ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যদি কোনও উন্নয়ন এই অঞ্চলের আধুনিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসাবে প্রমাণিত হয়, তা হলে তা নিশ্চিত ভাবে ২০২৪ সালের জুন মাসে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত সর্বাত্মক অংশীদারিত্বের চুক্তির ঘটনা। এই অংশীদারিত্বের পথ মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করেছে এবং তা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা পরিবর্তনের সূচনাকেই দর্শায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের ত্রিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়াকে সহযোগিতা করার আর একটি কৌশলগত কারণ দিয়েছে। সুতরাং, ইউরেশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিকের ভূ-রাজনৈতিক প্রান্তিকীরণের পরিবর্তনের দরুন গোটা বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির মতো জোটের উত্থান দেখা যাচ্ছে।
উত্তর কোরিয়া-রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক: যেখানে ভিত্তিপ্রস্তরের নাম সামরিকবাহিনী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক ঘূর্ণিঝড়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক একটি শক্তিশালী ভিত্তিতেই শুরু হয়েছিল এবং তা অনুসরণ করেই পিয়ংইয়ং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিনের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেছিল। তবে ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হলেও চিনের সঙ্গে সম্পর্কের পালে হাওয়া লেগেছিল। তা সত্ত্বেও, ২০০০-এর পরে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া ক্রমাগত বাধার মুখে নিজেদের সম্পর্ক স্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছিল। এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র বিকাশে উত্তর কোরিয়ার অনড় নীতির কথা বলা যায়, যা সে সময়ে এক ঘর্ষণ বিন্দু হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল। যাই হোক, ২০১৭ সালের পরে যখন রাশিয়ার বিদেশনীতি উত্তর কোরিয়া অভিমুখী হতে শুরু করে, তখন পরিস্থিতিও বদলাতে শুরু করে। রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব এশিয়া নীতি ইউক্রেন আক্রমণের দরুন এক আমূল সংস্কারের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, যখন ন্যাটো দেশগুলি দ্বারা সমর্থিত ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রাশিয়ার আরও অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল।
মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের ঘনিষ্ঠতা তাদের বিদেশমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠকের সংখ্যার ভিত্তিতেও বিচার করা যেতে পারে।
মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের নেপথ্যে কৌশলগত যুক্তি আগেকার অস্ত্র ও সরঞ্জামগুলির একটি অবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রয়োজনের কারণেই শুরু হয়েছিল এবং উভয় পক্ষই ইউরেশিয়া এবং ইন্দো-প্যাসিফিকে ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার পরিবর্তনের কারণে একটি কৌশলগত জোট গঠনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে। বাড়তে থাকা সম্পর্কগুলি এখন সামরিক সীমার ঊর্ধ্বে উঠে অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছে। সহযোগিতার সমস্ত ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে ও পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞার সীমিত প্রভাব উপলব্ধি করে রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া অংশীদারিত্ব ঘনিষ্ঠ প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও শ্রম গতিশীলতার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। উত্তর কোরিয়ার ১০,০০০ সৈন্য রাশিয়ায় মোতায়েন করার ঘটনা এ ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ যে, দুই দেশের মধ্যে এই অংশীদারিত্ব কতটা বিকশিত হয়েছে। দুই দেশের জোট এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, একটি মিত্র অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব (বা তার দাবি) রক্ষার জন্য নিজের সৈন্যও পাঠাতে প্রস্তুত। মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের ঘনিষ্ঠতা তাদের বিদেশমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠকের সংখ্যার ভিত্তিতেও বিচার করা যেতে পারে। গত বছর থেকে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং ডিপিআরকে বিদেশমন্ত্রী চো সান হুই ছ’বার বৈঠক করেছেন।
রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতার পরিধি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককেই দর্শায়। উত্তর কোরিয়া মস্কোকে ১৩,০০০ কন্টেনার অস্ত্র সরবরাহ করেছে, যার মধ্যে ৬ মিলিয়ন ১৫২ মিমি-র আর্টিলারি শেল রয়েছে। সম্প্রতি, জানা গিয়েছে যে, উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে দূরপাল্লার রকেট ও আর্টিলারি ব্যবস্থা সরবরাহ করেছে, এর মধ্যে রয়েছে পঞ্চাশটি ১৭০ মিমি এম১৯৮৯ স্বয়ংক্রিয় হাউইটজার এবং কুড়িটি ২৪০ মিমি রকেট লঞ্চার। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বলেছেন যে, ‘উত্তর কোরিয়া তার প্রায় ১০০০০ সৈন্যকে পূর্ব রাশিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছে... কিন্তু আমাদের সাম্প্রতিক তথ্য ইঙ্গিত করে যে, ডিপিআরকে সৈন্যদের মধ্যে প্রায় ৮,০০০ সৈন্য এখন কুরস্ক ওব্লাস্টে মোতায়েন করা আছে।’
প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সহযোগিতার পরবর্তী পর্যায়
দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিন ওন-সিক বলেছেন, তাঁরা বিশ্বাস করে যে, বস্তুগত সহায়তার বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান-বিরোধী প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম পেয়েছে। তবে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সমর্থন ছাড়াও উত্তর কোরিয়া মস্কোর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহ পেয়েছে। রাশিয়া এই বছরের মার্চ থেকে উত্তর কোরিয়াকে ১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল সরবরাহ করেছে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের বাধ্যতামূলক পাঁচ লক্ষ ব্যারেল তেলের মাত্রা লঙ্ঘন করেছে। প্রযুক্তি হল সহযোগিতার এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে দেশগুলি অভিন্ন স্বার্থ ভাগ করে নেয়। সুতরাং, আশা করা যায়, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হবে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া যৌথ ভাবে পিয়ংইয়ংয়ে একটি তথ্যপ্রযুক্তি এক্সপোর আয়োজন করেছে, যা প্রযুক্তি সহযোগিতাকে আরও গভীর করার বিষয়ে দুই দেশের তরফে অভিপ্রায়কেই দর্শায়।
উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে উন্নয়ন যতই সীমিত হোক না কেন, রাশিয়ায় উত্তর কোরিয়ায় সৈন্য মোতায়েনের বিষয়টিকে কেবল দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসাবে বিচার করলে ভুল হবে। বরং, এই উন্নয়ন বিশ্বব্যবস্থার বিদ্যমান পরিবর্তনকেও দর্শায়। মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি-সহ এই ঘটনাগুলি এই দেশগুলিকে বিশ্বের ভবিষ্যৎ, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিককে আকার দিতে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে সমমনোভাবাপন্ন দেশগুলির সম্মিলিত হওয়ার ঘটনাও স্পষ্ট হচ্ছে, যা উত্থানের অক্ষ হিসাবেও পরিচিত এবং এই অক্ষে রয়েছে চিন, ইরান , উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া।
চিন, ইন্দো-প্যাসিফিক ও বিশ্ব অক্ষের উত্থান
সামনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটি তার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে মনোযোগের কেন্দ্রে উঠে আসবে। সুতরাং ইন্দো-প্যাসিফিকের ভবিষ্যৎকে আরও ভাল ভাবে বোঝার জন্য, চিনের উপর আলোকপাত করা আরও বেশি জরুরি। কারণ এই অভ্যুত্থানের অক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং উল্লেখযোগ্য দেশ হল চিন।
বেজিং দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও অন্যান্য পশ্চিমী দেশ, বিশেষ করে ইউরোপের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষার জন্য নিজের কৌশলগত অস্পষ্টতা নীতির অধীনে এই সম্পর্কগুলি নিয়ে বিশেষ সরব নয়।
রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে গভীরতর অংশীদারিত্বের বিষয়ে চিনা অবস্থানের দিকে আলোকপাত করলে চিনের অন্তর্দৃষ্টি বোঝা সম্ভব। চিন এই সম্পর্কের বিষয়ে বিশেষ মুখ না খুললেও তার সচেতন শব্দ চয়ন আসলে তার স্বাচ্ছন্দ্যকেই দর্শায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাশিয়া-ডিপিআরকে চুক্তি স্বাক্ষরের পরে চিনের বিদেশমন্ত্রকের (এমএফএ) মুখপাত্র বলেন, ‘চিনা পক্ষ উল্লেখ করেছে যে, বন্ধুত্বপূর্ণ ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসাবে ডিপিআরকে ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি, বিনিময়, সহযোগিতার বৈধ প্রয়োজন রয়েছে।’ আবার অন্য একটি অনুষ্ঠানে চিনা এমএফএ মুখপাত্র বলেছেন, ‘ডিপিআরকে ও রাশিয়া দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং কী ভাবে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিকশিত হবে, তা নিতান্তই তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।’ এই দুই ধরনের বিবৃতি আসলে রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া সম্পর্কের প্রতি চিনের কৌশলী সমর্থনকেই দর্শায়। বেজিং দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও অন্যান্য পশ্চিমী দেশ, বিশেষ করে ইউরোপের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষার জন্য নিজের কৌশলগত অস্পষ্টতা নীতির অধীনে এই সম্পর্কগুলি নিয়ে বিশেষ সরব নয়।
যাই হোক, পশ্চিমীরা তার নিরাপত্তা জোটকে শক্তিশালী করার জন্য পদক্ষেপ নিলে এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ তখন বেজিংয়ের পক্ষে তার পক্ষপাত নিয়ে ধোঁয়াশা বজায় বিষয়টি সমস্যার মুখে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ত্রিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পর বেজিং এ কথা স্পষ্ট করে দেয় যে, উত্তর কোরিয়ার পদক্ষেপ সত্ত্বেও পিয়ংইয়ংয়ের প্রতি বেজিংয়ের সমর্থন অবিচল রয়েছে। চিনা নেতা শি জিনপিং এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠকের পর প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘চিন চায় না, কোরীয় উপদ্বীপ জুড়ে সংঘাত ও অশান্তি হোক। তবে যদি চিনের কৌশলগত নিরাপত্তা ও মূল স্বার্থ হুমকির মুখে পড়ে, তা হলেও চিনও চুপ করে বসে থাকবে না।’ এ হেন মনোভাব আসলে দর্শায়, চিন রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করলেও যখন সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হবে, তখন পশ্চিমের বিরুদ্ধে গিয়ে চিন নিজের প্রতিবেশীদের পাশেই থাকবে। রাশিয়ার সঙ্গে চিনের ‘সীমাহীন অংশীদারিত্ব’ এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি তার অব্যাহত প্রতিশ্রুতি এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। চিন-রাশিয়া এবং রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতার কথা স্বীকার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি সেক্রেটারি কার্ট ক্যাম্পবেল বলেছেন যে, এই উদীয়মান অক্ষ এই অঞ্চলে মার্কিন কৌশলগত স্বার্থকে গুরুতর ভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ত্রিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পর বেজিং এ কথা স্পষ্ট করে দেয় যে, উত্তর কোরিয়ার পদক্ষেপ সত্ত্বেও পিয়ংইয়ংয়ের প্রতি বেজিংয়ের সমর্থন অবিচল রয়েছে।
উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার সম্পর্ককে তাই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। বরং এটিকে একটি বৃহত্তর প্রবণতার অংশ ও বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তনে আগ্রহী সেই দেশগুলির সমন্বিত হওয়ার প্রতীক হিসেবেই দেখা উচিত, যারা মনে করে যে, তাদের সঙ্গে অন্যায় ঘটে চলেছে। সুতরাং এই ধরনের ঘটনা আঞ্চলিক হলেও তার যথেষ্ট আন্তর্জাতিক প্রভাব রয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য প্রসপেক্ট ফাউন্ডেশন-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.