পাকিস্তানে একটি অযৌক্তিক সার্কাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি সার্কাসের সূচনা ঘটেছে। দেশটিতে নির্বাচনী অনুশীলনের প্রহসনমূলক প্রকৃতি আরও প্রহসনমূলক ফলাফলের জন্ম দিয়েছে। ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ফলাফলের নিরিখে এগিয়ে থাকলেও নওয়াজ শরিফ তাঁদের টপকে গিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী বক্তৃতা প্রদান করেছেন। পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন) দেশের বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে… এ হেন যুক্তি দিয়ে নওয়াজ অভিনন্দনের আবহে বলেন যে, পাকিস্তানকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার জন্য সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত হতে হবে এবং একজোটে কাজ করতে হবে।
সেনাবাহিনীর জন্য সজাগ হওয়ার কঠোর বার্তা?
এ এমন এক অদ্ভুত পরিস্থিতি, যেখানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সাহায্যে সহজেই জয় লাভ করতে পারে, এ হেন এক দল শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করলেও ক্ষমতাহীন দল দ্বারা সমর্থিত একগুচ্ছ স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। এ কথা আশ্চর্য নয় যে, পাকিস্তানের ভোটাররা শেষ পর্যন্ত মহাশক্তিধর সেনাবাহিনীকে নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করাতে বাধ্য করেছেন। পাকিস্তানের অস্বাভাবিক মানদণ্ডের নিরিখে এটি এখনও পর্যন্ত দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ভাবে ‘পরিচালিত’ নির্বাচনগুলির অন্যতম। জয় ঘোষণার অব্যবহিত পরেই আগামী গতিপথ কী হতে চলেছে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও, এ কথা হলফ করে বলা যায় যুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে। এ কথাও স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য এখনই যথার্থ সময়।’ পিটিআই এই বলে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে যে, ‘ক্ষমতাধরদের অবশ্যই জনগণের পছন্দকে সম্মান করতে শিখতে হবে’ এবং দলটি এই বলে সতর্ক করেছে যে, ‘জনগণের সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেওয়ার’ যে কোনও প্রচেষ্টার ফল হবে ‘ভয়ঙ্কর’। এআই-এর সাহায্য পেয়ে ইমরান খান নিজে প্রকাশ্যে এসেছেন এবং তাঁর দলের উপর হামলা চালানো সত্ত্বেও ‘২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য’ কর্মীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ইমরান খানের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের বিবাদের পরে মুনির বদ্ধপরিকর হন যাতে ইমরান এবং তাঁর দল কোনও অবস্থাতেই ক্ষমতা দখল না করে।
বিজয়ীদের সম্পর্কে স্বচ্ছতার অভাব থাকলেও এই প্রহসনে মূল পরাজয়টি বেশ স্পষ্ট। পাকিস্তানের মতো তার সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎও এই মুহূর্তে খুব একটা আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনের ফলাফল দর্শিয়েছে যে, দেশের উপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। সেনাবাহিনী নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ফলাফল পরিবর্তন করার জন্য যে কোনও কৌশল অবলম্বন করতে পারে… এ হেন সম্ভাবনা প্রবল। যদিও এ কথা ভিন্ন যে, জনগণের আবেগকে উপেক্ষা করলে তা সেনাবাহিনীর জন্য ঝুঁকি বাড়াবে। এখনও পর্যন্ত নির্বাচনী প্রবণতা সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পাকিস্তানের চিরাচরিত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির জন্য একটি বড় ধাক্কার সমান। এ কথা কারও অজানা নয় যে, পাকিস্তানের আসল ক্ষমতা বরাবরই সেনাবাহিনীর কুক্ষিগত থেকেছে। সময়ে সময়ে সেনাবাহিনী নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী রাজনৈতিক ঘুঁটি নির্বাচন করেছে। গত নির্বাচনে সেনাবাহিনী ইমরান খানকে সমর্থন করেছিল, যার ফলে ইমরান ক্ষমতায় এসেছিলেন। এর পর ইমরানের সঙ্গে মতানৈক্য হলে সেনাবাহিনী তার বিরোধী দলগুলিকে এক মঞ্চে নিয়ে এসে একটি জোট সরকার গঠন করে। ইমরান খানের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের বিবাদের পরে মুনির বদ্ধপরিকর হন যাতে ইমরান এবং তাঁর দল কোনও অবস্থাতেই ক্ষমতা দখল না করে। কিন্তু নির্বাচনী প্রবণতা উল্টো পথেই হেঁটেছে। যে ভাবেই দেখা হোক না কেন, এই ফলাফল সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্যও জোরালো অপমান বটে। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য নাছোড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত নওয়াজ শরিফের এক আসন থেকে নির্বাচনে হেরে যাওয়া এবং অন্য আসন থেকে পুনরায় তাঁর জয় নিয়ে ওঠা প্রশ্ন থেকেই এই পরিস্থিতি অনুমান করা যায়।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক সম্ভাব্য নতুন ভোর
পাকিস্তানি সামরিক প্রতিষ্ঠান ইমরান খানের বদনাম করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছে। একাধিক মামলায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাঁর শাস্তিও হয়েছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘ক্রিকেট ব্যাট’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর অর্থ হল, পিটিআই আর নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রার্থী দেওয়ার মতো কোনও অবস্থানে ছিল না। সব বড় নেতাই ইমরানের দল ত্যাগ করেন এবং যাঁরা রয়ে যান, তাঁদের কার্যকলাপ সেনাবাহিনীর চাপের মুখে পড়ে সীমিত হয়ে পড়ে। এ হেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি এত বিপুল সংখ্যায় জয়লাভ করেন, তা হলে তা সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য শক্তির জন্য এক জোরাল ধাক্কা। এটি শুধু ইমরান খানের নৈতিক বিজয় নয়, এটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন ভোরেরও সূচনা করতে পারে। এই পরিস্থিতি থেকেই বোঝা যায়, পাকিস্তানের জনগণ সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও চিরাচরিত রাজনৈতিক দলগুলির মনোভাবে হতাশ। এ ছাড়াও একটি ভিন্ন ধরনের ‘ভারতীয় প্রভাব’ বিদ্যমান, যেখানে ভারতের সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে রাজবংশীয় রাজনীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিরোধের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
আফগানিস্তানের তালিবান সরকার দায় ঝেড়ে ফেলে ইসলামাবাদের দাবিকে উপেক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাকিস্তান একাধিক পরিসরে যুঝছে। দেশটির অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। সামাজিক এবং আঞ্চলিক সংহতি সর্বকালের তলানিতে এসে ঠেকেছে। আফগানিস্তানের তালিবান সরকার দায় ঝেড়ে ফেলে ইসলামাবাদের দাবিকে উপেক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরানও কিছু দিন আগে বিমান হামলা চালিয়েছিল, যার জেরে পাকিস্তানকে চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সুরক্ষার আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক অবকাঠামো ও রাজনীতির ধরন নিয়ে চরম মোহভঙ্গ হয়েছে, যা সর্বশেষ নির্বাচনী ফলাফলে প্রতিফলিত। এই ফলাফল সম্ভবত সেনাবাহিনী ও চিরাচরিত রাজনৈতিক দলগুলির জন্য এই সতর্কবার্তা বহন করে যে, দেশের জনগণ আর তাদের ছলচাতুরি সহ্য করার মনোভাব পোষণ করছেন না।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং এই অস্পষ্ট ফলাফল পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকদের একত্রে কাজ করার ক্ষমতার প্রতি আস্থার জন্ম দেবে না। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ‘বিশ্বাসযোগ্য আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে তাঁদের করা মূল্যায়নের সঙ্গে সহমত হয়ে বলেছে যে, এই নির্বাচন মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের উপর অযাচিত বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।’ একটি সরকারকে একত্রিত করার পরবর্তী পর্যায় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংসদ কেনা-বেচা সমেত চাপ ও পালটা চাপের মাঝে পরিস্থিতি সেই দেশের জনগণের জন্য আরও খারাপ হয়ে উঠবে, যাঁরা একটি দীর্ঘ অন্ধকারাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গের শেষে মরিয়া হয়ে আলোর সন্ধান করছেন।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.