ভারত এবং ব্রিটেনের সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের পর ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আদতে আখ্যানটি লোভনীয় হলেও — সাম্প্রতিক নির্বাচন, বিশেষ করে ব্রিটেনের সরকারে পরিবর্তন ঘটার পর, যা এই সম্ভাবনার পথে সবচেয়ে বড় অনুঘটকের কাজ করেছে — বাস্তবতা আরও জটিল।
মোদীর শাসনের ১০০ দিন: তৎপরতার এক নতুন অনুভূতি?
২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রাইম মিনিস্টার বরিস জনসন কোনও এক মুহূর্তে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ভারতের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য চুক্তি ‘দীপাবলীর মধ্যে’ সম্পূর্ণ হবে। এখন জনসনের প্রতিশ্রুতি ফাঁপা কলসির আওয়াজের মতো শোনালেও এটি ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পুনর্মূল্যায়নে কনজারভেটিভদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেই দর্শায়। তিন ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার এবং ১৪ দফার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরেও এখনও পর্যন্ত চুক্তিটি অধরাই রয়ে গিয়েছে। তবুও উভয় শিবিরে ইতিবাচক স্বর শোনা যাচ্ছে। এবং তা এতটাই জোরালো যে, নির্বাচন-পরবর্তী ভারত সরকারের প্রাথমিক ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনায় এফটিএ শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে।
ব্রিটেন এবং ভারতে সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনগুলি প্রক্রিয়াটিকে পিছিয়ে দিলেও এফটিএ-র ভাগ্য নির্ধারণে সেগুলিই শুধু মাত্র নির্ণায়ক বিন্দু নয়। মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার পূর্ববর্তী ১৪ দফার আলোচনায় ধারাবাহিক ভাবে অংশগ্রহণ করলেও ব্রিটেনের নির্বাচনের ফলাফল সমীকরণ এবং আলোচনার টেবিলে মুখের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তবে এমনটা হলেও এর ফলে আলোচনার মূল সারবত্তা বদলে যায়নি।
ব্রিটেন এবং ভারতে সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনগুলি প্রক্রিয়াটিকে পিছিয়ে দিলেও এফটিএ-র ভাগ্য নির্ধারণে সেগুলিই শুধু মাত্র নির্ণায়ক বিন্দু নয়।
ভারতীয় সরকারগুলি বরাবরই বাণিজ্য আলোচনার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করেছে এবং প্রায়শই একটি পরিমিত, সংরক্ষণশীল মনোভাব দর্শিয়েছে। ইউরোপিয়ান ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন-এর (ইএফটিএ) সঙ্গে ভারতের ১৬ বছর ব্যাপী আলোচনা এবং তার পরবর্তী চুক্তি একটি উদাহরণ। যাই হোক, মোদী প্রশাসন আলোচনার গতিতে বদল এনেছে এবং এক নতুন উদ্যম ও তৎপরতা দর্শিয়েছে, যা সাম্প্রতিক কালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হওয়া বাণিজ্য চুক্তিতে স্পষ্ট। বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে নয়াদিল্লি তার সংরক্ষণবাদী ভাবমূর্তি আংশিক ভাবে ঝেড়ে ফেলে আরও বেশি বাণিজ্যবান্ধব পরিবেশের দিকে ধাবিত হয়েছে। এর পাশাপাশি নিজেকে আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলে আরও ভাল ভাবে সমন্বিত করতে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে রফতানির পরিমাণকে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে তৎপর হয়েছে।
লেবার দলের জন্য সুযোগ
টোরিদের জন্য এফটিএ-কে ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে এক বিজয় রূপে দেখা হয়, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত ব্রিটেনের নতুন দর কষাকষির ক্ষমতাকেই তুলে ধরা। চারিত্রিক ভাবে এটি কখনওই তাদের নেতৃত্বের আওতায় বাস্তবায়িত হয়নি। জুলাইয়ের শুরুতে লেবার দলের অভূতপূর্ব বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্যার ক্যের স্টারমার এমন এক চুক্তির সুবিধে পেতে সমর্থ হন, যা আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল।
আটলান্টিক-ইউরোপীয় সম্পর্ক সশক্তিকরণের দিকে স্টারমারের ঝোঁক সম্পর্কে বাজারগত ধারণা সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে একটি এফটিএ বাস্তবসম্মত সুযোগেরই প্রতিনিধিত্ব করে। উভয় দেশে নির্বাচনের ঠিক আগে ব্রিটিশ সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর বিজনেস অ্যান্ড ট্রেড জোনাথন রেনল্ডস ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লেবার শ্যাডো সেক্রেটারি হিসাবে দিল্লি সফর করেন এবং ভারতের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তাঁর নতুন মেয়াদের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই তিনি এবং ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি ডেভিড ল্যামি - যিনি প্রাক-নির্বাচন সফরে রেনল্ডসের সঙ্গে এসেছিলেন – আরও এক বার নয়াদিল্লিতে সফরে এসেছেন, যা এফটিএ চূড়ান্তকরণের বিষয়ে লেবার দলের আগ্রহকেই দর্শায়।
এফটিএ আলোচনার বিষয়ে উভয় পক্ষের আলোচনা দীর্ঘকাল ধরেই ইতিবাচক থাকলেও বর্তমান সমীকরণ বিশেষ রকম আশাব্যঞ্জক। ব্রিটেন এবং ভারতের মধ্যে বর্তমান বাণিজ্যের আনুমানিক মূল্য বার্ষিক ৩৯ বিলিয়ন পাউন্ড (৪৯.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। অন্যান্য অনুমান অনুসারে, দুই দেশের মধ্যে একটি এফটিএ ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণকে দ্বিগুণ করে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে পারে।
সাফল্যের পথে বাধা
চুক্তির অন্তর্গত ২৬টি অধ্যায়ের মধ্যে অধিকাংশই মীমাংসিত হয়েছে অথবা সমাধানের দোরগোড়ায় রয়েছে। তবুও দীর্ঘমেয়াদি বিতর্কিত বিষয়গুলি বিদ্যমান।
চুক্তির অন্তর্গত ২৬টি অধ্যায়ের মধ্যে অধিকাংশই মীমাংসিত হয়েছে অথবা সমাধানের দোরগোড়ায় রয়েছে। তবুও দীর্ঘমেয়াদি বিতর্কিত বিষয়গুলি বিদ্যমান।
ভারতীয় কর্মীদের জন্য অভিবাসন, চলাচলের সুবিধে এবং একটি উদারপন্থী ভিসার ব্যবস্থা এফটিএ আলোচনায়, বিশেষ করে কনজারভেটিভ সরকারের অধীনে বাধা হয়ে উঠেছে। প্রাক্তন হোম সেক্রেটারি সুয়েলা ব্র্যাভারম্যানের মন্তব্য আলাপ-আলোচনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যখন তিনি বলছিলেন যে, ভারতীয় অভিবাসীরা ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভিসা ওভারস্টেয়ার (মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও সে দেশে থেকে যাওয়া)। লেবার প্রশাসন – যারা টোরিদের পঙ্গু করে দেওয়া অভিবাসনের আখ্যান দ্বারা কম প্রভাবিত – সমস্যা সমাধানের একটি সুস্পষ্ট পথ প্রদান করেছে।
ব্রিটেনের তরফে হুইস্কি এবং গাড়ির মতো পণ্যের উপর ভারতীয় শুল্ক হ্রাস করার চেষ্টা করা হয়েছে – যা বর্তমানে প্রায় ১০০-১৫০ শতাংশ। এ ছাড়াও ব্রিটেন তার আর্থিক, আইনি এবং অন্যান্য পরিষেবার ক্ষেত্রে ভারতীয় বাজারে আরও বেশি করে প্রবেশাধিকার পেতে আগ্রহী। এই তিনটি ক্ষেত্রই ব্রিটিশ অর্থনীতির ৮০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি ভারতের জন্য বিদেশি প্রতিযোগিতাকে ঘরের মাটিতে এনে ফেলার আশঙ্কা সংক্রান্ত একটি চ্যালেঞ্জও বটে।
নয়াদিল্লির জন্য উঠে আসা আর একটি সাম্প্রতিক সমস্যা হল অর্থনৈতিক বোঝা সংক্রান্ত। যেমন ব্রিটেনের সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার জন্য অযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও জাতীয় বিমার জন্য অর্থ প্রদান, যা ব্রিটেনে অস্থায়ী ভাবে কর্মরত ভারতীয়দের উপর আরোপ করা হয়। এই ধরনের সমস্যাগুলি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দেশীয় নীতির ভারসাম্য বজায় রাখার বৃহত্তর চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরে।
সামনের পথ
আলাপ-আলোচনা নিজের পথে চললেও উভয় অংশীদারই একে অপরের অর্থনীতিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে এখনও রোডম্যাপ ২০৩০ অনুসরণ করতে পারে। ২০২১ সালে ব্রিটেনের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) বহির্মুখী স্টকের পরিমাণ ছিল ১৯.১ বিলিয়ন পাউন্ড (২৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যেখানে ব্রিটেনে ভারতের এফডিআই-এর পরিমাণ ছিল ৯.৩ বিলিয়ন পাউন্ড (১১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তা ভবিষ্যতে আরও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রবাহের বৃদ্ধিতে নিশ্চিত ভাবে সাহায্য করবে।
আলাপ-আলোচনা নিজের পথে চললেও উভয় অংশীদারই একে অপরের অর্থনীতিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে এখনও রোডম্যাপ ২০৩০ অনুসরণ করতে পারে।
ব্রিটেন-ভারত এফটিএ আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে। তাদের ১৪ বছর ব্যাপী শাসনের গোধূলি লগ্নে টোরিরা অন্যান্য অঞ্চলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হলেও এই সকল আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভাবেই এগিয়েছে। উভয় দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলি এক নতুন প্রণোদনা প্রদান করলেও সম্ভাব্য চুক্তির আসল চালিকাশক্তি হল কৌশলগত স্বার্থ এবং পূর্ববর্তী প্রশাসকদের করা কাজ। লেবার সরকারের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবশিষ্ট চ্যালেঞ্জগুলির মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাওয়ার সদিচ্ছা অবশেষে এফটিএ-কে ফলপ্রসূ করতে পারে, যা ব্রিটেন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলককে চিহ্নিত করে।
ব্রিটেনের ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে নতুন এফটিএ এখনও পর্যন্ত শুধু মাত্র অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডেই সফল ভাবে সমাপ্ত হয়েছে। তবে এই চুক্তিগুলি দেশের অভ্যন্তরে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে সেই সকল ব্রিটিশ কৃষকদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের শিল্পে প্রতিযোগিতামূলক চাপ নিয়ে উদ্বিগ্ন। উপরন্তু, খাদ্য নিরাপত্তার মান নিয়ে অমীমাংসিত সমস্যার কারণে এই বছরের শুরুতে কানাডার সঙ্গে আলোচনা ‘স্থগিত’ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপট সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তি সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের সম্মুখীন হওয়া চ্যালেঞ্জগুলিকে দর্শায় এবং ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান আলাপ-আলোচনার তাৎপর্য তুলে ধরে। সুতরাং, ভারত-ব্রিটেন এফটিএ একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি উভয় দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্যাস হিসাবে কাজ করে, যখন উভয় দেশই আগামী ভবিষ্যতে বিশেষ করে ইইউ-এর সঙ্গে আরও লাভজনক চুক্তি সাধন করতে চায়।
লিভ ভোটারদের জন্য – যাঁরা সার্বভৌমত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের দাবি করেছিলেন - ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্য আলাপ-আলোচনার জটিলতা বিশ্বব্যাপী আন্তঃসংযোগের অনুস্মারক স্বরূপ। লেবার দল সফল হলে তারা অর্থনৈতিক বাস্তববাদ এবং বৃদ্ধির পক্ষে তাদের প্রতিশ্রুতির উপর জোর দেবে এবং এটি দর্শাবে যে, ইইউ-বহির্ভূত দেশগুলির সঙ্গে সফল বাণিজ্য চুক্তিগুলি ইইউ-র সঙ্গে আরও সর্বাত্মক চুক্তির পথ প্রশস্ত করতে পারে।
যে কোনও চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ার আগে আরও একটি দীপাবলীর সময় পেরিয়ে গেলেও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের এক নতুন যুগের সূচনার লক্ষ্যে সমস্ত পদক্ষেপ সঠিক অভিমুখেই গৃহীত হচ্ছে। যদিও বিড়ম্বনাও অনিবার্য। অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে ব্রেক্সিট-পরবর্তী কনজারভেটিভদের এফটিএ সম্পন্ন করার স্বপ্ন – যা আট বছরের প্রতিশ্রুতি ও দুই বছরের আলোচনার পরেও অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল – লেবারদের দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই বাস্তবায়িত হতে পারে। এই সম্ভাব্য অভ্যুত্থান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের প্রতি লেবারদের প্রতিশ্রুতিকেই দর্শায়, যে দু’টি উপাদান লেবার দলের বৈদেশিক নীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নোয়া চেম্বারলেন ওআরএফ-এর রিসার্চ ইন্টার্ন এবং ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের কুইনস’ কলেজের ফাউন্ডেশন স্কলার।
শায়েরী মলহোত্র অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.