দশকের পর দশক যাবৎ জোট সরকার এবং বিভক্ত জনমতের পর ভারত ২০১৪ সালে অবশেষে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার লাভ করে এবং ২০১৯ সালে আরও একবার এই সরকার ক্ষমতায় আসে। এবং এমনটা সম্ভব হয়েছিল কারণ একজন অনুপ্রাণিত নেতা নরেন্দ্র মোদী ভোটারদের সমসাময়িক যুগচেতনার সঙ্গে সফলভাবে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একজন নেতার ক্ষেত্রে দেশের মূল সুরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ‘আত্মন’-এর আত্মত্যাগের ক্ষমতা ভারতীয় ইতিহাসে বিরল, কিন্তু নজিরবিহীন নয়। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর ক্ষেত্রে আগেও এমনটা হয়েছে।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে বেদান্তের একজন বড় ভক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে স্বচ্ছ ভারত অভিযান বা অন্য যে কোনও ফ্ল্যাগশিপ কর্মসূচি প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদী প্রায়শই স্বামী বিবেকানন্দ এবং বেদান্ত শিক্ষার কথাগুলি তুলে ধরেছেন। প্রকৃতপক্ষে, গ্রিন গ্রিড ইনিশিয়েটিভ – ওয়ান সান ওয়ান ওয়ার্ল্ড ওয়ান গ্রিড (ওএসওডব্লিউওজি) – যে ধারণার কথা ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্সের (আইএসএ) প্রথম সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী মোদী প্রথমবার প্রস্তাব করেন এবং এই ধারণার লক্ষ্য হল এশিয়া, আফ্রিকা এবং পরবর্তী সময়ে সমগ্র বিশ্বকে সূর্য অর্থাৎ আধ্যাত্মিক পরম সত্তার (ব্রহ্ম বা ঈশ্বর) সমতুল্য শক্তির সঙ্গে সংযুক্ত করা।
উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র এবং ভগবদ্গীতার তিনটি প্রধান উৎস থেকে সংগৃহীত বেদান্তের অনেক অনুপম উপদেশ বর্তমান আধুনিক ভারতীয় প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতিকে পথ দেখায়।
মানুষের চেতনাকে প্রজ্জ্বলিত ও আলোকিত করার শক্তি প্রদান করে বেদান্ত বহু শতাব্দী ধরে ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রকে লালন-পালন করেছে এবং ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে স্থিতিস্থাপক ও গৌরবময় সভ্যতায় পরিণত করেছে। উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র এবং ভগবদ্গীতার তিনটি প্রধান উৎস থেকে সংগৃহীত বেদান্তের অনেক অনুপম উপদেশ বর্তমান আধুনিক ভারতীয় প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতিকে পথ দেখায়।
সর্বোচ্চ মতবাদের স্তরে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারত ‘সত্যমেব জয়তে’কে (শুধু সত্যেরই জয়) নিজের জাতীয় নীতিবাক্য হিসাবে গ্রহণ করে। এটি মুণ্ডক উপনিষদের বৈদান্তিক ভাবধারায় নিহিত একটি মন্ত্র। আর একটি ‘মহাবাক্য’ (মহান উচ্চারণ) হল ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ (বিশ্ব একটি পরিবার), যা ‘মহা উপনিষদ’ থেকে গৃহীত এবং যেটিকে প্রধানমন্ত্রী মোদী ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কূটনীতির ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই নীতিটি মোদীর প্রতিবেশ প্রথম (নেবারহুড ফার্স্ট) নীতি এবং ভ্যাকসিন মৈত্রীতে স্পষ্টভাবে নিহিত রয়েছে, বিশেষ করে উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধকে ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা বা জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে রাখার ক্ষেত্রে। ভারতের বিদেশনীতির নানা দিক, যেমন পঞ্চশীল, বহুবিন্যাস, অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক এবং উস্কানির মুখে কৌশলগত সংযম একটি বেদান্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয় দেয়।
বেদান্তের প্রভাব ভারতের আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক নীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ভারতীয় রাজনৈতিক ও কৌশলগত সংস্কৃতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। যেমন বেদান্তের অদ্বৈত মতাদর্শে উল্লিখিত ব্রহ্মের সঙ্গে মানুষের স্বতন্ত্র আত্মার (আত্মন) সমার্থকতা ভারতে বেদান্তচর্চাকারীদের অপরিসীম আশ্বাস ও সীমাহীন আধ্যাত্মিক শক্তি জুগিয়েছে এবং যুগ যুগ ধরে ভারতকে তীব্র সামাজিক-রাজনৈতিক এবং মানবিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’র (আমিই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর) বেদান্তবাদী প্রবাদটি চিন্তাবিদ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বিপ্লবী নেতাদের অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছে এবং দীর্ঘ প্রতিবন্ধকতার মুখে একটি প্রাচীন সভ্যতাকে স্থিতিস্থাপকতা জুগিয়েছে। এটি ভারতীয় কৌশলগত চিন্তাভাবনাকে বিপত্তির ঊর্ধ্বে উঠে আশাবাদী হয়ে উঠতে সক্ষম করেছে।
‘অহম ব্রহ্মাস্মি’র (আমিই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর) বেদান্তবাদী প্রবাদটি চিন্তাবিদ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বিপ্লবী নেতাদের অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছে এবং দীর্ঘ প্রতিবন্ধকতার মুখে একটি প্রাচীন সভ্যতাকে স্থিতিস্থাপকতা জুগিয়েছে।
বেদান্ত মতাদর্শের গভীরতা ভারতের দেশীয় চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি অমোঘ চিহ্ন রেখে গিয়েছে। বেদান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় সমাজে বিস্তৃত হয়েছে এবং সমাজকে সম্প্রদায়চালিত চিন্তাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। ভারতের যৌগিক সমাজ এবং বহু শতাব্দী ধরে বিদেশি মতাদর্শিক ও ধর্মীয় ধারার সাংস্কৃতিক আত্তীকরণই এর যথেষ্ট প্রমাণ। একজন স্বতন্ত্র ভারতীয়ের জন্য চেতনার সর্বোচ্চ রূপ হল ‘ভারতীয়’ হওয়ার সচেতনতা এবং স্বতন্ত্র বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সভ্যতার নীতির অন্তর্গত হওয়া। এটি ব্রহ্মের আত্মার সংমেল স্বরূপ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বেদান্তের উপদেশগুলি জাতি, ভাষা বা ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র জাতিকে আলোড়িত করেছিল, ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে উত্সাহিত করেছিল এবং মানবতার একটি বিশাল অংশের অপার সম্ভাবনাকে উন্মোচন করেছিল। যদিও এই রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন প্রথমে আধ্যাত্মিক পরিসরেই নিজেকে প্রকাশ করে। আত্মসচেতনতার চেতনার উদ্ভব করে বেদান্ত দর্শন ১৯ শতকের অনেক সংস্কার আন্দোলনকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, যেমন রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্ম সমাজ, দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্য সমাজ, বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণ মিশন এবং অন্যান্য। এটি অরবিন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পাশাপাশি বালগঙ্গাধর তিলক এবং লালা লাজপৎ রাইয়ের মতো অগ্নিদীপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রাজনীতিকেও আলোকিত করেছিল। এটি মহাত্মা গান্ধীর পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভভাই পটেলের মতো অহিংসবাদীদের দর্শনকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। এমনকি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো শ্রেণিহীন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী মতাদর্শীদেরও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
ভারতের বর্তমান বিশ্বচেতনা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেদান্তের ‘অদ্বৈত’ ভাবধারা দ্বারা ব্যাখ্যাত সর্বব্যাপী আন্তঃসম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং, ‘স্বরাজ্য’ ধারণাটি একইসঙ্গে একটি আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক ধারণা। পরম সত্তা বা ব্রহ্মের সঙ্গে একত্র হওয়ার যাত্রায় স্বতন্ত্র আত্মার উত্তরণ এটিকে অন্য কোনও বাহ্যিক কারণের উপর নির্ভরতা থেকে মুক্তি দেয়। আত্মা ‘স্বনির্ভর ও স্বশাসিত’ বা ‘স্বরাজ্য’ অবস্থায় ব্রহ্মের সঙ্গে সংযোগ অনুভব করে। এটি একটি আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির সঙ্গে সমান। ভূ-কৌশলগত স্তরে স্বরাজ্য ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে সংজ্ঞায়িত করে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর অধীনে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ একই রকম আর একটি ধারণা। এটি একটি আন্তঃসম্পর্কের বাস্তবতাকে অস্বীকার না করে, ভারতের অর্থনৈতিক যাত্রায় স্বাধীনতা বা স্বরাজ্যকেই বোঝায়, যেখানে বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন আদতে একটি সম্মিলিত বৈশ্বিক লক্ষ্য।
স্বরাজ্য সর্বোদয়ের (সকলের মুক্তি) গান্ধীবাদী আদর্শের দিকেই পরিচালিত করে। যখন জাতিগুলি ব্যক্তির মতো স্বাধীন হয় এবং মানবতার বৃহত্তর লক্ষ্যগুলির সঙ্গে প্রতীকীভাবে সংযুক্ত থাকে, তখন এটি আত্মনির্ভরশীলতার একটি চেতনা জাগিয়ে তোলে, যা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক জনসাধারণের সন্ত্রাস দমন, দূষণহীন শক্তি, স্থিতিস্থাপক সরবরাহ শৃঙ্খল, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ত্রাণ এবং মানবিক সহায়তার মতো বিষয়গুলির প্রতি বৃহত্তর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সহাবস্থান করার কথা বলে।
‘স্বরাজ্য’ ধারণাটি একইসঙ্গে একটি আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক ধারণা। পরম সত্তা বা ব্রহ্মের সঙ্গে একত্র হওয়ার যাত্রায় স্বতন্ত্র আত্মার উত্তরণ এটিকে অন্য কোনও বাহ্যিক কারণের উপর নির্ভরতা থেকে মুক্তি দেয়।
মোদীর বৈদেশিক নীতি এবং বাহ্যিক সম্পৃক্ততাকে সূচিত করে এমন বৈদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দেশগুলিকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে আরও স্বাধীন করে তুলতে পারে। এই উপদেশগুলি বিশ্বকে সর্বোদয় অর্জন করার শিক্ষা দিতে পারে। তারা একই সঙ্গে দেশপ্রেমিক এবং সর্বজনীনতাবাদী হওয়ার দ্বৈত মনোভাবের সহাবস্থান ঘটায় অথবা ভারতের ক্ষেত্রে যেমন সক্রিয় বৈশ্বিক ভূমিকার পাশাপাশি আত্মনির্ভরতার সূচনা ঘটেছে। যেমন মহাত্মা গান্ধী নিজেই বলেছেন, ‘আমার জাতীয়তাবাদ আমার স্বদেশির মতোই বিস্তৃত। আমি ভারতের উত্থান চাই যাতে সমগ্র বিশ্ব উপকৃত হয়।’ একই সুর অনুরণিত হয়েছে ২০২১ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর ৭৬তম রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষণে, যখন তিনি বলেন যে, ‘ভারতের বৃদ্ধি হলে বিশ্বেরও বৃদ্ধি হবে; ভারতের সংস্কার বিশ্বের রূপান্তর ঘটাবে।’
বেদান্ত সাহিত্য যুগ যুগ ধরে ভারতীয় কূটনীতি এবং যুদ্ধের জন্য একটি শক্তিশালী নির্দেশিকা প্রদান করেছে। কৌশলগত ক্ষেত্রে বেদান্তগ্রন্থই ধর্মযুদ্ধ বা ‘জাস্ট ওয়ার থিওরি’র (জুস বেলুম জুস্তুম) আদর্শ প্রদান করে। উপনিষদে প্রদত্ত ‘অহিংসা’র শিক্ষাকে ভগবদ্গীতার শিক্ষার আলোকে দেখলে, নিরঙ্কুশ আদেশ বলে মনে হয় না। যখন ধর্ম (ধার্মিকতা) বিপর্যস্ত হয় এবং যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে, ভগবদ্গীতা ধার্মিকদের ধর্ম রক্ষায় অস্ত্রের আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি দেয়। এর একটি উৎকৃষ্টতম উদাহরণ হল ভারতের সীমান্তে চিনের আগ্রাসী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারতের দৃঢ় প্রতিক্রিয়া।
বেদান্তবাদী ধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ ভগবদ্গীতা সামরিক অধ্যয়নের জন্য অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। এটি ‘কর্ম’ বা কর্মের মাধ্যমে মোক্ষের সূচনা করে, ঠিক যেমন এটি অর্জুনকে একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ‘সাত্ত্বিক কর্মযোগী’ হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেছিল অর্থাৎ এমন একজন যিনি ‘রাজসিক’ (স্বার্থপর চাহিদা এবং আগ্রাসন) বা ‘তামসিক’ (অন্ধ আবেগ – নিষ্ক্রিয়তা বা অজ্ঞতা) সত্তা দ্বারা চালিত নন, বরং সত্যকে পুনরুদ্ধার করতে এবং একটি উচ্চতর উদ্দেশ্যের জন্য লড়াই করার ধার্মিক প্রেরণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ।
এটি মাতৃভূমির জন্য কর্তব্যের ধারণার প্রতি অঙ্গীকারের মূল্যস্বরূপ একটি সাত্ত্বিক নীতি যা আজ ভারতের একাধিক নীতি ও পদক্ষেপকে পথ দেখায়। এটি এমন এক মহান ভারতীয় ঐতিহ্যের অংশ, যার বিস্তৃত প্রশস্তি প্রয়োজন।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল নিউজ ১৮-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.