Author : Sohini Bose

Published on Apr 13, 2023 Updated 0 Hours ago

মংলা বন্দরের উন্নয়ন এই অঞ্চলে ভূ–রাজনৈতিক শক্তির খেলাকে অতিক্রম করার জন্য বাংলাদেশকে কৌশলগত সুবিধা প্রদান করে

বাংলাদেশের মংলা বন্দরের আধুনিকীকরণ

বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত একটি দেশ হিসাবে বন্দরগুলো বাংলাদেশের বৃদ্ধির কাহিনির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দীর্ঘদিন ধরে দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্য সহজ করার দায়িত্ব  শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের ওপরই ন্যস্ত ছিল। তবে বাংলাদেশের মংলা বন্দরের আধুনিকীকরণের জন্য চিনের বিনিয়োগের ঘোষণায় পরিস্থিতি পরিবর্তনের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে। বছরের পর বছর বিবেচনা এবং একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় এই প্রকল্পটি ‘‌বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’‌ বলে চিহ্নিত হওয়ার পর বেজিং অবশেষে এই বছরের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় একটি চিঠি পাঠিয়ে ২০১৯ সালের ‘মংলা বন্দরের ‌সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের’‌ জন্য অর্থায়নের অনুরোধে সম্মতি জানায়। এর জন্য সরকারি রেয়াতি ঋণ বাবদ ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মঞ্জুর হয়। এই ঋণের কাঠামো অনুযায়ী প্রকল্পটি একটি চিনা উদ্যোগ বা চিনা সংস্থাগুলির একটি কনসর্টিয়াম রূপায়িত করবে। চিন আলোচনার প্রাথমিক  রাউন্ড থেকে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন, কার্যকর করা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব চেয়েছিল।

২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় চিন ও বাংলাদেশ যে ২৭টি প্রকল্পে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছিল তার মধ্যে মংলা বন্দর উন্নয়ন পরিকল্পনা একটি। একই বছরে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ চিনের সঙ্গে তার সমঝোতাপত্রটি উন্নীত করে ন্যাশনাল কমপ্লিট ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের সঙ্গে একটি  চুক্তিতে। যাই হোক, কোম্পানির দিক থেকে যোগাযোগের অভাবের কারণে ২০১৯ সালে চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছিল। ফলস্বরূপ, বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালের  জুলাই মাসে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নামে আরেকটি চিনা এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে চুক্তি করে। এটি লক্ষণীয় যে এই প্রথম দিকের চুক্তি সত্ত্বেও মংলা বন্দরে চিন থেকে অর্থ আসছিল না। এরপর মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর ৬,০১৪ কোটি টাকার একটি সক্ষমতা–নির্মাণ প্রকল্পের জন্য পরামর্শদাতা  হিসাবে এজিস ইন্ডিয়া কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স প্রাইভেট লিমিটেডকে নিযুক্ত করে৷ বন্দরটির উন্নয়নে ভারতের সম্পৃক্ততার খবরের পরেই অবশেষে এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চিনা সিদ্ধান্ত হয়। এই তৎপরতা বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ভূ–রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত দেয়। এই প্রতিযোগিতাটির স্বরূপ বোঝার জন্য মংলা বন্দরে বিনিয়োগের মাধ্যমে চিন ও ভারত কীভাবে লাভবান হবে তা চিহ্নিত করা কাজের হবে।

যেহেতু এর উভয় বৃহদায়তন প্রতিবেশীই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, সেহেতু নিজস্ব পরিকাঠামোগত উন্নয়নের স্বার্থকে কাজে লাগানোর জন্য দেশটির সামনে এইটাই উপযুক্ত মুহূর্ত।

বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের মংলা ও প্রসুর নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত বন্দরটি বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বন্দর, যদিও এর ট্রাফিক ও কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা এখনও চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় অনেক কম। তা সত্ত্বেও বন্দরটিকে একটি আন্তর্জাতিক শিপিং হাব হিসাবে গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে, যা চিন ও ভারত উভয়ের জন্যই একটি আকর্ষণীয় সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

উপসাগরে চিনের আরেকটি পা রাখার জায়গা

চিনের জন্য মংলা বন্দর সমুদ্রে প্রবেশের ব্যবস্থা করে, যার মাধ্যমে দেশটি বঙ্গোপসাগরে  আরও একটি পা রাখতে পারে এবং বৃহত্তর ভারত মহাসাগর অঞ্চলে একটি বৃহত্তর উপস্থিতি বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে পারে। বাংলাদেশ উপসাগরের চূড়ায় অবস্থিত, এবং তার সামনেই আছে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সি লেন অফ কমিউনিকেশনস (এসএলওসি’‌জ), যা এই জলের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এই  শিপিং রুটগুলি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি সম্পদ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক পণ্যের বাণিজ্যের জন্য। বিশ্বের তেল ও গ্যাসের মজুদের ৪০ শতাংশ ধারণ করে ভারত মহাসাগর, এবং এর একটি অংশ হিসাবে উপসাগরটি হাইড্রোকার্বনের এক বিশাল ও তুলনামূলকভাবে অনাবিষ্কৃত সম্পদের সংস্থান। জ্বালানি সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতায়–ভরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এবং এর সমুদ্র বন্দরগুলি চিনের মতো অঞ্চল–উত্তীর্ণ বড় শক্তিগুলির জন্য তাদের জ্বালানি নিরাপত্তার সন্ধানে একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগের গন্তব্য।

চিনের পোশাক বাণিজ্যকে সহজতর করা

মংলা বন্দরে চিনের আগ্রহের আরেকটি কারণ হল বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পোশাক শিল্প। এমন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যে চিনের কিছু পোশাক প্রস্তুতকারক তাদের দেশে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন ঘাঁটি বাংলাদেশে স্থানান্তরিত করতে চায়, এবং মার্কিন–চিন বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে অনেক ব্র্যান্ড বস্ত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অ–চিনা সরবরাহকারী খুঁজছে। এদিকে সস্তা শ্রমের প্রাপ্যতা, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে কোনও বিধিনিষেধ ছাড়াই রপ্তানির অধিকার, এবং আমেরিকার বাজারে মাল্টিফাইবার ব্যবস্থার আওতায় কোটা বাংলাদেশে পোশাক শিল্প তৈরিকে বিকশিত করছে। চট্টগ্রাম ও মংলার সমুদ্রবন্দর এই শিল্পের মেরুদণ্ড। এগুলি দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া থেকে কাঁচামাল আমদানি ও তৈরি পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রদান করে। তবে চট্টগ্রামে ভারী যানজটের কারণে ব্যবসায়ীদের প্রায়ই তাদের পণ্য লোড–আনলোড করতে অসুবিধা হয়। মংলা বন্দরে এখনও তেমন কোনও চাপ নেই বলে বস্ত্র ব্যবসায়ী ও নির্মাতারা তাঁদের পণ্য রপ্তানির জন্য একেই ব্যবহার করছেন। গত বছরের জুলাই মাসে মোট ২৭টি পোশাক কারখানার পোশাক রপ্তানির জন্য একটি জাহাজ মংলা বন্দর থেকে পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিশেষ করে মংলা বন্দর রাজধানী ঢাকার অনেক কাছাকাছি হওয়ায় এই ধরনের চালান বাড়তে পারে, কারণ এই পোশাক শিল্পের অনেকেরই সেখানে অফিস রয়েছে। গত বছর পদ্মা সড়ক ও রেলসেতু নির্মাণের ফলে ঢাকা ও মংলা বন্দরের মধ্যে যাতায়াত আরও সহজ হয়েছে। মংলা বন্দরে বিনিয়োগ করা এবং তার পরিচালনের অধিকার (সীমিত হলেও) অর্জন করা চিনকে তার পোশাক ব্যবসায় সহায়তা করবে।

ভারত–বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য থেকে লাভ তোলা

ভারতের জন্যও মংলা বন্দরের উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। বন্দরটি সুবিধাজনকভাবে ভারতের কলকাতা বন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত, এবং এটি বাণিজ্যের জন্য একটি বিকল্প সমুদ্র পথ হবে, আর ভ্রমণের সময় লাগবে ১৮ ঘণ্টার মতো। একে ব্যবহার করা যেতে পারে ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তে বেনাপোল ও পেট্রাপোলের অভ্যন্তরীণ কনটেনার ডিপোতে যানজট এড়াতে, যেখানে চালান ১৫ দিন পর্যন্ত বিলম্বিত হতে পারে। কলকাতা ও মংলা বন্দরের মধ্যে সমুদ্র সংযোগের ব্যবহার দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান উপকূলীয় শিপিং চুক্তি থেকেও সর্বাধিক সুবিধা পেতে সাহায্য করবে।

ভারতের জন্যও মংলা বন্দরের উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

ভারতের উত্তর–পূর্বের জন্য সমুদ্রে প্রবেশাধিকার

মংলা বন্দরটিকে ভারত তার স্থলবেষ্টিত উত্তর–পূর্বের রাজ্যগুলিকে উন্নত বাণিজ্য ও যোগাযোগের জন্য সমুদ্রে প্রবেশাধিকার দিতে ব্যবহার করতে পারে। এইভাবে বন্দরটি ভারতের এই রাজ্যগুলিকে দেশের বাকি অংশের সঙ্গেও আরও ভালভাবে সংযুক্ত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে, আর এইভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে সরু  শিলিগুড়ি করিডোরকে, যা ‘‌চিকেনস নেক’‌ নামেও পরিচিত। এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর–পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগের জন্য আটটি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। এই রুটগুলো হল চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর থেকে আগরতলা (ভারত) হয়ে আখাউড়া (বাংলাদেশ); সিলেট শহরের (বাংলাদেশ) তামাবিল হয়ে চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর থেকে মেঘালয়ের (ভারতের) ডাউকি পর্যন্ত; শেওলা (ভারত) হয়ে অসমের (ভারত) সুতারকান্দি থেকে চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর; এবং চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর থেকে বিবির বাজার (ভারত) হয়ে ত্রিপুরার (ভারত) শ্রীমন্তপুর পর্যন্ত।

ট্রানজিট বাণিজ্য থেকে ভারতের বাণিজ্যিক সুবিধা

অবশেষে, বাংলাদেশের স্থলবেষ্টিত হিমালয়ের প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটানের ট্রানজিট বাণিজ্যের সুবিধার্থে মংলা বন্দরের ভূমিকার কথা মাথায় রাখা যেতে পারে। ভৌগোলিকভাবে ভারত যেহেতু ট্রানজিটের জন্য পথ প্রদান করে, তাই মংলা বন্দর ও হিমালয়ের দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যের বিকাশ হলে ভারত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। সম্প্রসারিত ও আধুনিকীকৃত করা হলে বন্দরটি একটি আঞ্চলিক বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে, এবং উপ–আঞ্চলিক পর্যায়ে বাংলাদেশ, চিন, ভারত ও মায়ানমার অর্থনৈতিক (বিসিআইএম) করিডোরকে শক্তিশালী করতেও অবদান রাখবে  ।

এইভাবে, মংলা বন্দর বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে ভূ–রাজনৈতিক শক্তির খেলার মধ্য দিয়ে চলার জন্য কৌশলগত সুবিধা প্রদান করে। যেহেতু এর উভয় বৃহদায়তন প্রতিবেশীই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, সেহেতু উভয় দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাবের মধ্যে কূটনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করে উপসাগরের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও তার পাশাপাশি নিজস্ব পরিকাঠামোগত উন্নয়নের স্বার্থকে কাজে লাগানোর জন্য দেশটির সামনে এইটাই উপযুক্ত মুহূর্ত।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.