তেল–উৎপাদনকারী এবং ভোক্তা দেশগুলির মধ্যে ভূ–রাজনৈতিক বিন্যাসের পরিবর্তন স্বল্পমেয়াদে পেট্রোডলার পুনর্ব্যবহারে (রিসাইক্লিং) উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে
এই নিবন্ধটি ‘কম্প্রিহেনসিভ এনার্জি মনিটর: ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়র্ল্ড’ সিরিজের অংশ
গত দুই শতাব্দীতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিমূলত জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস) দ্বারা চালিত হয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ প্রসার এবং বিশ্ব বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য তেল হয়ে ওঠে প্রয়োজনীয় জ্বালানি, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। শিল্পোন্নত দেশগুলি থেকে উদ্ভূত ‘পিক অয়েল’ ও ‘এনার্জি সিকিউরিটি’র মতো অ্যাকাডেমিক বর্ণনা, যা তেল সরবরাহে ব্যাঘাতকে জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির মূল উৎস হিসাবে ধরত, তা তেলের দামের ওপর প্রিমিয়াম আরোপ করেছিল। এর থেকে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য উদ্বৃত্ত রাজস্ব তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে পারস্য উপসাগরে (গাল্ফ)। এই উদ্বৃত্তকে ‘পেট্রোডলার রিসাইক্লিং’ বা পেট্রোডলার পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্পোন্নত দেশগুলি দ্বারা ‘এক্সটারনালাইজ’ (বহির্দেশীয়করণ) করা হয়েছিল। তেল–উৎপাদনকারী ও ভোক্তা দেশগুলির মধ্যে ভূ–রাজনৈতিক বিন্যাসের পরিবর্তন স্বল্পমেয়াদে পেট্রোডলার পুনর্ব্যবহারে (রিসাইক্লিং) উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
পেট্রোডলার রিসাইক্লিং
অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ফলে তেলের চাহিদা বৃদ্ধি, এবং তার ফলস্বরূপ তেলের চড়া দাম শুধু উপসাগরীয় অঞ্চলের তেল রপ্তানির আয়নির্ভর অর্থনীতিগুলির জন্যই নয়, লাভজনক হয়েছে অন্যান্য ধনী দেশ এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও, যারা বিভিন্ন উপায়ে তেলের অর্থ ব্যবহার করেছে। পেট্রোডলার রিসাইক্লিং বা পেট্রোডলার পুনর্ব্যবহার নামে পরিচিত এই ঘটনাটি হল মূলত তেল–রপ্তানিকারক দেশগুলি থেকে বিশ্বের বাকি অংশে পেট্রোলিয়াম রাজস্বের প্রবাহ। বিস্তৃতভাবেদুটি পথ ছিল যার মাধ্যমে পেট্রোডলার পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে।
একটি ছিলবিশোষণ পথ, অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ খরচ ও বিনিয়োগের জন্য পেট্রোডলার ব্যয় করা, এবং এইভাবে পণ্য ও পরিষেবার আমদানির চাহিদা বৃদ্ধি। অন্যটি ছিলমূলধনী খাত পথ, অর্থাৎ আমদানিতে ব্যয় না করা পেট্রোডলার বিদেশে সম্পদে সঞ্চিত রাখা, যার ফলে মূলধন খাতের বহির্মুখী প্রবাহ হয়। এই সম্পদগুলি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি তাদেরআন্তর্জাতিক রিজার্ভেরঅংশ হিসাবে বা তেল রপ্তানিকারক দেশগুলির প্রাতিষ্ঠানিক তহবিলগুলি জমা রেখেছিল। পেট্রোডলার পুনর্ব্যবহার বলতে সাধারণত মূলধন খাতের পথটিকে বোঝায়।
পেট্রোডলার পুনর্ব্যবহারের উৎপত্তি১৯৪৪ সালের যুদ্ধপরবর্তী ব্রেটন উডস চুক্তি থেকে, যা মার্কিন ডলারকে বিশ্বের একমাত্র রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত করেছিল। এর অর্থ ছিল সমস্ত তেল চুক্তির মূল্য মার্কিন ডলারে নির্ধারণ করতে হবে। ১৯৪৫ সালেমার্কিন প্রেসিডেন্ট ও সৌদি আরবের রাজারমধ্যে একটি বৈঠক থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী হয়, এবং সৌদি আরবে মার্কিন তেল বিনিয়োগে গতি আসে। ১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সোনা নিয়ে ক্রমবর্ধমান সমস্যা ও মূল্যস্ফীতির অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলার জন্য সোনায় ডলারের রূপান্তরযোগ্যতায় ইতি টানেন। ডলারের অবমূল্যায়নের ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলেরতেল রপ্তানিকারকদের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্তহয়, এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়।
তেল রপ্তানিকারকদের এত ডলার জমা করা ছিল একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা, এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় ছিল।১৯৭৪ সালে সৌদি আরব মার্কিন বরাতগুলির জন্যমার্কিন–সৌদি অর্থনৈতিক সহযোগিতার যৌথ কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থপ্রদান করতে মার্কিন ডলার ব্যবহার করতে রাজি হয়, যা মূলত ‘পেট্রোডলার’ পুনর্ব্যবহারকে আনুষ্ঠানিক করে। তথাকথিত ‘পেট্রোডলার’ এইভাবে ১৯৭১–এর আগেকার সোনার মানদণ্ডের বাস্তব প্রতিস্থাপন হয়ে ওঠে, কারণ এটি বিশ্বের বাকি অংশকে ডলার ধরে রাখার একটি কারণ দেয়। এটি একটি অর্থনৈতিকঅস্ত্র হিসাবে অপরিশোধিত তেলের দামের ব্যবহারকেনিষ্ক্রিয় করে দেয়। উপরন্তু, ‘পেট্রোডলার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতিকে অর্থায়নের একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। ২০২২ সালে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কুয়েত ও ইরাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ঋণদাতাদের মধ্যে ছিল, যাদেরট্রেজারি সিকিউরিটি হোল্ডিং–এর মূল্য ছিল ২৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
এই ঘটনাটি ছিল ১৯৫০–এর আগের মার্কিন অস্ত্র রপ্তানি নীতির বিপরীত, যখন কিনা ৯৫ শতাংশ অস্ত্র বিদেশি সহায়তা হিসাবে সরবরাহ করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালের মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য হিসাবে রপ্তানিকৃত অস্ত্রের অংশ ৪৫ শতাংশে এবং ২০০০ সাল নাগাদ ২৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে। ১৯৭০–এর দশকে, যখন ডলার ও তেলের মধ্যে যোগসূত্র শক্তিশালী হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা শিল্পেরবেসরকারিকরণ ও আন্তর্জাতিকীকরণহয়েছিল। তখন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেলের প্রবাহ এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে অস্ত্রের প্রবাহ মার্কিন অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলি অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বৃহত্তম আমদানিকারক হয়ে উঠেছে। ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানির মূল্য যেখানে ছিল ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে তাদশগুণ বেড়ে ২৫.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়ে যায়।
তেলের উচ্চমূল্যের সময়কালে উপসাগরীয় অঞ্চল ও অন্যান্য স্থান থেকে তেল রপ্তানিকারকরা তাদেরবৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি অংশ আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)–কে ঋণ হিসাবেও দিয়েছিল, যাতে বেশ কয়েকটি তেল–আমদানিকারক দেশের ব্যালান্স অফ পেমেন্টের চাহিদা পূরণ করা যায়। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলির মাধ্যমে তেলের লাভের পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করে। যে উন্নয়নশীল দেশগুলি আইএমএফ–এর সহায়তা পেয়েছিল, তাদের প্রায়শই পশ্চিমী পণ্য ও পরিষেবাগুলির পাশাপাশি পশ্চিমী নীতি অনুসারেনিজেদের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার পথ গ্রহণ করতে হয়েছিল৷
তেলের উচ্চমূল্যের সময়কালে তেল উৎপাদকদের অত্যধিক লাভ বিশ্ব বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাটি ভারতের মতো বাণিজ্য ঘাটতি সহবৃহৎ তেল আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বার্থের পক্ষে হানিকারক ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও আমদানির অর্থায়নের জন্য ডলার মুদ্রণের ক্ষমতা দেশটিকে উল্লেখযোগ্য সুবিধা দিয়েছিল, যার বিপরীতেভারতের মতো দেশগুলিকে তেল আমদানির জন্য অর্থ ধার করতে হয়েছিল। পণ্য ও পরিষেবার বাণিজ্যের (অস্ত্রের বাণিজ্যসহ) বা পুঁজি বাজারের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে তেলের লাভের সংবহন তেল আমদানিকারক ও তেল রপ্তানিকারকদের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার বহির্দেশীয়করণ করেছে। ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতের মতো তেল–আমদানিকারী উন্নয়নশীল দেশগুলি উচ্চ মূল্য দিয়েছে।
ইস্যু
স্বল্প থেকে মাঝারি মেয়াদে তেল রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারক দেশগুলির ভূ–রাজনৈতিক পছন্দগুলির পরিবর্তনের কারণে পেট্রোডলারপুনর্ব্যবহারের প্রশ্নে বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। ২০২২ সালে সৌদি আরব বলেছিল যে তারা চিনের সঙ্গে ইউয়ানে তেলের বাণিজ্য করার কথা বিবেচনা করছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দাভোসে সৌদি আরবের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে দেশটি কেবল ইউয়ান নয়, অন্য বিভিন্ন মুদ্রাতেও বাণিজ্য করতে ইচ্ছুক।ভারত, পাকিস্তান, ইরাক ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি তাদের নিজ নিজস্থানীয় মুদ্রায় তেল বা অন্যান্য পণ্য কেনার জন্যরাশিয়া বা চিনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এটি ডলারের থেকে দূরে একটি আরও বিকেন্দ্রীকৃত বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন করতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদে,জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার নীতিগুলিতেল উৎপাদনকে সীমিত করবে বা এমনকি শেষ করবে, এবং পেট্রোডলার সিস্টেমটিকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.
Akhilesh Sati is a Programme Manager working under ORFs Energy Initiative for more than fifteen years. With Statistics as academic background his core area of ...
Vinod Kumar, Assistant Manager, Energy and Climate Change Content Development of the Energy News Monitor Energy and Climate Change.
Member of the Energy News Monitor production ...