গত ৫ জানুয়ারি উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তার বিতর্কিত পশ্চিম সমুদ্র সীমানার কাছে ২০০ রাউন্ড গোলাবর্ষণ করে। এটি পিয়ংইয়ং এবং সোলের মধ্যে ২০১৮ সালের সামরিক চুক্তির একটি উল্লেখযোগ্য লঙ্ঘন। চুক্তিটি সামরিক উত্তেজনা কমাতে এবং দুর্ঘটনাজনিত সংঘর্ষ এড়ানোর উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পিয়ংইয়ং তার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে শুক্রবারের গোলাবর্ষণের ফলে কোরীয় উপদ্বীপে সামরিক উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। মহড়াকে উস্কানি হিসেবে উল্লেখ করে সোলও ওই একই দিনের দ্বিতীয়ার্ধে মহড়ার জবাবে গোলাবর্ষণ করে এবং সামনের সারির দ্বীপ ইয়নপিয়ংকে খালি করার নির্দেশ দেয়। ৭ জানুয়ারি তৃতীয় পর্যায়ে ৬০ বার গোলা চালানোর দরুন সপ্তাহান্তে গোলাবর্ষণ অব্যাহত ছিল।
চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল আস্থা-নির্মাণের ব্যবস্থা, যা ডিএমজেডের মধ্যে বেশ কয়েকটি গার্ড পোস্ট অপসারণ এবং নির্দিষ্ট এলাকায় ল্যান্ডমাইন উপড়ে ফেলার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘সামরিক পরিসরে চিরাচরিত পানমুনজোম ঘোষণার বাস্তবায়নের চুক্তি’ নামে পরিচিত এই সর্বাত্মক সামরিক চুক্তিটি ২০১৮ সালে সামরিক উত্তেজনা কমাতে এবং দুই কোরিয়ার মধ্যে পারস্পরিক আস্থা তৈরির বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তির কেন্দ্রে ছিল একে অপরের বিরুদ্ধে সমস্ত শত্রুতামূলক কাজ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি এবং সশস্ত্র সংঘাত ও দুর্ঘটনাজনিত সামরিক সংঘর্ষের ঝুঁকি হ্রাস করার লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ, বিশেষ করে ভারী সুরক্ষিত ডিমিলিটারাইজড জোন (ডিএমজেড) এবং সামুদ্রিক সীমানা বরাবর। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিমানের জন্য ডিএমজেড-এর কাছে একটি নো-ফ্লাই জোন বা কোনও রকম উড়ান না চালনা করার ঘোষণা আসলে আকাশসীমা লঙ্ঘনের উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল আস্থা-নির্মাণের ব্যবস্থা, যা ডিএমজেডের মধ্যে বেশ কয়েকটি গার্ড পোস্ট অপসারণ এবং নির্দিষ্ট এলাকায় ল্যান্ডমাইন উপড়ে ফেলার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। সামুদ্রিক পরিসরে চুক্তিটিতে বিতর্কিত পশ্চিম সমুদ্র সীমান্ত এলাকাকে শান্তি অঞ্চলে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। যাই হোক চুক্তিটি কখনওই তার প্রত্যাশিত সম্ভাবনা অনুযায়ী ফলপ্রসূ হয়নি। ২০২৩ সালের শেষের দিকে উত্তর কোরিয়া মহাকাশের কক্ষপথে একটি গুপ্তচর উপগ্রহ উৎক্ষেপণের পরে দক্ষিণ কোরিয়া চুক্তির কিছু অংশ স্থগিত করে দেয়।
পিয়ংইয়ং অতীতে বেশ কয়েক বার ২০১৮ সালের চুক্তি লঙ্ঘন করেছে এবং তার সাম্প্রতিকতম লঙ্ঘনটি ঘটে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে। ৫ জানুয়ারির মহড়া দুটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রথমত, এই গোলাবর্ষণের ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন সোল, টোকিয়ো এবং ওয়াশিংটন বছরব্যাপী উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত রিয়েল-টাইম তথ্য ভাগ করে নেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প শুরু করতে সম্মত হয়েছে। পরিকল্পনাটি প্রথমে ২০২৩ সালের অগস্ট মাসে ক্যাম্প ডেভিডে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের সময় গৃহীত হয়েছিল এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তা শুরু হয়েছিল। তিনটি দেশ ২০২৪ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে পারমাণবিক পরামর্শদাতা গোষ্ঠীর দ্বিতীয় বৈঠকে একটি যৌথ পারমাণবিক প্রতিরোধ কৌশলের জন্য নির্দেশিকা তৈরির কাজেও প্রস্তুত। একটি রিয়েল-টাইম তথ্য ভাগ করে নেওয়ার ব্যবস্থার সূচনা আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার সামনে চুক্তিটি তিনটি দেশের মধ্যে একটি অভিন্ন সাধারণ বোঝাপড়ার উপরই জোর দেয়, যে নিরাপত্তার জন্য চিরাচরিত পদ্ধতিকে কার্যকর ভাবে সমসাময়িক হুমকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে অভিযোজিত করে।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সম্পর্কে সময়োপযোগী ও নির্ভুল তথ্য রিয়েল-টাইম তথ্যের সাহায্যে কার্যকর পাল্টা ব্যবস্থা পরিকল্পনা ও কার্যকর করার জন্য অত্যন্ত জরুরি, যা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সম্ভাব্য হুমকির প্রেক্ষিতে আরও সমন্বিত প্রতিক্রিয়ার সুযোগ করে দেয়। এটি তিনটি দেশের প্রতিরোধ ভঙ্গিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার সামনে চুক্তিটি তিনটি দেশের মধ্যে একটি অভিন্ন সাধারণ বোঝাপড়ার উপরই জোর দেয়, যে নিরাপত্তার জন্য চিরাচরিত পদ্ধতিকে কার্যকর ভাবে সমসাময়িক হুমকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে অভিযোজিত করে। এই পদক্ষেপটি একটি সাধারণ প্রতিপক্ষের প্রতিক্রিয়ায় একটি কৌশলগত সাযুজ্যেরও ইঙ্গিত বহন করে, যা চিরাচরিত উত্তেজনা থেকে সরে আসা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতিকেই দর্শায়। উত্তর কোরিয়া এই ঘটনাপ্রবাহের তীব্র সমালোচনা করে এবং নিজের যুদ্ধ-প্রস্তুতিকে জোরদার করার শপথ নেয়।
দ্বিতীয়ত, এমনটা মনে করা হয় যে, পিয়ংইয়ং তার প্রতিরক্ষা দক্ষতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে স্থল ও সমুদ্র সীমান্তে বারবার উস্কানিমূলক ঘটনা ঘটানোর মাধ্যমে তা সুস্পষ্ট। এমনটা করার প্রধান কারণ হল, ২০২৪ সালের আগামী মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ছাড় পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলি ইঙ্গিত দেয়, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মিড টার্ম নির্বাচন চলবে, তখন পিয়ংইয়ং ২০২৪ সালে তার সপ্তম পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর চেষ্টা করতে পারে। প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প আগের মেয়াদে উত্তর কোরিয়া সফর করার দরুন দুই নেতার মধ্যে একটি আকর্ষণীয় সম্পর্ক রয়েছে। পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের সময় দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছে এবং দুই দেশই উত্তেজনাময় সম্পর্ক ও অভূতপূর্ব কূটনৈতিক ব্যস্ততার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছে। ব্যক্তিগত চিঠি আদান-প্রদান-সহ কিমের সঙ্গে ট্রাম্পের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল তার পূর্ববর্তী প্রশাসনের সতর্ক মনোভাব থেকে অনেকটা আলাদা। যাই হোক, এই সম্পৃক্ততার ফলে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের জন্য একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশিকা মেলেনি বা উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অবস্থানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। ট্রাম্পের মেয়াদের শেষ নাগাদ আমেরিকা-উত্তর কোরিয়া সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়ে এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মতো মৌলিক বিষয়গুলি অনেকাংশে অমীমাংসিত রয়ে যায়।
পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের সময় দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছে এবং দুই দেশই উত্তেজনাময় সম্পর্ক ও অভূতপূর্ব কূটনৈতিক ব্যস্ততার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছে।
উত্তর কোরিয়া যদি সত্যিই তার হুমকির প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, তা হলে দক্ষিণ কোরিয়া, তার মিত্রদের সঙ্গে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে এবং পরিস্থিতি সম্ভাব্য ভাবে সামরিক প্রস্তুতি বা এমনকি পাল্টা ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবে, যা কোরীয় উপদ্বীপের নিরাপত্তাকে আরও বিঘ্নিত করতে পারে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় এর ফলে উত্তর কোরিয়ার প্রতি জনসাধারণ এবং রাজনৈতিক মনোভাব কঠোর হয়ে উঠতে পারে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের নীতি ও উত্তর কোরিয়ার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রভাব ফেলতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচনও ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে হবে। উত্তর কোরিয়ার হুমকির বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করে সেটিকে অভ্যন্তরীণ সমর্থন জোরদার করার কাজে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার ব্যবহার করতে পারে৷
পিয়ংইয়ং-এর সামনে বিকল্পগুলি শুধু মাত্র এই অঞ্চলের ক্ষয়িষ্ণু শান্তিকেই ব্যাহত করবে না, বরং এমন এক ঘটনাপ্রবাহের সূচনা করবে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
প্রত্নশ্রী বসু অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.