২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কায় গুরুত্বপূর্ণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে চলেছে এবং দ্বীপদেশটি গভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্মুখীন হওয়ার পর থেকে এই নির্বাচন প্রথম। পূর্ববর্তী নির্বাচনের তুলনায় এই নির্বাচনটি আরও প্রতিযোগিতামূলক এবং এতে সর্বাধিক সংখ্যক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছেন। এ বছর মোট ৩৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সরেজমিনে দেখলে মনে হচ্ছে, বামপন্থী মনোভাবাপন্ন অনুরা দিসানায়েকে এগিয়ে রয়েছেন এবং অন্যদের তুলনায় তাঁর একটি সুবিধা রয়েছে, যদিও তা বিজয়ে রূপান্তরিত না-ও হতে পারে। ভারত - যে সঙ্কটের সময় দেশটিকে সহায়তা করেছে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে উন্নতির সাক্ষী থেকেছে - যে কোনও আগত সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে ইচ্ছুক। যাই হোক, দিল্লিকে এই আগত সরকারের সঙ্গে তার সুনামকে কাজে লাগানোর পথ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ ভারতের সহায়তার প্রয়োজনীয়তা এখন দ্বীপরাষ্ট্রে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখা হচ্ছে।
এগিয়ে রয়েছেন অনুরা
বর্তমান নির্বাচনে চারজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী রয়েছেন: ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার-জনতা বিমুক্তি পেরামুনা-র (এনপিপি-জেভিপি) অনুরা দিসানায়েকে; সামগী জানা বালাওয়েগয়া-র (এসজেবি) সজিত প্রেমদাসা; ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি-র (ইউএনপি) রনিল বিক্রমসিংহে যিনি স্বতন্ত্র ভাবে প্রার্থী হয়েছেন; শ্রীলঙ্কা পোড়ুজানা পেরামুনা-র (এসএলপিপি) নমাল রাজাপক্ষে। ইনস্টিটিউট ফর হেলথ পলিসি-র (আইএইচপি) অগস্ট মাসের সমীক্ষা অনুসারে, অনুরা এগিয়ে রয়েছেন; তার পরেই রয়েছেন সজিত এবং রনিল। এই প্রতিবেদনের মূল সুর মানুষের বাস্তব-ভাবনার চাইতে খুব বেশি পৃথক নয়। অনুরা তাঁর স্বাভাবিক তিন শতাংশ ভোটের ভিত্তির বাইরে গিয়ে যুবক, শ্রমিক শ্রেণি, শিক্ষক এবং বামপন্থী ঘরানার মানুষের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। জনপ্রিয়তার এই বৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে দু’টি কারণ:
অনুরার জনপ্রিয়, অভিজাত-বিরোধী এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রচার তাঁকে দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত ও তাঁদের মূলধারার দলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করা এক চিরাচরিত বহিরাগত হিসেবে তুলে ধরেছে।
অনেক ভোটারের কাছে অনুরা হলেন ২০২২ সালের আরাগালায়া আন্দোলনের (পদ্ধতিগত পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম) একটি মূর্ত প্রতীক, যেটি রনিল বিক্রমসিংহে দেশের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থমকে গিয়েছিল। অনুরার জনপ্রিয়, অভিজাত-বিরোধী এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রচার তাঁকে দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত ও তাঁদের মূলধারার দলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করা এক চিরাচরিত বহিরাগত হিসেবে তুলে ধরেছে। তিনি দুর্নীতি হ্রাস করা, রাজনীতিবিদদের জবাবদিহি করা, বেসরকারিকরণের বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে শক্তিশালী করা, সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের জনবাদী ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন। তা ছাড়া এই নির্বাচনে যেহেতু চার জন উল্লেখযোগ্য প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাই অনুরার জেভিপি ব্যতীত – যার মাত্র তিন জন এমপি পার্লামেন্টে রয়েছেন – দেশের একাধিক মূল ধারার দলের নেতৃত্ব ও আনুগত্য ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। এই হর্স ট্রেডিং বা ক্ষমতা কেনাবেচার পরিস্থিতি মূল ধারার দলগুলির প্রতি ভোটারদের আস্থা খর্ব করেছে। এই বিষয়ে অনুরাকে একটি ব্যতিক্রম বলে মনে করা হয়। তিনি এমন একজন বহিরাগত, যিনি দুর্নীতির শৃঙ্খল থেকে বিরত থাকতে পারেন এবং সুশাসন এনে দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার অনুকূল সমাধান দিতে পারেন। এর ফলস্বরূপ, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে তাঁর সমাবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনকি সেই অঞ্চলেও তাঁর সমাবেশের সংখ্যা বেড়েছে, যেখানে অতীতে তাঁর দলের কোনও শক্ত ঘাঁটিই ছিল না।
দ্বিতীয়ত, তাঁর ভোটারদের ভিত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অন্য দলগুলির মধ্যে ক্রমশ বিভাজন প্রকাশ্যে আসছে। ১৯৭০ এবং ৮০-র সময়কালে তাঁর দলের নেতৃত্বে হওয়া অভ্যুত্থানের প্রায় কোনও স্মৃতি না থাকা যুব সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও তিনি সমর্থন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, দেশে এক মিলিয়ন নতুন ভোটার-সহ তাঁর দল অন্যদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া এসএলপিপি-র প্রতি ব্যাপক মোহভঙ্গ এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে দলটির ভূমিকার কারণে সিংহলি ভোটারদের ভিত্তি জেভিপি-কে সমর্থন করতে পারে। অন্য দিকে, ২০২০ সালে ইউএনপি বিভক্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তী কালে এসজেবি গঠনের ফলে তামিল ও মুসলমানদের ভোটও বিভক্ত হয়ে যায়, যাঁরা দেশের জনসংখ্যার যথাক্রমে ১১ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ জুড়ে রয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, তামিল দলগুলির ক্ষেত্রে সিলোন ওয়ার্কার্স কংগ্রেস রনিলকে সমর্থন করছে এবং ফেডারেল পার্টি বা আইটিএকে সজিত প্রেমদাসাকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একই ভাবে, মুসলিম নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেস রনিল বিক্রমসিংহের পাশে রয়েছে এবং অন্য দিকে শ্রীলঙ্কা মুসলিম কংগ্রেস সজিত প্রেমদাসাকে সমর্থন করেছে। সাধারণ তামিল প্রার্থী পি আরিয়ানেথ্রান ছোট তামিল দলগুলি দ্বারা সমর্থিত হওয়ার দরুন কিছুটা (সীমিত) পরিমাণে হলেও ভোট বণ্টন হবে। এটি আবার অনুরা এবং তাঁর দলের জন্য একটি সুবিধা বটে।
এই নির্বাচনে যেহেতু চার জন উল্লেখযোগ্য প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাই অনুরার জেভিপি ব্যতীত – যার মাত্র তিন জন এমপি পার্লামেন্টে রয়েছেন – দেশের একাধিক মূল ধারার দলের নেতৃত্ব ও আনুগত্য ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে।
যাই হোক, জেভিপি-এনপিপি, এসজেবি এবং ইউএনপি-এর মধ্যে প্রতিযোগিতা এখনও হাড্ডাহাড্ডি। অতীতে বিদ্রোহের ক্ষেত্রে জেভিপি-র ভূমিকার কারণে বয়স্ক মানুষজন এখনও একেডি-কে নিয়ে সন্দিহান। তামিল এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদের ঐতিহ্যগত ভোটার ভিত্তিও এসএলপিপি-র সঙ্গে তাঁর পূর্ববর্তী জোটের কারণে তাঁকে ভোট দিতে দ্বিধাগ্রস্ত। অনেক শিক্ষিত এবং শহুরে ভোটারদের জন্য অনুরার প্রতিশ্রুত আমূল পরিবর্তনের বদলে রনিলের নীতির ধারাবাহিকতা বা সজিতের মধ্যপন্থী অবস্থান অবশ্য সময়ের প্রয়োজন। এমনকি নমালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্তের লক্ষ্য সম্ভবত তাঁর মূল ভোটার ভিত্তি ধরে রাখা এবং অনুরা বা অন্য প্রতিযোগীদের ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখার নামান্তর। এর ফলস্বরূপ, এটি সম্ভবত প্রথম বারের মতো হতে পারে যে, কোনও প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য ৫০ শতাংশের ব্যবধান সুনিশ্চিত করতে পারবেন না এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দগুলি সে ক্ষেত্রে ফলাফল নির্ধারণ করতে পারে।
ভারতের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলা
আসন্ন নির্বাচনের অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত একটু সামলে চলার নীতি গ্রহণ করেছে। ভারত আসন্ন নির্বাচনকে সম্পূর্ণ রূপে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে এবং অতীতে সংস্কার ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ-বিরোধী মতাদর্শের জন্য উগ্র আহ্বান সত্ত্বেও জেভিপি- সহ যে কোনও আগত সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে ইচ্ছুক। এর ফলস্বরূপ, ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সাম্প্রতিক মাসগুলিতে দল নির্বিশেষে প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এই হিসেবি পদক্ষেপ এবং ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দ্বারা সৃষ্ট সদিচ্ছা কোনও ভারতবিরোধী বক্তব্যের শিকার হয়নি, যে বক্তব্য সাধারণত নির্বাচনের সময় ফুলেফেঁপে ওঠে।
অনেকেই ভারতীয় সহায়তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং বিশ্বাস করেন যে, পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার আরও ভাল ভাবে সংযোগ স্থাপন করার পাশাপাশি সম্পৃক্ত হওয়া উচিত।
তবুও, ব্যক্তিগত ভাবে ভারতের দ্বারা সৃষ্ট সদিচ্ছা একটি তীব্র বিতর্কের বিষয়, বিশেষ করে সুশীল সমাজে, যাঁরা এখনও তাঁদের রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি অসন্তুষ্ট। অনেকেই ভারতীয় সহায়তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং বিশ্বাস করেন যে, পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার আরও ভাল ভাবে সংযোগ স্থাপন করার পাশাপাশি সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। তবে দেশের ইতিহাস ও জটিল রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সহায়তা ও ঋণ এবং পরবর্তী সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার বিষয়টিকে সুবিধাবাদী ও শ্রীলঙ্কাকে অসুবিধায় ফেলার চক্রান্ত বলে অনেকে মনে করেন। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলিতে বিনিয়োগের জন্য ভারতীয় সংস্থাগুলি্র অন্যদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, শ্রীলঙ্কা দাবি করছে যে, ভারত অভিবাসন সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এই দাবি সহায়তা সত্ত্বেও ভারত ও ভারতীয় বিনিয়োগের প্রতি বিরূপ মনোভাবকেই দর্শায়। কলম্বো যখন পুরনো ঋণ পরিশোধের জন্যই রীতিমতো সংগ্রাম করছে, তখন কেউ কেউ ভারতের কাছ থেকে ফের নতুন ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং পরবর্তী সময়ে চিনা ঋণের চাপ নিয়েও এ ধরনের সংশয় বেড়েছে। অবশেষে, কিছু ভারতীয় প্রকল্পেরও রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এর লক্ষ্য ছিল স্বচ্ছতার অভাব এবং দুর্নীতির প্রচারের জন্য শ্রীলঙ্কা সরকারের সমালোচনা করা।
উপসংহার
অত্যন্ত মেরুকৃত এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে অনুরা বর্তমানে এগিয়ে রয়েছেন এবং অন্যদের থেকে তিনি ৩ শতাংশ ভোটার ভিত্তির চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছেন। তবে ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই অনিশ্চয়তার সংক্ষিপ্তসার হিসেবে একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন যে, ‘সমাবেশ এবং অনলাইন ভোটে ভিড় চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করে না – শুধু মাত্র ২১ তারিখে ভোটারদের মতামতেই তা নির্বাচিত হবে।’ ভারত এই অনিশ্চয়তা সম্পর্কে সচেতন বলে মনে হচ্ছে। যে-ই ক্ষমতায় আসুন না কেন, ভারত তাঁর সঙ্গেই কাজ করতে ইচ্ছুক। যাই হোক, ভারতকে বিপদসীমা পুনরায় নির্ধারণ করতে হবে এবং নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাব্য উপায়গুলি অন্বেষণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সুশীল সমাজের দ্বারা বিভিন্ন ভাবে উপলব্ধি করা সত্ত্বেও ভারতকে শ্রীলঙ্কায় তার সুনাম ফের সুদৃঢ় করতে হবে।
আদিত্য গৌদারা শিবমূর্তি অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.