গত বছর ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তাঁর কেন্দ্রীয় বাজেট বক্তৃতায় ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নগর উন্নয়ন প্রসঙ্গে আলোচনায় নগর পরিকল্পনার দিকেই সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছিলেন। দেশে ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের প্রেক্ষিতে যে জনসংখ্যাগত রূপান্তর ঘটছে, তা ২০৪৭ সালের মধ্যে শহরগুলিকে প্রধান মানব বসতিতে পরিণত করবে… এই মূল্যায়নই ছিল তাঁর আলোচনার ভিত্তি। এমনকি তাঁর ভাবনা এ-ও ছিল যে, ভারত শুধুমাত্র তার শহরগুলির সুশৃঙ্খল অগ্রগতির মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং বৃহত্তর জীবিকার সুযোগগুলি কাজে লাগাতে সক্ষম হবে। জাতীয় কল্যাণ ও ছন্নছাড়া নগরায়ণ এক পঙক্তিতে বসতে পারে না। অর্থমন্ত্রী সুশৃঙ্খল নগর উন্নয়ন অর্জনের জন্য নগর পরিকল্পনাকেই মূল সাধনী হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ছ’টি অনুচ্ছেদে নগর পরিকল্পনাকে সঠিকভাবে পুনর্বিন্যস্ত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলি বিশদে বর্ণনা করেন।
তিনি মেগাসিটি এবং তাদের পশ্চাৎভূমিকে লালন করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন, যাতে সেগুলি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বর্তমান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি তিনি টিয়ার টু এবং থ্রি শহরগুলিকে সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন যাতে তারা ভবিষ্যতে একইভাবে দায়িত্ব নিতে পারে। এই ধরনের প্যানোপটিক বা সর্বাঙ্গীন শহুরে দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রয়োজন নারী ও যুবক-সহ সকলের জন্য সুযোগসমৃদ্ধ স্থিতিশীল জীবন দিতে পারে এমনভাবে শহরগুলির পুনর্গঠন। এমনটা করার জন্য নগর পরিকল্পনা যেমন চলছে তেমন পথে এগোতে পারে না এবং এ ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
জাতীয় কল্যাণ ও ছন্নছাড়া নগরায়ণ এক পঙক্তিতে বসতে পারে না। অর্থমন্ত্রী সুশৃঙ্খল নগর উন্নয়ন অর্জনের জন্য নগর পরিকল্পনাকেই মূল সাধনী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
অর্থমন্ত্রী নগর বিষয়ক নীতি, সক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং প্রশাসনিক বিষয়ে সুপারিশ করার জন্য নগর পরিকল্পনাবিদ এবং অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দেন। তিনি শহরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য রাজ্যগুলিকে সহায়তারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাজেটে নির্মাণ-সংক্রান্ত উপনীতি এবং টাউন প্ল্যানিং স্কিম বা নগর পরিকল্পনা প্রকল্পের (টিপিএস) আধুনিকীকরণের প্রস্তাবের পাশাপাশি গণ পরিবহণ প্রকল্প, পরিবহণভিত্তিক উন্নয়ন-পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এবং টিপিএস বাস্তবায়নের জন্য রাজ্যগুলিকে আর্থিক সহায়তার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচটি অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানকে ২৫০ কোটি টাকার তহবিল প্রদানের মাধ্যমে উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল, যাদের নগর পরিকল্পনা এবং নকশায় ভারতের নিজস্ব জ্ঞানভাণ্ডার বিকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বাজেট অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশনকে (এআইসিটিই) পাঠ্যক্রম, গুণমান এবং লভ্যতার ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনা কোর্সের সংস্কারের দায়িত্ব দিয়েছে।
এর ফলস্বরূপ, আবাসন ও নগর বিষয়ক মন্ত্রক নগর পরিকল্পনা সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির সঙ্গে নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ফাঁকগুলি চিহ্নিত করার কাজ করবে, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ স্থির করবে এবং নগর পরিকল্পনাকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, তা নিয়ে রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলভিত্তিক প্রতিবেদন পেশ করবে। এই কমিটি অতীতের কমিটির সুপারিশগুলির বাস্তবায়নের অবস্থা মূল্যায়ন করে একটি ব্যবধানমূলক বিশ্লেষণ করবে, শহরগুলিতে মাস্টার প্ল্যান তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য কী কী ব্যবস্থা করা যায় তার পরামর্শ দেবে এবং রাজ্যস্তরে নগর পরিকল্পনা সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি পথ নির্দেশিকা তৈরি করবে।
বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচটি অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানকে ২৫০ কোটি টাকার তহবিল প্রদানের মাধ্যমে উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল, যাদের নগর পরিকল্পনা এবং নকশায় ভারতের নিজস্ব জ্ঞানভাণ্ডার বিকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে নীতি আয়োগ ২০২১ সালে ভারতে নগর পরিকল্পনা ক্ষমতার সংস্কারের উপর একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে। এতে দেখা গিয়েছে যে, বেশ কয়েকটি বাধা দেশের নগর পরিকল্পনা ক্ষমতাকে সীমিত করেছে। যেমন, ৭৯৩৩টি শহুরে জনবসতির ৬৫ শতাংশের ক্ষেত্রেই কোনও মাস্টার প্ল্যান ছিল না। অনেক শহরেই উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ বিধি তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। তাদের নিখুঁত ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভেও নেই। প্রতিবেদনটিতে টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং অর্গানাইজেশন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ আর্বান অ্যাফেয়ার্স দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, রাজ্যগুলিকে শহর পরিকল্পনাবিদদের জন্য ৪০০০টি অনুমোদিত পদের জায়গায় ১২০০০টিরও বেশি পদ তৈরি করতে হবে, যেখানে অনুমোদিত পদের অর্ধেকই ছিল শূন্য।
নীতি আয়োগ লক্ষ করেছে যে, বেসরকারি ক্ষেত্র শহরগুলিতে নগর পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নয় এবং তাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা ক্ষমতা জোরদার করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপে আগ্রহী। নীতি আয়োগ শহর পরিকল্পনা বিভাগগুলিকে শক্তিশালী করা, শহর ও দেশ পরিকল্পনা আইন সংশোধন করা এবং প্রযুক্তিগত কঠোরতা বজায় রেখে পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেছে। নগর পরিকল্পনা শিক্ষার স্তরে এটি ভারতীয় উপমহাদেশে মানব বসতির ইতিহাসের পাঠ্যক্রমের আরও বিস্তৃত পাঠের সুপারিশ করেছে।
নগর পরিকল্পনা নিয়ে ভারত সরকারের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। যাই হোক, এই ধরনের রূপান্তরের জন্য নগর পরিকল্পনার পদ্ধতিতে সুনির্দিষ্ট মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে, যার মধ্যে আধুনিকীকরণ এবং নগর পরিকল্পনাকে স্থানীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক করে তোলাও অন্তর্ভুক্ত। ভারতে বেশিরভাগ নগর পরিকল্পনাকে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ করে তোলার জন্য ‘ভারতীয়করণ’ করা জরুরি, যেখানে এই পরিকল্পনাটি কার্যকর হবে। একই সময়ে এটিকে পরিকল্পনা প্রস্তুতিতে প্রভাবকারী প্রযুক্তিগত উন্নয়নগুলি এবং প্রযুক্তি শহরগুলির যে স্থানিক পরিবর্তন ঘটায় সেই বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গুরুত্বের কথা মাথায় রাখলে এ কথা স্পষ্ট যে, শহরগুলি তাদের বাস্তবায়নের প্রেক্ষিত বিবেচনা না করে পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে না। ২০ বছরের শহর পরিকল্পনাগুলিকে পাঁচ বছরের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা এবং বার্ষিক পরিকল্পনায় বিভক্ত করা দরকার, যা বাস্তবায়নের সুবিধার্থে অর্থ এবং অন্যান্য উপকরণ দ্বারা সমর্থিত হবে। যা ‘বাস্তবায়নযোগ্য’ নয় তাকে প্রয়োজনীয় মনে হলেও পরিকল্পনার অংশ করা উচিত নয়।
নীতি আয়োগ শহর পরিকল্পনা বিভাগগুলিকে শক্তিশালী করা, শহর ও দেশ পরিকল্পনা আইন সংশোধন করা এবং প্রযুক্তিগত কঠোরতা বজায় রেখে পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেছে।
তবে ভারত সরকার এই সুপারিশগুলি গ্রহণ করার জন্য রাজ্যগুলির উত্সাহ সম্পর্কে বেশি আশাবাদী বলেই মনে হচ্ছে। সুপারিশগুলি কার্যকর করার জন্য সাংবিধানিক শর্তাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে পরিকল্পনা তৈরিকে রাজ্যের বদলে পুরসভার দায়িত্ব হিসাবেই বিবেচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছায় রাজ্যের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার এহেন পরামর্শের পূর্ব-অভিজ্ঞতা যথেষ্ট হতাশাব্যঞ্জক। যেমন, ভারত সরকার ২০০৩ সালে একটি মডেল মিউনিসিপ্যাল আইনের সুপারিশ করে। এতে প্রশাসনিক সংস্কার, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ এবং বৃহত্তর আর্থিক হস্তান্তর অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজ্যগুলি বিষয়টিকে আমল দেয়নি। ভারত সরকার একাধিক রাজ্যের অনেক শহরকেই বাস র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম (বিআরটিএস) বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে এবং তার জন্য অর্থ প্রদান করেছে। তবে কেন্দ্রীয় অর্থ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিআরটিএস-এর কাজও বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। রাজ্যগুলি এলাকা সভা মডেল বিল গ্রহণের বিষয়ে আশ্বাস দিলেও এক বার ভারত সরকারের তহবিল পাওয়ার পরে তারা চাতুর্যের সঙ্গে বিলটিকে বাতিল করে দেয় এবং সেটিকে অকার্যকর করে তোলে। ভারত সরকারের মডেল রেন্ট অ্যাক্টও রাজ্য স্তরে অচল হয়ে পড়ে আছে। তাই নগর পরিকল্পনা সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলি ভারত সরকারের পরামর্শে মনোযোগ দিতে ইচ্ছুক, এমনটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই।
যেমন ভারত সরকার বিশ্বাস করে যে, নগর পরিকল্পনা যেমন তেমন ভাবে চলতে পারে না, তেমনই এ কথা ঠিক যে, কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে তাদের পরামর্শ অনুসরণ করার জন্য যথেষ্ট চাপও দিতে পারে না। এই ধরনের চাপিয়ে দেওয়া উপদেশ বার বার উপেক্ষিতই হবে। তার পরিবর্তে ভারত সরকারকে অবশ্যই নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি বিবেচনা করে দেখতে হবে।
১. রাজ্যগুলির দ্বারা বাস্তবায়নের জন্য ভারত সরকার পরিকল্পনার ব্লুপ্রিন্ট প্রস্তুত করবে এবং যেখানেই সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, সেখানে রাজ্য এবং শহরগুলির সঙ্গে পরামর্শ করবে৷
২. ভারত সরকার এমন সংস্থা/প্রতিষ্ঠানগুলিকে চিহ্নিত করবে, যারা গুণমানসম্পন্ন পরিকল্পনা তৈরি করতে সক্ষম এবং প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে তাদের চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত করবে। বিভিন্ন গোত্রের শহর ও নগরের জন্য প্রতি একর পরিকল্পনার খরচ নির্ধারণ করা যেতে পারে। এটি প্রতিটি শহরকে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী নিলাম করার প্রক্রিয়ায় বছরের পর বছর সময় নষ্ট করা থেকে বিরত রাখবে। রাজ্যগুলি পরিকল্পনা প্রস্তুতির জন্য তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলিকে নিয়োগ করলে কেন্দ্রকে সমগ্র ভারত জুড়ে ৫০০টি শহরের একটি নির্বাচিত গোষ্ঠীর জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুতির সম্পূর্ণ খরচ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট খরচ বহন করতে হবে।
৩. যে রাজ্যগুলি জাতীয় ব্লুপ্রিন্ট এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে, তারা প্রস্তাবিত সংস্কারগুলি গ্রহণ করার জন্য প্রদত্ত সমস্ত আর্থিক প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হবে৷
যেহেতু নগর উন্নয়ন সাংবিধানিক ভাবে রাজ্যের বিষয়, তাই নানা অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ভারত সরকারের আদেশ কেবল তখনই শহরগুলির উপর কার্যকর হবে, যখন রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় নির্দেশ মেনে চলতে নারাজ হওয়ার দরুন ব্যাপক রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়বে। রাজ্যগুলি যে পরার্থবাদ দ্বারা চালিত হয়ে একাজে একমত হবে, এমনটা ভাবা নিতান্তই বোকামি।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.