Published on Sep 01, 2021 Updated 0 Hours ago

অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বিকাশ এবং স্থিতিশীলতার সঙ্গে উপযুক্ত বিদেশনীতি অত্যন্ত প্রয়োজন।

প্রসঙ্গ বিদেশনীতি — একটি দুর্বল বিতর্ক সভা

ভারতের বিদেশনীতি বিষয়ে সম্প্রতি একটি বিতর্ক সভার আয়োজন করা হয়েছিল, যাতে যোগ দেন ভারতীয় বিদেশ সেবা-র (ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস) প্রাক্তন আধিকারিকরা। ভারতীয় সরকারি আধিকারিকরা বিদেশনীতি নিয়ে কী ভাবেন, আর তাতে গোলমালটা কোথায়, সেটা এই আলোচনা থেকে স্পষ্টই উঠে এল। বিদেশনীতির নীতিগত দিকগুলির তুলনায় ‘বিতর্ক’ বেশি হল অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে। দুর্ভাগ্যবশত, বিদেশনীতি নিয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণকারী দুই পক্ষের মধ্যে বৈপরীত্যের থেকে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া গেল। উভয় পক্ষই মেনে নেয় ধ্যানধারণাই বস্তুগত শক্তির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ধ্যানধারণা না বস্তুগত সক্ষমতা, আমরা কীসের উপর জোর দেব, সেই মৌলিক প্রশ্নটাই চাপা পড়ে গেল ভারতের ধ্যানধারণা কী হওয়া উচিত তাই নিয়ে অন্তহীন বিতর্কে।

বিদেশনীতির ক্ষেত্রে বস্তুগত কারণগুলি উপেক্ষা করে ধ্যানধারণার একটা নিজস্ব ভূমিকা আছে এটাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে কী রকম ধারণা ভারতের বিদেশনীতিকে পথ দেখাতে পারবে তারই নানা ধরন নিয়ে বিতর্কসভায় উভয় পক্ষই আলোচনায় মেতে উঠল। বস্তুগত সক্ষমতার সঙ্গে ধ্যানধারণাকে মেলাতে বিরোধীদের ব্যর্থতা প্রসঙ্গেই শুধু বস্তুগত শক্তির উল্লেখ শোনা গেল, আর সে আলোচনাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। ভারতকে ‘বিশ্ব গুরু’ হিসেবে তুলে ধরার ধারণাটির পিছনে বস্তুগত শক্তির যে অভাব আছে, তার সমালোচনা যথার্থ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এই ধারণাটি তুলে ধরাও পরস্পরবিরোধী যে ভারত একটি অন্যরকম ‘দৃষ্টান্তমূলক শক্তি’। অন্য দিকে, মোদি সরকারের বিদেশনীতির সমর্থকরাও একই সুর ধরলেন — বস্তুগত শক্তির চেয়ে ধ্যানধারণার গুরুত্ব বেশি। না হলে তাঁরা কেন ভারতের সাংস্কৃতিক শক্তিকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরবেন যেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার কোনও কার্যকর ভূমিকা আছে।

দুর্ভাগ্যবশত, বিদেশনীতি নিয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণকারী দুই পক্ষের মধ্যে বৈপরীত্যের থেকে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া গেল। উভয় পক্ষই মেনে নেয় ধ্যানধারণাই বস্তুগত শক্তির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ধ্যানধারণা না বস্তুগত সক্ষমতা, আমরা কীসের উপর জোর দেব, সেই মৌলিক প্রশ্নটাই চাপা পড়ে গেল ভারতের ধ্যানধারণা কী হওয়া উচিত তাই নিয়ে অন্তহীন বিতর্কে।

বিষয়টা এমন নয় যে ধ্যানধারণার কোনও গুরুত্ব নেই। অবশ্যই আছে, কিন্তু একক ভাবে নয়। বস্তুগত শক্তি পিছনে না থাকলে শুধু ধারণা কোথাও পৌঁছে দিতে পারবে না। ভারতের বিদেশনীতির অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যদি আদৌ কোনও শিক্ষা পেয়ে থাকি তবে তা হল, বস্তুগত শক্তির অভাবকে ধারণা দিয়ে পূরণ করা যায় না। কী ধারণা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আসল নয়, কখন তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেটাই বিতর্কের মূল প্রশ্ন।

ধারণা ও বস্তুগত শক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক

বিতর্কসভায় বস্তুগত শক্তির সঙ্গে ধারণার সম্পর্ক নিয়ে বোধের বিশেষ আভাস কোনও পক্ষের আলোচনাতেই পাওয়া গেল না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে, ধারণাগুলির সাধারণত নিজস্ব ক্ষমতা থাকে না। খুব সুন্দর বা যুক্তিপূর্ণ ধারণা, অথবা যার পিছনে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের বা রাষ্ট্রের সমর্থন আছে, তাতেও কিছু আসে যায় না। তাই যদি হত, তা হলে পরমাণু অস্ত্রের হুমকির মোকাবিলা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেই অস্ত্রগুলিকে বিনষ্ট করে দিত। এটাই তো প্রায় সারা পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষা। তার বদলে নিজেরা পরমাণু অস্ত্রে শক্তিশালী এমন রাষ্ট্রগুলি স্থির করল, পরমাণু অস্ত্রের প্রসার রোধ করাই ঠিক উপায়। কাজেই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নয়, পরমাণু অস্ত্র প্রসার রোধই নীতি হয়ে দাঁড়াল। বৃহৎ শক্তিগুলি চায় প্রসার রোধ, আর যে সমস্ত রাষ্ট্র বস্তুগত ক্ষমতায় পিছিয়ে আছে, তারাই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ সমর্থন করে। এর ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।

এই বিতর্কের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল রাষ্ট্রীয় শক্তি এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক। অর্থাৎ ভারতের আদৌ বৃহৎ শক্তি হওয়ার দিকে এগোন উচিৎ কি না। সত্যিই কি এর কোনও দরকার আছে? এক দিকে আমরা বৃহৎ শক্তি হওয়ার পিছনে দৌড়নর সমালোচনা করব, অন্য দিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে আসন পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর চেষ্টা করে যাব, এতো এক ধরনের মানসিক ব্যাধি- স্কিজোফ্রেনিয়া। সন্দেহ নেই, অনেক সময়েই ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষার শিকড় কোনও বাস্তব রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে নিহিত থাকে না, লক্ষ্যটা নিছক লক্ষ্যই থেকে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) কার্যনির্বাহী পর্ষদের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও, কোভিড ভাইরাসের উৎপত্তির তদন্তে ভারত বিশেষ উদ্যোগী হয়নি। কাজেই, নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন পেলেও তারা যে খুব কিছু করতে পারবে এমন ভরসা নেই।

ভারত যদি শুধু অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে মাথা ঘামায়, তা হলে তার বৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম। আন্তর্জাতিক মঞ্চে সব রাষ্ট্রকেই নিজের খেয়াল রাখতে হয়। অর্থাৎ বৈদেশিক হুমকি থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখাই মূল লক্ষ্য। এই কাজে ব্যর্থতা মানে শুধু নিজেদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করাই নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকেও ব্যাহত করা। ১৯৫০-এর দশকের ভারত এর প্রমাণ। চিনের হুমকির প্রতি নেহরুর উদাসীনতা শুধু ১৯৬২ সালের যুদ্ধে পরাজয় ডেকে আনেনি, ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশকেও রুদ্ধ করেছিল। ষাটের দশকে সুরক্ষা ব্যবস্থায় ভারতের বাধ্যতামূলক ব্যাপক বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনাকে ব্যাহত করেছিল।

ভারতের বিদেশনীতির অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যদি আদৌ কোনও শিক্ষা পেয়ে থাকি তবে তা হল, বস্তুগত শক্তির অভাবকে ধারণা দিয়ে পূরণ করা যায় না। কী ধারণা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আসল নয়, কখন তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেটাই বিতর্কের মূল প্রশ্ন।

অবশ্যই এর অর্থ এই নয় যে ভারত তার অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের দিকে না তাকিয়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতকেই বড় করে দেখবে। এমন ভারসাম্যহীনতার নজির অবশ্য যথেষ্ট রয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন এত বেশি অর্থ ব্যয় করেছিল যে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিই ভেঙে পড়েছিল। এখানে পাকিস্তানের উদাহরণটিও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের মতো অনেক বড় দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা তাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই নজিরগুলি থেকে ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়। ভারত অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নজর দিলেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র সামলান যাবে, এই সরলীকরণের মধ্যে সেই ভারসাম্যের অভাব রয়েছে।

এটা স্পষ্ট যে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বিকাশ এবং স্থিতিশীলতার সঙ্গে উপযুক্ত বিদেশনীতি অত্যন্ত প্রয়োজন। দেশের অভ্যন্তরে উন্নতি হলেই যে বৈদেশিক পরিস্থিতি অনুকূল হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। প্রধানত চিনের মতন শক্তিশালী দেশ প্রতিবেশী হবার কারণেই ভারত এবং চিন সীমান্তে চাপা উত্তেজনা এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সর্বদাই বর্তমান। চিন বৃহত্তর সম্পদের অধিকারী এবং ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র। সেই সম্পদ এবং ক্ষমতার জোরে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রকে হুমকি দেয়। নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খুবই ভাল হওয়া সত্ত্বেও চিনের হুমকির হাত থেকে এই দুটি দেশ রেহাই পায় না।

স্বাধীনতার পর অনেক দশক ধরেই ভারত তুলনামূলক নিরাপদ পরিস্থিতি উপভোগ করতে পেরেছে। সেই সুদিন আর নেই। এখন বিদেশনীতির ক্ষেত্রে কী ভাবে এগোন উচিৎ তাই নিয়ে গুরুতর বিতর্ক দরকার। দুর্ভাগ্যক্রমে, উল্লিখিত বিতর্ক সভায় সেই প্রত্যাশা পূরণ হল না।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.