Published on Aug 15, 2021 Updated 0 Hours ago

বিশিষ্ট নগর-ব্যবস্থার উত্থান সব সময় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নির্ধারিত হয় না, অধিকাংশ সময়েই তার পিছনে থাকে ইতিহাসের বোধ ও তাকে ঘিরে থাকা রাজনৈতিক রাজধানী।

নতুন চোখে কলকাতা: পূর্বাঞ্চলে কূটনীতি ও উন্নয়ন

সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম বা অর্থনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান শহরগুলিই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়। সেই এথেন্স যাকে প্রথম ইউরোপীয় সংস্কৃতির শহর বলা হয়, তার থেকে আজকের সার্বভৌম নগর-রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর, যা এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গণ্য, উদাহরণ অজস্র। ঘরের কাছে মুম্বই তো ভারতের ‘অর্থনৈতিক কেন্দ্র,’ আর কলকাতাকে দেশের ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হিসেবেই দাবি করা হয়। বস্তুত, ২০২১-এর জানুয়ারিতে কলকাতায় এক রাজনৈতিক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি মনে করি ভারতের অবশ্যই চারটি পর্যায়ক্রমিক রাজধানী থাকা উচিত। ইংরেজরা কলকাতা থেকে সারা দেশ শাসন করত। আমাদের দেশে মাত্র একটা রাজধানী শহর থাকবে কেন?” বিশিষ্ট নগর-ব্যবস্থার উত্থান সব সময় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নির্ধারিত হয় না, অধিকাংশ সময়েই তার পিছনে থাকে ইতিহাসের বোধ ও তাকে ঘিরে থাকা রাজনৈতিক রাজধানী।

অন্তর্দেশীয় ও আন্তর্জাতিক, এই দুই স্তরেই অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের জরুরি সংযোগবিন্দু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা যে কলকাতার যথেষ্টই রয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে তার ভৌগোলিক নৈকট্য রয়েছে, এবং তা পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম ও সব থেকে ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পন্ন শহর। বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ অতিমারিতে বিপর্যস্ত, সেই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সহযোগিতামূলক কেন্দ্র-রাজ্য মিথষ্ক্রিয়া আগের তুলনায় অনেক বেশি সহজ-সরল হওয়া প্রয়োজন। ফলে এই পরিস্থিতিতে বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে, অতিমারি-উত্তর বিশ্ব-কাঠামোয় কলকাতার মতো শহর আদৌ বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পারে কি না, আর হলে কী ভাবে তা সম্ভব।

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফ ডি আইপ্রবাহঃ এক প্রধান বাধা

পশ্চিমবঙ্গ শিল্পায়ন-বিমুখ এমন একটা ধারণা আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে। ২০১০-১১ সালে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (সেজ) গড়ে তোলার বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গে নীতিগত ভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। রাজ্যের সব বিরোধী দলই সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় ঘোলা জলে মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেজ-এর জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা এমন শক্তি অর্জন করে যে শেষ পর্যন্ত তা বাংলায় ৩৪ বছরের কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের গদিতে বসার পথ প্রশস্ত করে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির হিসেব অনুযায়ী, ভারতে সক্রিয় সেজ-এর সংখ্যা ২৪০, যার মধ্যে মাত্র সাতটি পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে মহারাষ্ট্রে আছে ৩২টি। ফলে অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হতে গেলে বাস্তব পরিকাঠামো থেকে মানবসম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে দেশি ও বিদেশি মূলধন বিনিয়োগ হওয়া দরকার।

২০০৮-১৮, এই এক দশকে দেশের প্রধান শহরগুলিতে এফ ডি আই প্রবাহের নিরিখে দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাইয়ের মতো অন্যান্য মহানগরের তুলনায় কলকাতার বৃদ্ধির পরিমাণ সর্বনিম্ন স্তরে (সারণি ১ দ্রষ্টব্য)। অবশ্য সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য কলকাতার শুধু পূর্ব ভারত নয়, সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যেই অর্থনৈতিক কাজকর্মের বিশিষ্ট কেন্দ্র হয়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমত, কৌশলগত অবস্থানের দরুন কলকাতার পক্ষে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর বাজারগুলির সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের বাজারগুলির সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা সুবিধাজনক; আর দ্বিতীয়ত, পূর্ব ভারতে বাণিজ্যিক উৎপাদনের উপকরণ, সামাজিক যোগসূত্র, মানুষের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা, আর প্রাকৃতিক সম্পদের যে বিশাল ভাণ্ডার আছে, তাকে সক্রিয় করে তোলার ক্ষমতাও কলকাতার আছে।

সারণি ১। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে এফ ডি আই প্রবাহের পরিমাণ (শতকোটি টাকায়)

সূত্র: ভারত সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের তথ্যের ভিত্তি তে লেখকদের তৈরি এই সারণি।

নগর যখন কূটনীতির কেন্দ্র

প্যারা-ডিপ্লোমেসি, যেখানে কোনও আঞ্চলিক সরকার নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের স্বার্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, বা আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে সিটি-ডিপ্লোমেসি বা নগর-কূটনীতি, যেখানে স্থানীয় প্রশাসন, রাজ্য সরকার, এমনকী সুশীল সমাজ পর্যন্ত আঞ্চলিক তথা জাতীয় স্বার্থকে তুলে ধরার জন্য বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে আন্তর্জাতিক স্তরে যোগসূত্র তৈরি করতে পারে — এর একটা কাঠামো কিন্তু কলকাতার সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়। এমন যোগাযোগ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতে পারে, যেমন জাতীয় নিরাপত্তা, দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, প্রশাসনিক যোগসূত্র এবং শহরের প্রতিনিধিত্ব। বস্তুত প্যারা-ডিপ্লোম্যাটিক কাঠামো রূপায়ণের নানা পদ্ধতি আছে — শহরে কনসুলার অফিস স্থাপন করা থেকে শুরু করে বিদেশ মন্ত্রকের আওতায় রাজ্যের বিদেশ বিষয়ক অফিস স্থাপন — এই সবই হতে পারে।

ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতির (এইপি) নিরিখে, মায়ানমার ও তাইল্যান্ড হয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ‘প্রবেশদ্বার’ হিসেবে আঞ্চলিক সম্পর্কের উন্নতিতে কলকাতা এবং গুয়াহাটির মতো পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহরগুলির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা থেকেই পুবের এই সব শহর ও অঞ্চল বিদেশে দেশের কথা তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে নগর-কূটনীতির বিকল্প কাঠামো তৈরি করাও সম্ভব হবে।

বহু-ক্ষেত্রীয় প্রাযুক্তিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য বঙ্গোপসাগরীয় আঞ্চলিক উদ্যোগ (বিমস্টেক) এবং বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল (বিবিআইএন) অঞ্চলের মধ্যে স্বাভাবিক সমন্বয় ঘটাতে কলকাতা বন্দর বড় ভূমিকা নিতে পারে। ব্রিটিশ শাসনে কলকাতা বন্দর গতিশীল ভূমিকা পালন করেছিল। স্বাধীনতার পর সেই প্রাণশক্তি হারালেও হলদিয়া বন্দরের সঙ্গে কলকাতা এখনও স্থলবেষ্টিত নেপাল ও ভুটানের কাছে নিকটতম সমুদ্রবন্দর। বন্দরের নেতৃত্বে সাগরমালার মতো উন্নয়নমূলক উদ্যোগে অংশগ্রহণের উপরেই কলকাতা বন্দরের ব্যবসা আকর্ষণ করা এবং আরও বেশি পরিমাণ মালপত্র সামলানোর ক্ষমতা নির্ভর করবে। ভারত ও মায়ানমারকে সংযুক্ত করার জন্য কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প; ভারত, মায়ানমার ও তাইল্যান্ডকে যুক্ত করার জন্য এশীয় ত্রিপক্ষীয় সড়ক; এবং বিবিআইএন মোটর ভেহিকলস চুক্তি — কলকাতা বন্দরকে সংযুক্ত করার জন্য এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্রকল্পগুলির কোনটিই এখনও কার্যকর ভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ২০১৯-এ কলকাতা, বিশাখাপত্তনম ও চেন্নাই পোর্ট ট্রাস্টের সঙ্গে তাইল্যান্ডের রানং বন্দরের যে সর্বশেষ সমঝোতাপত্রটি (এম ও ইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে।

এই অঞ্চল দিয়ে বাণিজ্যের উপর নেপাল ও ভুটানের অতিরিক্ত নির্ভরতাকেও কাজে লাগাতে হবে, কারণ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত, দুই লক্ষ্য পূরণেই তা ভারতের উপকারে আসবে। বিভিন্ন বিমস্টেক ও বি বি আই এন অঞ্চলের কাছাকাছি অবস্থান এবং ভারতের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সুপ্রতিষ্ঠিত যোগাযোগ ব্যবস্থা কলকাতাকে ওই সব অঞ্চলের বাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার স্বাভাবিক সুবিধা দিয়েছে। আর জাতীয় জলপথ ১-এর মাধ্যমে এই এলাকার পশ্চাদভূমির শিল্পোন্নত এলাকাগুলির সঙ্গে নদীপথে সহযোগিতার সম্ভাবনা তো রয়েইছে।

প্রয়োজন সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা

শহরগুলি অর্থনৈতিক সক্রিয়তার কেন্দ্র হয়ে উঠলেও সেখানে কিন্তু এখনও যথেষ্ট আর্থিক স্বশাসন নেই। যেমন, ভারতীয় শহরগুলির স্থানীয় প্রশাসনের একের সঙ্গে অপরের তীব্র মতানৈক্যের অন্যতম প্রধান কারণ পুরসভার অর্থসংস্থান। সংবিধানের ৭৪তম সংশোধনীতে স্থানীয় প্রশাসনকে কার্যকরী স্বশাসন দেওয়া হলেও যথেষ্ট আর্থিক স্বশাসন দেওয়া হয়নি। স্বভাবতই শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে রাজস্বে ঘাটতি পড়ছে। তার ফলে অর্থসংস্থানের জন্য রাজ্য সরকারের উপর নির্ভরতাও অত্যন্ত বাড়ছে, যা চূড়ান্তই অপ্রতুল। এই প্রেক্ষিতে, এই বছরের কলকাতা পুরসভার (কে এম সি) নির্বাচনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতা পুরসভায় এবং রাজ্য বিধানসভায় নির্বাচিত দলগুলির সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক সমীকরণের উপরেও অদূর ভবিষ্যতে কলকাতার আর্থ-সামাজিক ও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন সরাসরি নির্ভর করবে।

একটা শহরের প্রাধান্যের সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে ভাল থাকাটা অতপ্রত ভাবে জড়িত। এই অঞ্চলের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে গেলে কলকাতার প্রয়োজন বন্ধুত্বপূর্ণ রাজনীতি চর্চা ও সুষ্ঠু ভাবে প্রশাসন পরিচালনার পথে এগোন। এর সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুস্থিতি অর্জনের জন্য দরকার রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রক্ষা করা। এতে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আরও শক্তপোক্ত হবে, এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অংশীদারি ও রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর সম্ভাবনা আরও প্রবল হবে। তাই কলকাতা ও নয়াদিল্লির মধ্যে সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সন্ধিক্ষণ হয়ে উঠবে — শুধু দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের উপর অভিঘাতের জন্য নয়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মতো নিকটতম প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের জন্যও।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Authors

Soumya Bhowmick

Soumya Bhowmick

Soumya Bhowmick is an Associate Fellow at the Centre for New Economic Diplomacy at the Observer Research Foundation. His research focuses on sustainable development and ...

Read More +
Pratnashree Basu

Pratnashree Basu

Pratnashree Basu is an Associate Fellow, Indo-Pacific at Observer Research Foundation, Kolkata, with the Strategic Studies Programme and the Centre for New Economic Diplomacy. She ...

Read More +