Published on Dec 09, 2021 Updated 0 Hours ago

খরা ও দুর্ভিক্ষের প্রকোপে ধুঁকতে–থাকা ম্যাডাগাসকারের এখন ভীষণ ভাবে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজন তহবিল।

ম্যাডাগাসকারের দুর্দশা:‌ ভয়ঙ্কর খরা, তীব্র দুর্ভিক্ষ ও অভিযোজন তহবিলের অভাব

পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্রতম দেশ ম্যাডাগাসকারের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ দৈনিক ১.‌৯ ডলারেরও কম উপার্জন সম্বল করে বেঁচে আছেন। এখন সেই দেশটিই ভয়ঙ্কর খরা ও অতিমারির প্রকোপে পড়েছে। ২০১৫ সাল থেকে দেশটিতে নিয়মিত গড়ের থেকে কম বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এখন যে খরা চলছে তা ১৯৮১ সালের পর সবচেয়ে তীব্র। বৃষ্টিপাতের ঘাটতির ফলে দক্ষিণের তিন অঞ্চল অ্যানড্রোই, অ্যানোসি ও অ্যাটসিমো অ্যান্ড্রেফানায় ব্যাপক ভাবে ফসল নষ্ট হয়েছে এবং পশুসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার উপরে যুক্ত হয়েছে রিফট ভ্যালি ফিভার (‌আরভিএফ),‌ এবং তার ফলে পশুমূল্য আরও পড়ে গিয়েছে। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১১.‌৪ লক্ষ মানুষ এখন তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন, আর এঁদের মধ্যে ১৪,০০০ মানুষ বাস করছেন আইপিসি (‌ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন)‌ ফেজ ৫ অবস্থায়। দক্ষিণ ম্যাডাগাসকারের শিশুরা অতি–অপুষ্টিতে ভুগছে। ইউনিসেফ–এর হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ৫ লক্ষ শিশু অত্যন্ত অপুষ্ট, আর এদের মধ্যে ১১০,০০০ জনের অবস্থা খুবই খারাপ।

বৃষ্টিপাতের ঘাটতির ফলে দক্ষিণের তিন অঞ্চল অ্যানড্রোইঅ্যানোসি  অ্যাটসিমো অ্যান্ড্রেফানায় ব্যাপক ভাবে ফসল নষ্ট হয়েছে এবং পশুসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

দক্ষিণ ম্যাডাগাসকারের এখনকার দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির জন্য তীব্র খরাই দায়ী বলে মনে করেন অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক এজেন্সি। বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ জেরেমি উইলিয়ামসের বক্তব্য, জলবায়ু পরিবর্তন এখন দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞানের পাঠ নতুন করে পড়াচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলছেন, আধুনিক ইতিহাসে এই প্রথম শুধু বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ ম্যাডাগাসকারে।

যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত উপর্যুপরি খরার কারণে দক্ষিণ ম্যাডাগাসকারে বিশাল পরিমাণ শস্য নষ্ট হয়েছে, খাদ্য উৎপাদন তথ্য কিন্তু দেশে চালের কোনও নাটকীয় ঘাটতির কথা বলছে না। এফএও–র পূর্বাভাস হল ২০২১–এ ধানের উৎপাদন নিয়মিত গড়ের চেয়ে বেশি হবে, তবে ২০২০তে ৪২ লক্ষ টনের মতো উৎপাদনের যে উচ্চ হার পরিলক্ষিত হয়েছিল তার থেকে হয়তো কম হবে। তা ছাড়া খাদ্যশস্য আমদানির প্রয়োজন অল্প বেড়ে দাঁড়াবে ৪ শতাংশের মতো (‌চিত্র দেখুন)‌।

চিত্র ১: ম্যাডাগাসকারের খাদ্যশস্য আমদানি ‘০০০ টনে

নোট: খাদ্যশস্যের মধ্যে আছে চাল, গম ও ভুট্টা | সূত্র: এফএও (২০২১)

‌কাজেই ম্যাডাগাসকারের এই দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি অমর্ত্য সেনের এনটাইট্‌লমেন্ট ফেলিয়র তত্ত্বের আওতায় পড়ে। দেশের এক অংশে আবহাওয়ার অস্থিরতার জন্য চালের উৎপাদন কম হলে তার জন্য আদর্শ পরিস্থিতিতে সেখানে দুর্ভিক্ষ হওয়ার কথা নয়, কারণ খাদ্য সহজেই উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে ঘাটতি অঞ্চলে পাঠানো যায়। আমদানি করে বা সহায়তার মাধ্যমে খাদ্য পেয়েও এ কাজটা করা যায়। ম্যাডাগাসকারের খরাক্রান্ত অঞ্চলগুলিতে খাদ্য উৎপাদন পড়ে যাওয়ার ফলে দক্ষিণের পরিবারগুলি প্রত্যক্ষ ও প্রাপ্যতা–বিনিময় (‌এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্ট)‌ ব্যর্থতার শিকার হয়েছে, এবং তাঁদের খাদ্য পাওয়ার ক্ষমতা ব্যাহত হয়েছে। ম্যাডাগাসকারের দুই–তৃতীয়াংশ পরিবারই তাঁদের নিজেদের উৎপাদিত চাল খেয়ে থাকেন। ফলে চালের উৎপাদন বেশি করে পড়ে গেলে তার অর্থ দাঁড়ায় পরিবারগুলির প্রত্যক্ষ প্রাপ্যতা পড়ে যাওয়া। খাদ্যের নিট ক্রেতাদের ক্ষেত্রে ফলন নষ্ট হওয়ার অর্থ প্রাপ্যতা–বিনিময় ব্যর্থতা, কারণ তাঁদের আয় কমে যাওয়ার ফলে তাঁদের খাদ্য কেনার ক্ষমতাও কমে যায়। তা ছাড়া দক্ষিণ ম্যাডাগাসকারের মানুষ মূলত অস্থায়ী শ্রমিক, এবং যখন কাজ থাকে না তখন তাঁরা কাজের জন্য শহরে চলে যান। কোভিড–১৯ বিধিনিষেধের কারণে তাঁরা শহরাঞ্চলে যেতে পারেননি, আর খরার জন্য ক্ষেতেও কোনও কাজ ছিল না। চালের দাম নাটকীয় ভাবে বেড়ে যাওয়ায় (আগের বছরের থেকে ৩০ শতাংশ)‌ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে গিয়েছিল।

ম্যাডাগাসকারের খরাক্রান্ত অঞ্চলগুলিতে খাদ্য উৎপাদন পড়ে যাওয়ার ফলে দক্ষিণের পরিবারগুলি প্রত্যক্ষ  প্রাপ্যতাবিনিময় (‌এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্ট)‌ ব্যর্থতার শিকার হয়েছে এবং তাঁদের খাদ্য পাওয়ার ক্ষমতা ব্যাহত হয়েছে।

তা ছাড়া মালাগাসি মানুষেরা হলেন পৃথিবীর দরিদ্রতমদের অন্যতম, এবং ভয়ঙ্কর দারিদ্রের কারণেই তাঁদের বড়সড় আঘাতের সঙ্গে লড়াই করে ফিরে আসার ক্ষমতাও কম। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ত্রাণের কাজকর্ম গতি পেলেও সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে যাঁদের প্রয়োজন তাঁদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে। প্রথমত, সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর খাদ্য বিতরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আধা–দিনের রেশনে সীমাবদ্ধ, আর অনেক গ্রাম কিছুই পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, আধা–শুষ্ক দক্ষিণাঞ্চলে অনেক দূরবর্তী গ্রাম আছে, কিন্তু পাকা রাস্তা খুব কম। ফলে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া কঠিন হচ্ছে। রাজধানী আন্টানানারিভো থেকে অ্যামবোয়াসারি জেলার প্রধান শহরে পৌঁছতে গাড়িতে তিন দিন লাগে, আর সেখান থেকে দুর্ভিক্ষে সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত গ্রামগুলোতে যেতে আরও অনেক ঘণ্টা লেগে যেতে পারে। এই বছরেই আরও আগে কোভিড–১৯–এর জন্য দেশে ঢোকা ও ঘুরে বেড়ানোর উপর যে সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা ত্রাণ সংস্থাগুলির কাজকর্ম মসৃণ হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতিমারির ফলে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্দশা নেমে এসেছে। ২০২০ সালে প্রকৃত জিডিপি (‌মোট আভ্যন্তর উৎপাদন)‌ ৪ শতাংশ পড়ে যাওয়ায় দেশ মন্দার কবলে পড়েছে। রফতানি ও পর্যটন খুব বেশি কমে যাওয়ায় চলতি অ্যাকাউন্টে ঘাটতির অবস্থা আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। তা ছাড়া বাজেট ঘাটতিও বেড়ে গিয়ে ৬.‌৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ একদিকে যেমন রাজস্ব আদায় কমে গিয়েছে, অন্যদিকে তেমনই অতিমারির কারণে সরকারের খরচ বেড়ে গিয়েছে। তা ছাড়া আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে সঙ্কটের মোকাবিলা করার ক্ষমতা সরকারের প্রায় নেই বললেই হয়।

তীব্র খরা, দুর্ভিক্ষ, কোভিড–১৯ ও অর্থনৈতিক মন্দা ইতিমধ্যেই মালাগাসি মানুষকে ব্যাপক কষ্টের মধ্যে ফেলেছে। এই গরিব দেশটিকে সাহায্য করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলকে ত্রাণকাজের মাত্রা বাড়াতেই হবে। তবে দক্ষিণের ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটাতে ও প্রাণ বাঁচাতে ম্যাডাগাসকারের যেমন যথেষ্ট খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন দেশের কৃষিক্ষেত্রকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে মুক্ত রাখার প্রয়াস এবং অকস্মাৎ বিপর্যয়ের পর মানুষের ফিরে আসার ক্ষমতা বা স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানো। দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের সামনে খুবই অরক্ষিত। অত্যন্ত বেশি দারিদ্র, কম কৃষিজ উৎপাদনশীলতা ও খারাপ স্থিতিস্থাপকতার কথা মাথায় রেখে দেশটিতে অভিযোজন সংক্রান্ত তৎপরতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। সীমাবদ্ধ সম্পদের অধিকারী এই ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের প্রয়োজন অভিযোজনের তহবিল। কিন্তু কেউ শুনছে কি?‌

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Author

Malancha Chakrabarty

Malancha Chakrabarty

Dr Malancha Chakrabarty is Senior Fellow and Deputy Director (Research) at the Observer Research Foundation where she coordinates the research centre Centre for New Economic ...

Read More +