নেপালের বাম রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার কাজে রত চিন নেপালের নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত সন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে। ২০১৮ সালে চিন শুধু মাত্র কেপি শর্মা অলি এবং মাওবাদী সেন্টারের নেতা পুষ্প কমল দাহালের নেতৃত্বে সিপিএন-ইউএমএলকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করেনি, বরং দেশটি দুই দলের মধ্যে সমন্বিতকরণেও সহায়তা করেছিল এবং দলের নাম পরিবর্তন করে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (এনসিপি) রাখা হয়েছিল। যাই হোক, দুই দলের মধ্যে ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কারণ মাত্র তিন বছরের মধ্যে নেপালের সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের কারণে দু’টি পূর্ববর্তী দল, অর্থাৎ সিপিএন-ইউএমএল এবং মাওবাদী সেন্টার আলাদা হয়ে যায়। এই বছরের ৪ মার্চ বেজিং আবার সফল ভাবে সিপিএন-ইউএমএল ও মাওবাদী সেন্টারকে একত্রিত করে এবং তাদের একটি নতুন জোট সরকার গঠনে সক্ষম করে। এই প্রচেষ্টায় মাওবাদী সেন্টারকে নেপালের একক বৃহত্তম দল নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে তার ১৫ মাসব্যাপী জোট ছিন্ন করতে হয়েছিল এবং সিপিএন-ইউএমএল-এর সঙ্গে মিলে একটি নতুন সরকার গঠন করতে হয়েছিল, যা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দাহালের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল।
নেপালকে আকৃষ্ট করার জন্য চিন নেপালের সঙ্গে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সাংখুয়াসভা জেলার কিমাথাঙ্কা ট্রানজিট পয়েন্ট-সহ দেশটির সমস্ত অর্থাৎ ১৪টি বাণিজ্য পয়েন্ট পুনরায় খুলে দিয়েছে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পরে এই সীমান্ত পয়েন্টগুলি প্রায় চার বছর ধরে বন্ধ ছিল। সীমান্ত বন্ধ হওয়ার কারণে নেপালের উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী নেপালি ব্যবসায়ী, মরসুমি শ্রমিক এবং সীমান্তের বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। নেপালের উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী বেশির ভাগ সীমান্ত বাসিন্দারা জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা মেটাতে চিনের সীমান্তের ওপারের বাজারের উপর নির্ভরশীল। এই ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে নেপালে চিনা রাষ্ট্রদূত চেন সং বলেছেন, ‘এটি আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যকে ব্যাপক ভাবে বাড়িয়ে তুলবে এবং বাসিন্দাদের জীবিকা ও যোগাযোগ উন্নত করবে।’
নেপালে চিনই এফডিআই-এর সবচেয়ে বড় উৎস। নেপালে চিনা এফডিআই-এর মধ্যে রয়েছে হংশি শিবম সিমেন্ট, পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আপার ত্রিশূলি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং পশ্চিম সেতি বাঁধের মতো প্রকল্প। চিনা পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য কাঠমান্ডুর থামেল এবং পোখরা-সহ নেপালের প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে চিনা বিনিয়োগকারীরা বেশ কয়েকটি ছোট দোকানও খুলেছে। সম্প্রতি নেপালের তৃতীয় বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন (২৮-২৯ এপ্রিল) উপলক্ষে নেপাল চিনের সঙ্গে দু’টি সমঝোতাপত্র (মউ) স্বাক্ষর করেছে। নেপালের নেক্সট-জেন ম্যানেজমেন্ট সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড এবং চিনের এমএবিসি ইনভেস্টমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে প্রথম মউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর পাশাপাশি নেপালের ফেডারেশন অব নেপালিজ ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমার্স (এফএনআইসি) এবং চিনের ডংগুয়ান জিংলিয়াং লাইটিং প্রোডাক্ট কোম্পানি লিমিটেডের মধ্যে দ্বিতীয় সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়।
নেপালে চিনই এফডিআই-এর সবচেয়ে বড় উৎস। নেপালে চিনা এফডিআই-এর মধ্যে রয়েছে হংশি শিবম সিমেন্ট, পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আপার ত্রিশূলি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং পশ্চিম সেতি বাঁধের মতো প্রকল্প।
ইতিমধ্যে চিনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নেপালকে আশ্বস্ত করেছে যে, তারা চিনের সীমান্তবর্তী ১৫টি জেলায় বসবাসকারী নেপালিদের জন্য স্কুল, স্বাস্থ্য পরিষেবাপ্রদানকারী কেন্দ্র, সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নির্মাণের উদ্দেশ্যে নেপালকে পাঁচ বছরের জন্য অর্থ প্রদান করবে। এর আগে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সড়ক খাতে উত্তর নেপালের জনগণের জীবিকার সহায়তার জন্য ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চিন নেপালকে বার্ষিক ১.৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করেছে।
তা সত্ত্বেও, চিন নেপালের জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) অধীনে সিল্ক রোডস্টার নামে পরিচিত একটি নতুন মঞ্চ চালু করেছে। সেই অনুসারে, চিন নেপালে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান, বিদেশি অধ্যয়ন কর্মসূচির প্রচার, উদ্যোগগুলির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী ও বিনিময় পরিদর্শনের আয়োজন করতে নেপালে ছোট প্রকল্প চালু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়নে নেপালের রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনগুলির সম্পৃক্ততা প্রত্যাশিত।
চিন ঘোষণা করেছে যে, তারা ১ মে থেকে নেপালিদের জন্য ভিসা ফি ছাড় দেবে। চিন নেপালের পোখরা এবং ভৈরহাওয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাণিজ্যিক উড়ান চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সুপরিচিত পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি ২১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের চিনা অর্থায়ন দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং বিমানবন্দরটি ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চালু করা হয়েছিল। একই ভাবে, ভৈরহাওয়াতে গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি চিনা ঠিকাদারদের দ্বারা ৭৬.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণের সাহায্যে নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু যে বিমানবন্দরগুলিতে চিন সম্পৃক্ত ছিল, সেগুলিই আন্তর্জাতিক উড়ান পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে কেবল এই কারণে যে, ভারত এই জাতীয় কার্যকলাপের জন্য বিমান পথ সরবরাহ করেনি। এখন নেপালিদের এই ধারণা প্রদান করা হয়েছে যে, বিমান পথ সম্পর্কিত সমস্যাগুলির সমাধান ঘটবে, কারণ চিনা বিমান সংস্থাগুলি ভারতীয় মহাকাশে প্রবেশ না করেই নেপালের উত্তর এবং পূর্ব সীমান্ত পয়েন্টগুলি থেকে এই বিমানবন্দরগুলিতে প্রবেশ করবে এবং প্রস্থান করবে।
চিন ঘোষণা করেছে যে, তারা ১ মে থেকে নেপালিদের জন্য ভিসা ফি ছাড় দেবে।
নেপাল ২০১৭ সালের ১২ মে চিনের সঙ্গে বিআরআই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। প্রাথমিক ভাবে নেপাল বিআরআই-এর অধীনে ৩৫টি প্রকল্পের প্রস্তাব করেছিল, যা এখন ন’টিতে নেমে এসেছে। বিআরআই-এর অধীনে প্রধান প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে কাঠমান্ডু-কেরুং রেলওয়ে (২.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), রাসুওয়াগাধি-কাঠমান্ডু রোডের আপগ্রেডেশন বা সংস্কার, কিমাথাঙ্কা-হিল রোড এবং দিপায়েল থেকে দক্ষিণ চিন রোডের কাজ। এ ছাড়া নেপাল চায় যে, চিন যেন টোখা-বিদুর রোড, গলছি-রসুওয়াগাধি-কেরুং ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন, তামোর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, মদন ভাণ্ডারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফুকোট-কর্ণালি হাইড্রোপাওয়ারও বিআরআই-এর অধীনে নির্মাণ করে।
২৪ মার্চ থেকে ১ এপ্রিলের মধ্যে চিনে তাঁর সরকারি সফরের প্রাক্কালে নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রী নারায়ণ কাজী শ্রেষ্ঠা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে চিনাদের কাছে নেপাল-তিব্বত-চংকিং-সিচুয়ান ডেভেলপমেন্ট করিডোর বিকাশের প্রস্তাব করেছিলেন। চিনা পক্ষ কাঠমান্ডু থেকে লাসা পর্যন্ত সরাসরি বাস পরিষেবা পুনরায় চালু করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া নেপাল-চিন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিআরআই বাস্তবায়ন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ে একটি যৌথ কমিশন গঠনের জন্য দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়।
নেপাল-চিন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিআরআই বাস্তবায়ন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ে একটি যৌথ কমিশন গঠনের জন্য দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বছরের পর বছর ধরে চিন নেপালকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের আয়োজক হওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেছে। যাই হোক, এর আগে দুই দেশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রচারে এত সক্রিয় ছিল না, যতটা এখন দেখা যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের সহযোগিতা দুই দেশকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসছে। এই সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি যে, বর্তমান রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অধীনে দুই দেশের সম্পর্ক আরও উচ্চতায় পৌঁছে যাবে, বিশেষ করে যদি সমস্ত চুক্তি স্বচ্ছ ভাবে বাস্তবায়িত হয়… তা সে বিআরআই বাস্তবায়ন পরিকল্পনা হোক বা অন্যান্য কৌশলগত বিষয়। এই অঞ্চলের ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করে এই ধরনের পদক্ষেপ নেপালের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।
হরি বংশ ঝা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভিজিটিং ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.