১ জুলাই উজবেক প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিওয়েভের দ্বারা এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা হ্রাস করার পরে কারাকালপাকস্তানের রাজধানী নুকুসে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী হিংসার ঘটনায় অন্তত পক্ষে ১৮ জন নিহত এবং কয়েক জন নিরাপত্তা আধিকারিক-সহ ২৪৩ জন আহত হন। উজবেক সরকার বিক্ষোভকারীদের নেতৃবৃন্দ-সহ ৫১৬ জনকে আটক করেছে। ব্যাপক বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার সিদ্ধান্ত স্থগিত করে প্রেসিডেন্ট মিরজিওয়েভ এই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে এক মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে একটি ডিক্রি জারি করেন এবং ইন্টারনেট পরিষেবা খর্ব করেন। সরকার ‘নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, তাঁদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে এবং আইনশৃঙ্খলার শাসন পুনর্বহাল’-এর কারণ দর্শিয়ে তার পদক্ষেপগুলিকে ন্যায্য প্রমাণের চেষ্টা করেছে।
ব্যাপক বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার সিদ্ধান্ত স্থগিত করে প্রেসিডেন্ট মিরজিওয়েভ এই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে এক মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে একটি ডিক্রি জারি করেন এবং ইন্টারনেট পরিষেবা খর্ব করেন।
কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিবাদ, ভিন্ন মত এবং সমালোচনা উজবেকিস্তানের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মিরজিওয়েভের আনা অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন নাগরিক সমাজকে অধিকতর স্বাধীনতা দেওয়ায় পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে।
সোভিয়েত উত্তরাধিকার
কারাকালপাক এবং কারাকালপাকস্তানের ঐতিহাসিক ভাবে উৎস অস্পষ্ট। তাদের প্রথম ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায় ষোড়শ শতকের শেষের দিকে। খিভা-র খানাতের সঙ্গে শিথিল ভাবে সংযুক্ত এই অঞ্চলটি রুশরা ১৮৭৩ সালে জয় করে। রাশিয়ার জাররা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে সমগ্র মধ্য এশিয়া সামরিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালে তুর্কিস্তান একটি স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়, যেখানে বুখারা এবং খিভাকে (দু’টি পূর্বতন প্রোটেক্টোরেট রাষ্ট্র) ১৯২০ সালে পিপলস রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
পরবর্তী কালে মধ্য এশিয়ায় একটি স্বাধীন মুসলিম-অধ্যুষিত / তুর্কি-অধ্যুষিত দেশ তৈরির উদ্দেশ্যে ইসলামপন্থী এবং তুর্কিপন্থী আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে দেখা যায়। সোভিয়েতরা প্রশাসনিক ইউনিটগুলি ভাঙ্গাচোরা করে জাতিগোষ্ঠীগুলিকে বিভক্ত করে এবং একাধিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে মধ্য এশিয়ায় বিভাজন এবং শাসনের ঔপনিবেশিক কৌশল কাজে লাগিয়েছিল। সোভিয়েতরা মধ্য এশিয়ায় এই সোশ্যালিস্ট সোভিয়েত রিপাবলিকস (এস এস আর) তৈরি করেছিল, যাতে প্রতিটি প্রজাতন্ত্রের অধীনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তাঁদের নামে জাতিসত্তার খুব সামান্য পরিচয়ই প্রতিফলিত হয়। ১৯২৫ সালে সোভিয়েতরা কারাকালপাক স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্ট তৈরি করেছিল, প্রথমে সেটিকে কাজাক এস এস আর-এর মধ্যে রাখা হয়েছিল, এর পর ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত সেটি রাশিয়ান ফেডারেশনের অধীনে ছিল। পরবর্তী কালে কারাকালপাক স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্ট ১৯৩৬ সালে একটি স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা-সহ উজবেকিস্তান এস এস আর-এর অংশ হয়ে ওঠে। অন্যরা যেমন তাজিক এবং কিরঘিজ যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩৬ সালে পূর্ণাঙ্গ এস এস আর হয়ে ওঠে।
সোভিয়েতরা প্রশাসনিক ইউনিটগুলি ভাঙ্গাচোরা করে জাতিগোষ্ঠীগুলিকে বিভক্ত করে এবং একাধিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে মধ্য এশিয়ায় বিভাজন এবং শাসনের ঔপনিবেশিক কৌশল কাজে লাগিয়েছিল।
ব্যাপক দুর্নীতি, ক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং সরবরাহ ও রফতানিতে পতন ১৯৮৫ সালের পর ইউ এস এস আর-কে গুরুতর প্রতিবন্ধকতার মুখে ফেলেছিল। প্রেসিডেন্ট গর্বাচভ গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্ত্রোইকা প্রবর্তন করেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার কারণ হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্ন আন্দোলন রাশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনকে ইউ এস এস আর-এর প্রজাতন্ত্র এবং ইউনিয়নগুলি সম্পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করেছিল। ইউ এস এস আর-এর ভাঙনের ফলে কারাকালপাকস্তানেও স্বাধীনতা আসে এবং এর পার্লামেন্টে ১৯৯০ সালে সার্বভৌমত্বের একটি ঘোষণা গৃহীত হয়। যদিও ২০ বছর পরে স্বাধীনতার বিষয়ে গণভোট পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই অঞ্চলটিকে ১৯৯৩ সালে উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তী কালে উজবেকিস্তানের সংবিধানের আওতায় কারাকালপাকস্তানের নিজস্ব অনন্য প্রতীক, প্রতিষ্ঠান এবং আইনি পরিকাঠামো ছিল, কিন্তু গণভোটের ব্যাপারটি কখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
একটি আর্থ-সামাজিক চিত্র
কারাকালপাকস্তান উজবেকিস্তানের ভূখণ্ডের ৪০ শতাংশেরও বেশি অঞ্চল জুড়ে রয়েছে, যেখানে কারাকালপাক এবং কাজাকদের সম্মিলিত জনসংখ্যা জাতিগত দিক থেকে উজবেকদের চেয়ে বেশি। তাঁদের সরকারি ভাষা কাজাকের মতো হলেও পৃথক আনুষ্ঠানিক মর্যাদা ভোগ করে। এই অঞ্চলের অর্থনীতি প্রাথমিক ভাবে কৃষিভিত্তিক। তবে আরল সাগর শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ১০/গ্রাম থেকে ১০০/গ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার গুণমান খারাপ হয়ে পড়েছে। সোভিয়েত যুগে তুলো উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ও রাসায়নিকের অত্যধিক ব্যবহার-সহ অস্বাস্থ্যকর কৃষি পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার এই অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন এবং জনসাধারণের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলেছিল। মৎস্য ক্ষেত্রের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটেছে এবং কঠোর জলবায়ু ফসল উৎপাদনের সময়কে স্বল্পমেয়াদি করে তুলেছে। দুর্বল পরিকাঠামো এবং উচ্চ মাত্রার বেকারত্ব-সহ অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ভাবে উজবেকিস্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের মাথাপিছু আয় জাতীয় গড় থেকে ১.৪ গুণ পিছিয়ে। এর পাশাপাশি উজবেকিস্তানের কারাকালপাকস্তানের মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের মাত্রা সর্বোচ্চ।
দুর্বল পরিকাঠামো এবং উচ্চ মাত্রার বেকারত্ব-সহ অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ভাবে উজবেকিস্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
বর্ধিত লবণাক্ততা এবং বিষাক্ত ধূলিকণার কারণে ক্যানসার, যক্ষ্মা, উচ্চ মাত্রার হৃদরোগ ও কিডনির রোগ-সহ স্বাস্থ্য বিপর্যয়গুলি শিশুদের মধ্যে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও ২০১৬ সাল থেকে কারাকালপাকস্তান বর্ধিত বিনিয়োগ এবং প্রেসিডেন্ট মিরজিওয়েভের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার দ্বারা ব্যাপক ভাবে উপকৃত হয়েছে। এই বিনিয়োগ ও সংস্কার রাজধানী নুকুসের সীমা অতিক্রম করেছে। কারাকালপাকরা সাধারণত সংবিধানের অধীনে স্বায়ত্তশাসনে খুশি ছিল এবং এমনকি উজবেকিস্তানের বাইরে থেকে কেন্দ্রীভূত আন্দোলন ন্যূনতম মিরজিওয়েভ-বিরোধী প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।
শাভকাত মিরজিওয়েভের সংকীর্ণ সাংবিধানিক সংশোধনী
দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট মিরজিওয়েভ নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব করেন। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই তিনি দেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগের সূচনা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের একগুচ্ছ প্রকল্প চালু করেন। ফলে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে দেশের অর্থনীতি ও নাগরিক সমাজ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, অন্যান্য মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রের তুলনায় উজবেকিস্তানের নাগরিক সমাজ সামাজিক এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বেশি সক্রিয়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে উজবেক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা ও মেরামত করার পাশাপাশি পশ্চিমের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিরজিওয়েভের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
কারাকালপাকরা সাধারণত সংবিধানের অধীনে স্বায়ত্তশাসনে খুশি ছিল এবং এমনকি উজবেকিস্তানের বাইরে থেকে কেন্দ্রীভূত আন্দোলন ন্যূনতম মিরজিওয়েভ-বিরোধী প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।
বিক্ষোভকে উস্কে দেওয়া প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংশোধনীগুলির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল মিরজিওয়েভের জন্য প্রেসিডেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে সাত বছর করা। বর্তমান সংবিধানে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছরের দু’টি দফায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। মিরজিওয়েভের প্রতিপত্তি এবং জনপ্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংশোধনীটি জুন মাসের শেষের দিকে জনসাধারণের সম্মুখে আনা হলে কোনও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়নি। যদিও জনসাধারণ এ কথা বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে যায় যে, প্রস্তাবিত সংশোধনীটিতে কারাকালপাকস্তানের স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। জনসাধারণ আশঙ্কা করছে যে, এই সংশোধনী তাঁদের আবার সোভিয়েত যুগে ফেরত নিয়ে যাবে। নুকুসে ক্ষোভের যে ছবি ফুটে উঠেছে, তা প্রমাণ করে যে, জনসাধারণ তাদের কষ্টার্জিত স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতা রক্ষা করতে প্রস্তুত, তা সেই প্রতিরোধের মূল্য যা-ই হোক না কেন।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তাসখন্দকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করে তুলবে। কারণ ২০১৮ সালে কারাকালপাকস্তানে আবিষ্কৃত উল্লেখযোগ্য গ্যাসের ভাণ্ডার অঞ্চলটিকে উজবেকিস্তানের জন্য একটি অর্থনৈতিক সম্পদে পরিণত করেছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.