Published on Dec 27, 2023 Updated 0 Hours ago

ইরান তার ব্রিকস সদস্যপদকে বিদেশনীতির সাফল্য বলে মনে করলেও এই পদক্ষেপটি দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা দেবে কি না, তা অবশ্য সময়ই বলবে।

ইরানের ব্রিকস সদস্যপদ: ‘নতুন বিশ্বকে সম্ভাষণ’?

২০২৩ সালের ২২-২৪ অগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত ১৫তম বার্ষিক ব্রিকস সম্মেলনে ২০২৪ সাল থেকে ছটি নতুন সদস্যকে ব্লকে সংযোজন করা হয়েছে: আর্জেন্টিনা, ইথিওপিয়া এবং মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (ইউএই) ও ইরানের মতো মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (এমইএনএ) অঞ্চলের চারটি দেশনতুন সদস্যদের এ হেন সংযোজনের সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিকস একটি কর্তৃত্ববাদী ব্লক হয়ে ওঠার দিকে ঝুঁকছে, যেহেতু গোষ্ঠীটির নতুন সদস্যদের বেশির ভাগই, বিশেষ করে এমইএনএ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশ স্বৈরাচারী প্রশাসন ব্যবস্থা মেনে চলে প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪০টিরও বেশি দেশ ব্রিকস গোষ্ঠীতে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গোষ্ঠীটি ২০০৯ সালে ব্রিক (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন) হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এক বছর পরে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা গোষ্ঠীটিতে যোগ দেয়, তখন গোষ্ঠীটির নাম বদলে ব্রিকস হয়সম্মেলনের ভাষণে আয়োজক অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ‘ব্রিকস দেশগুলি একত্রে বিশ্ব অর্থনীতির এক চতুর্থাংশের জন্য দায়বদ্ধ, তারা বিশ্ব বাণিজ্যের এক পঞ্চমাংশের জন্য দায়ী এবং বিশ্বের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এই গোষ্ঠীর সদস্য দেশগুলিতে বসবাস করেনযেহেতু আমরা ব্রিকস-এর ১৫তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন করছি - গত বছর ব্রিকস দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল ১৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারব্রিকস দেশগুলিতে মোট বার্ষিক প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ২০ বছর আগে যা ছিল, তার তুলনায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছেচিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন যে, গোষ্ঠীটিতে এই সম্প্রসারণটি সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতার একটি সূচনাবিন্দু হয়ে ওঠার পাশাপাশি স্পষ্টতই ব্রিকস-এর সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়াকে এবং বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নকে শক্তিশালী করে তোলে

 

প্রাথমিক ভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে, ব্রিকস প্রথমে নতুন সদস্যদের সংযোজনের জন্য একটি প্রক্রিয়া তৈরি করবেকিন্তু সেই ব্যবস্থা স্থাপনের আগেই ঘোষিত সংযোজনগুলি একটি স্বতঃস্ফূর্ত পদক্ষেপ হিসাবে উঠে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

 

নতুন সংযোজনের ফলে গোষ্ঠীটি এ বার বিশ্ব জনসংখ্যার অর্ধেকের প্রতিনিধিত্ব করবে। এ ছাড়াও আগামী বছর থেকে বর্ধিত গোষ্ঠীটিকে ‘BRICS+’/ ‘ব্রিকস প্লাস’… যে তকমাই দেওয়া হোক না কেন, তার মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম হাইড্রোকার্বন শক্তি ভোক্তা অর্থাৎ চিন এবং বিশ্বের বৃহত্তম শক্তি উৎপাদনকারী সৌদি আরব অন্তর্ভুক্ত থাকবে শীর্ষ সম্মেলনের একটি মূল বিষয় ছিল ডি-ডলারাইজেশনের প্রতি গোষ্ঠীটির আকাঙ্ক্ষা, যে কথা সম্প্রতি ব্রিকস-এর সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কঅর্থাৎ নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের (এনডিবি) প্রধান ব্রাজিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ চিনের স্টেট ব্রডকাস্টার সিসিটিভিকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে স্পষ্টতই ব্যক্ত করেছেনপ্রকৃত পক্ষে, প্রাথমিক ভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে, ব্রিকস প্রথমে নতুন সদস্যদের সংযোজনের জন্য একটি প্রক্রিয়া তৈরি করবেকিন্তু সেই ব্যবস্থা স্থাপনের আগেই ঘোষিত সংযোজনগুলি একটি স্বতঃস্ফূর্ত পদক্ষেপ হিসাবে উঠে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বা অন্য ভাবে দেখলে বলা যায়, সংযোজনের বিষয়টি নানা দেশের তরফে চাপ বৃদ্ধির ফলে ঘোষিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মিশরের সংযোজনের জন্য সহযোগী আফ্রিকান রাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইরানের জন্য রাশিয়া সম্ভবত চিন যথেষ্ট চাপ দিয়েছিল। এই নিবন্ধটিতে ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সংযোজন, ব্রিকস ব্লকে প্রবেশাধিকার লাভের পরবর্তী প্রেরণা, ইরানের অভ্যর্থনা এবং দেশটির গোষ্ঠীটিতে প্রভাবের উপর আলোকপাত করা হয়েছে

 

ব্রিকস- ইরানের প্রবেশ

ব্যাপক ভাবে এমনটাই অনুমান করা হয় যে, তেহরানের সদস্যপদের জন্য মস্কো যথেষ্ট চাপ দিয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা ও তার ফলে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তার মোকাবিলা করতে ও নিজের ক্ষমতা জোরদার করতে চিন তেহরানের সদস্যপদের বিষয়টিকে সমর্থন জুগিয়েছে। ইরানের জন্য আসন্ন ব্রিকস সদস্যপদ নানাবিধ কারণে একটি প্রচারমূলক সাফল্যের সমান: প্রথমত, তা একটি অ-পশ্চিমী শক্তি অর্থাৎ প্রাথমিক ভাবে চিন এবং রাশিয়ার নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠার জন্য তেহরানের বিবৃত লক্ষ্য দৃষ্টিভঙ্গিকে শক্তিশালী করে, যার ফলে পশ্চিমী ক্ষমতার চূড়ান্ত পতনই পরিলক্ষিত হয় দ্বিতীয়ত, এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ইরান ঘোষণা করতে পারে যে, তারা ওয়াশিংটন বা পশ্চিমী শক্তিদের ছাড় না দিয়েই মার্কিন চাপ মোকাবিলায় সফল হচ্ছে। তেহরানের জন্য দুই আঙ্গিক থেকেই ব্রিকস-এ সংযোজন তার লুক টু দি ইস্টবা প্রাচ্যপন্থীভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সুনিশ্চিত করে এবং পশ্চিমের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বমূলক অবস্থানকেই ইঙ্গিত করে

 

তেহরানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কর্মসূচি মেনে নিতে হবে না অথবা সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন অর্থ পাচারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করতে হবে না।

 

এই দৃষ্টিভঙ্গি ইরানি আধিকারিক এবং প্রধান প্রশাসনিক সংস্থার প্রতিক্রিয়াতেও প্রতিফলিত হয় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন যে, ব্লকে তার দেশের সংযোজন আসলে একটি ঐতিহাসিক অর্জনকেই নির্দেশ করে। ইরানে অতি-মৌলবাদী দৈনিক সংবাদপত্র কায়হান প্রথম পাতায় এই সংবাদটি তুলে ধরেছে, যার শিরোনাম ছিল জিসিপিওএ এবং এফএটিএফ-হীন: ইরানের ব্রিকস সদস্যপদের অর্থ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রত্যুত্তর অন্য কথায় বলতে গেলে, তেহরানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কর্মসূচি মেনে নিতে হবে না অথবা সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন অর্থ পাচারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করতে হবে না। আবার ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পোরালস (আইআরজিসি) অনুষঙ্গী দৈনিক সংবাদপত্র জাভান-এর প্রথম পৃষ্ঠার প্রতিক্রিয়ায় একটি উদীয়মান বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে ইরানের নেতৃত্বের ধারণাকেই সশক্ত করা হয়েছে: হ্যালো টু দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড (সালাম বার জাহান-ই জাদিদ)। তেহরান যা পেতে নিশ্চিত হয়েছে, তা হল ১) এই জুলাই মাসে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) পূর্ণ সদস্যপদ; ২) গত মার্চ মাসে চিনের মধ্যস্থতায় আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবের সঙ্গে সমঝোতা; ৩) ওয়াশিংটনের সঙ্গে চুক্তিতে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ফ্রোজেন বা আটক ইরানি সম্পদের স্থগিতকরণ সংক্রান্ত প্রসঙ্গে; এবং ৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ভাবেই শাসনবিরোধী বিক্ষোভ দমন করলে বা তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করলেও গোষ্ঠীর সহ-সদস্যরা নিশ্চিত করেছে যে, ইরানকে পশ্চিমের তরফ থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যয় নিয়ে জর্জরিত হবে না। এর পাশাপাশি তেহরান ব্রিকস সদস্যপদকে বিদেশনীতির আর একটি সাফল্য বলেই মনে করে।

 

সম্ভাব্য জটিলতা

কাগজ-কলমে ব্রিকস সম্প্রসারণ গোষ্ঠীটির ভূ-অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে উন্নীত করার জন্য একটি মাইলফলক স্থাপন করে এবং এ ভাবে একটি অ-পশ্চিমী বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণের দিকে একটি উল্লেখযোগ্য গুণগত পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে। ব্রিকস-এর সম্প্রসারণ এবং ইরানের সংযোজন করার বিষয়ে সফল হওয়া সত্ত্বেও একটি অ-পশ্চিমী বিশ্বব্যবস্থার রৈখিক বিকাশের প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য জটিলতা বিদ্যমানপ্রথমত, এমনকি ইরানেও প্রশাসকদের দেওয়া এ হেন পরিস্থিতির প্রতি সংশয় রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইরানের সংস্কারবাদী দৈনিক সংবাদপত্র হাম-মিহান তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক আলি রেজা সোলতানির একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশ করেছে সেখানে সোলতানি এই ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন যে, ইরানের অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক চ্যালেঞ্জগুলি শুধু মাত্র ব্রিকস সদস্যপদের মাধ্যমেই সমাধান করা হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, এই জাতীয় ধারণা ভুল এবং অবাস্তবএর পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন যে, ব্রিকস- জড়িত থাকার বিষয়টি একক ভাবে তেহরানের জটিল সমস্যাগুলির মোকাবিলা করবে না। প্রকৃতপক্ষে, এই যুক্তিটি এই উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে যে, পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞা হ্রাস এবং পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ছাড়া ইরানের অর্থনৈতিক সঙ্কট একটি আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কিং আর্থিক ব্যবস্থা দ্বারা পর্যাপ্ত ভাবে সমাধান করা যাবে না, যেখানে এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আধিপত্য বজায় রেখেছে।

 

ইরানের সংস্কারবাদী দৈনিক সংবাদপত্র হাম-মিহান তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক আলি রেজা সোলতানির একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশ করেছেসেখানে সোলতানি এই ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন যে, ইরানের অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক চ্যালেঞ্জগুলি শুধু মাত্র ব্রিকস সদস্যপদের মাধ্যমেই সমাধান করা হবে।

 

দ্বিতীয়ত, ব্রিকস কোনও ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নয় কারণ এটিতে আনুষ্ঠানিক সংস্থার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপাদান অর্থাৎ একটি সঠিক সনদ, একটি সচিবালয়, সদস্যপদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ড সম্প্রসারণের পদ্ধতির অভাব রয়েছে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য গোষ্ঠীটির কোনও কার্যকরী ওয়েবসাইটও ছিল না। তৃতীয়ত, দেড় দশক আগে ব্রিক(স)-এর সূচনার পর থেকে গোষ্ঠীটির উন্নয়নের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে বাস্তবায়িত হবেই, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই, তা সে ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রেই হোক বা আন্তঃ-ব্রিকস(+) বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই হোক না কেন। চতুর্থত, ইরানের বিদেশনীতির আধিকারিকরা বলেছেন যে, তেহরানের ব্রিকস সদস্যপদ জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন-এর (জেসিপিওএ) পুনরুজ্জীবন এবং পশ্চিমের সঙ্গে অনুরূপ বিকল্পগুলিকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলবে তা সত্ত্বেও ২০ অগস্ট চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই ইরানি বিদেশমন্ত্রীকে জেসিপিওএ-এর পূর্ণ কার্যকর বাস্তবায়নঅনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তেহরান সহজে এই চুক্তি বাতিল করতে পারে না। ইরানের নেতৃত্ব তেহরান জেসিপিওএ-র পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তাকে হ্রাস করার জন্য একটি কৌশলগত সঙ্কল্প প্রদর্শন করেছে। পশ্চিমী চাপ, বিশেষ করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে, ইরানি রাষ্ট্রের ব্যবহার পরিবর্তন করতে সক্ষম নয়এমন একটি ক্রমবর্ধমান উপলব্ধির কারণে এ হেন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপটে ব্রিকস-এ যোগদান এই ধারণাকেই আরও সশক্ত করতে পারে, যা আখেরে ইঙ্গিত করে যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র পশ্চিমীদের চাপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উচ্চ স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে।

 

সর্বাঙ্গীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রভাব

স্বল্প মেয়াদে ব্রিকস-এ ইরানের সম্ভাব্য সদস্যপদ রাশিয়া ও চিনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য প্রশাসনের ক্ষেত্রে একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। এর কারণ হল ইরান ব্রিকস-এর সদস্যপদকে তার লুক টু দি ইস্টবা প্রাচ্যপন্থীকৌশলের একটি বাস্তব ফলাফল বলে মনে করে। চিনের ক্ষেত্রে এই সদস্যপদ বেজিংকে ইরানের তেলের উপর বৃহত্তর ছাড়, সুযোগ এবং চিনা উদ্যোগগুলিকে ইরানের বাজারে সম্পৃক্ত থাকার জন্য বিনিয়োগের জন্য লোভনীয় প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে ইরানকে সুযোগ করে দিতে পারে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে তেহরান মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং পশ্চিমী শক্তি দ্বারা আরোপিত বিচ্ছিন্নতা মোকাবিলা করার উদ্যোগের প্রস্তাব করার জন্য আগ্রহ দর্শাতে পারে। এই ধরনের উদ্যোগের অন্যতম উদাহরণ হল নর্থ-সাউথ করিডোরএটি এমন একটি রেলপথ যা রাশিয়াকে ইরানের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে

 

স্বল্প মেয়াদে হোয়াইট হাউস যে পরিমাণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ইচ্ছুক এবং ইরানের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বৃদ্ধি করতে আগ্রহী, তাতেই ইরানের সাফল্য দর্শাবে।

 

সুতরাং, ইরান স্বল্প মেয়াদে পশ্চিমী স্বার্থের মূল্যে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করার বিষয়ে আগ্রহ প্রদর্শন করবেযাই হোক, স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক সুবিধাগুলি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। কারণ নিষেধাজ্ঞাগুলি এখনও একটি বাধা হিসাবে রয়ে গিয়েছেসামগ্রিক ভাবে, স্বল্প মেয়াদে হোয়াইট হাউস যে পরিমাণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ইচ্ছুক এবং ইরানের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বৃদ্ধি করতে আগ্রহী, তাতেই ইরানের সাফল্য দর্শাবে। বাইডেন প্রশাসনের  অধীনে বর্তমান সমীকরণ তেহরানের পক্ষে অনুকূল বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া, ব্রিকস+ সদস্যদের বৈচিত্র্যের দরুন ব্লকটি নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হবে কি না, তার উপরেও নির্ভর করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পশ্চিমের সঙ্গে, বিশেষ করে রাশিয়া, চিন এবং ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষের চেষ্টায় রত সদস্য-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে এবং পশ্চিমের সঙ্গে সহাবস্থানে আগ্রহী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, আর্জেন্টিনা, মিশরের মতো দেশগুলির মধ্যে একটি আন্তঃগোষ্ঠীমূলক দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে ইরান উদীয়মান বিশ্বব্যবস্থা গঠনে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণের উপায় হিসাবে ব্রিকস-এর সদস্যপদকে বিবেচনা করে। ব্লকের মধ্যে একটি সংশোধনবাদী অবস্থানের সুবিধার্থে ইসলামি প্রজাতন্ত্র পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে ব্রিকস-এর সম্মিলিত বিরোধিতাকেই প্রসারিত করতে চায় প্রধান ব্রিকস সদস্যরা একটি নতুন এবং পুনর্সংজ্ঞায়িত বিশ্বব্যবস্থায় আগ্রহ প্রদর্শন করলেও সাম্প্রতিক সম্প্রসারণ এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করে। গোষ্ঠীটি এখন ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সূচক-সহ নানাবিধ শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে কিছু সদস্যের নিজেদের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতামূলক সমীকরণ রয়েছে। এই জটিলতার আলোকে, বিশ্ব শৃঙ্খলা পুনর্নির্মাণে একটি কেন্দ্রীয় সমন্বিত ভূমিকা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিকস-এর প্রচেষ্টা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এর ফলস্বরূপ, তা ইরানের শাসকগোষ্ঠীর জন্য কাঙ্ক্ষিত বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষিতে একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

ব্লকের মধ্যে একটি সংশোধনবাদী অবস্থানের সুবিধার্থে ইসলামি প্রজাতন্ত্র পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে ব্রিকস-এর সম্মিলিত বিরোধিতাকেই প্রসারিত করতে চায়

 

সর্বোপরি, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতির অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলির মধ্যে বড় ধরনের চ্যুতি যে আবার দেখা দেবে না, সে সম্ভাবনাও একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্ভাব্য স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তেহরান যদি আক্রমণাত্মক না হয় এবং আঞ্চলিক প্রতিরোধের অক্ষকে জোরপূর্বক পুনরায় সক্রিয় করতে চায়, তা হলে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিকে ব্যাহত করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াসের প্রেক্ষিতে ইরান-সৌদি আরব সমঝোতা বরং স্বল্পস্থায়ী বলে প্রমাণিত হতে পারে। একটি ইরাকি সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, ১৫ অগস্ট বাগদাদ সফরের পরে আইআরজিসি-র কম্যান্ডার-ইন-চিফ ইসমাইল কানি ইসলামি প্রতিরোধের সমন্বয় বোর্ডের নেতাদের এই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক জোট বাহিনীর বিরুদ্ধে সমস্ত সামরিক অভিযান বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এর বিপরীতে ইরানের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধের অক্ষর চূড়ান্ত পুনরুজ্জীবন পূর্বোল্লিখিত বিদেশনীতির সাফল্যের ধারাবাহিকতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার উপলব্ধির কারণে ইরানি উন্মাদনার নতুন আবেগ দ্বারা প্ররোচিত হলেও তা সত্যিই সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সমঝোতা এবং শক্তি সরবরাহের প্রয়োজনের কারণের চিনা স্বার্থের অনুকূল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতা সেই দুই সম্ভাবনাকেই বিপদের মুখে ফেলতে পারে।

 


আলি ফাতোল্লা-নেজাদ সেন্টার ফর মিডল ইস্ট অ্যান্ড গ্লোবাল অর্ডার-এর (সিএমইজি) প্রতিষ্ঠাতা ও ডিরেক্টর এবং বহু আলোচিত ইরান ইন অ্যান ইমার্জিং নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ (২০২১) বইয়ের লেখক।

আমিন নায়েনি মেলবোর্নের ডাইকিন ইউনির্ভাসিটির আলফ্রেড ডাইকিন ইনস্টিটিউট ফর সিটিজেনশিপ অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশন-এর (এডিআই) রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং গবেষক। তিনি সিএমইজি-র একজন ফেলোও।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.