং ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের বাঁধুনি সম্পর্কে কিছুটা আশ্বস্তও করেছে। তা সত্ত্বেও চিনের কারণে সম্পর্কের স্ববিরোধগুলো অতিক্রম করা কঠিন হতে পারে। ইউক্রেনের সংকট যদি রাশিয়াকে পশ্চিম থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়, তা হলে এই সমস্যাগুলো আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.