Author : Soumya Bhowmick

Published on Jan 02, 2022 Updated 0 Hours ago

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের প্রভাবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হলে ভারতকে তার অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও আঞ্চলিক সমন্বয়ের উদ্যোগকে জোরদার করতে হবে।

ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনীতি: অচ্ছেদ্য চিনা সংযোগ ও ভারতীয় চ্যালেঞ্জ

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলটিতে পণ্য ও উপাদানগত (‌ফ্যাক্টর)‌ বাজার হিসেবে বিপুল অর্থনৈতিক সুযোগ রয়েছে, কারণ এই অঞ্চলটি গঠিত ৩৮টি দেশ নিয়ে, এখানে বিশ্বের জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ বা ৪৩০ কোটি মানুষ বসবাস করেন, এবং বিশ্বের মোট আভ্যন্তর উৎপাদন বা জিডিপি–র ৬৩ শতাংশ এখান থেকেই আসে। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বের সামুদ্রিক বাণিজ্যের ৫০ শতাংশের বেশি এই অঞ্চলেই হয়। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সব ঘটনা ঘটছে তার মধ্যে আছে অঞ্চলটির দেশগুলির মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক অংশীদারির বর্ধিত প্রাণশক্তি, এবং অঞ্চলের বাইরের আগ্রহী দেশগুলির সঙ্গে মিলে চিনের প্রবল উপস্থিতির মোকাবিলা করা।

সন্দেহ নেই যে বেজিং অনেক বছর ধরে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলির চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত হয়, আর ভারত ও সিঙ্গাপুরের বাণিজ্যিক ঘাটতি। বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত উপভোগ করার পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান চিনকে পেয়েছে তাদের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে, এবং চিনে রফতানি করাটা তাদের নিজস্ব অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। তাই, রাজনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও এই দেশগুলির পক্ষে বেজিংয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে কোনও ঘটনার ফলস্বরূপ তাদের পণ্যের জন্য চিনা চাহিদা কমে না যায়।

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব ঘটনা ঘটছে তার মধ্যে আছে অঞ্চলটির দেশগুলির মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক অংশীদারির বর্ধিত প্রাণশক্তি, এবং অঞ্চলের বাইরের আগ্রহী দেশগুলির সঙ্গে মিলে চিনের প্রবল উপস্থিতির মোকাবিলা করা।

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান দেশগুলির সঙ্গে চিনের বাণিজ্যের পরিমাণ সব সময়েই ছিল বিশাল, এবং তা আরও বাড়ছে। নিচের চিত্রে দেখা যাবে গত দেড় দশকে এই প্রবণতা ইতিবাচক। এই প্রবণতার ব্যতিক্রমের খুব কম দৃষ্টান্ত রয়েছে:‌ ২০০৭-০৮ সালে যা ঘটেছিল তার জন্য দায়ী ছিল বিশ্বজনীন আর্থিক সঙ্কট, যা ২০১০ সালের মধ্যে ধীরে ধীরে আবার আগের জায়গায় ফিরে গিয়েছিল।

চিত্র ১: ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান দেশগুলির সঙ্গে চিনের বাণিজ্যের পরিমাণ (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

 Indo Pacific Economics Inextricable Chinese Linkages Indian Challenges
সূত্র: লেখকের নিজস্ব, ওয়ার্ল্ড ইন্টিগ্রেটেড ট্রেড সলিউশন (ডবলিউআইটিএস) ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য।

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে চিনের অচ্ছেদ্য সংযোগের কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে আঞ্চলিক মূল্য শৃঙ্খলে এই দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের মধ্যে। এটি সেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে একটি যা এই অঞ্চলের দেশগুলির পক্ষে চিনকে এড়িয়ে পশ্চিমের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পুরোপুরি প্রসারিত করে তোলার পথে বাধা হয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ার কৃষি পণ্যগুলো বিশ্ব মূল্য শৃঙ্খলের (জিভিসি’‌স) উপর ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল, আর তার জন্য সেখানে চিন থেকে প্রচুর পরিমাণে আমদানি করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত দেশগুলি চিনের উপর নির্ভর করে অ্যাপল, শাওমি, লেনোভো ও হুয়াওয়ের মতো সংস্থাগুলির স্মার্টফোন উৎপাদনের জন্য ইনপুট হিসাবে প্রয়োজনীয় উচ্চ-প্রযুক্তির উপাদানের জন্য। এই উপাদানগুলো বেশিরভাগই চিনে অ্যাসেম্বল করা হয়, এবং তারপর অন্যান্য দেশে সরবরাহ করা হয়।

চিন যে ভাবে বহির্মুখী প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রে বিশ্বে নেতৃত্ব দেয়, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও তার প্রতিফলন ঘটে। চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখী প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ তুলনামূলক ভাবে ভারত এবং এই অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে প্রবাহের থেকে অনেক বেশি। বছরের পর বছর ধরে, চিন তার উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জালিকার বিস্তার ঘটিয়েছে। এই বিআরআই, প্রায়শই যেটিকে প্রাপক দেশগুলির দীর্ঘমেয়াদি ঋণ–পরিস্থিতি খারাপ করার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, তা এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিতে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে চিনের অচ্ছেদ্য সংযোগের কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে আঞ্চলিক মূল্য শৃঙ্খলে এই দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের মধ্যে।

চিনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের নোঙর ক্রমশ শক্তপোক্ত করে তোলার একটি বড় কারণ। বেজিং যে ভাবে অতিমারির সমস্যার মোকাবিলা করেছে তা নিয়ে ওঠা নানা অভিযোগ, গত কয়েক বছরে ভারত ও চিনের মধ্যে সামরিক অচলাবস্থা, অস্ট্রেলিয়ার বার্লির উপর ৮০ শতাংশ শুল্ক বসানো, এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে অতিমারির সময় চিনের কারণে সরবরাহ-শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ার ঘটনায় ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির অর্থনৈতিক গতিশীলতা বদলে যেতে শুরু করেছে। এমনকি ঐতিহাসিক ভাবে যে সংগঠনটি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিষয়ে চুপচাপ থাকতেই চাইত, সেই অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) ২০১৯ সালে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ‘আসিয়ান আউটলুক’‌ শুরু করেছে, যা থেকে বোঝা গেছে তারা এই অঞ্চলে নিজের আঙিনার নতুন গতিশীলতার দিকে লক্ষ্য রাখছে।

ভারত একটি প্রধান অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য এবং সংযোগে আরও বড় ভূমিকা নেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালে কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ (সিআইআই)–এর করা সমীক্ষা অনুসারে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নির্বাচিত ২০টি অর্থনীতির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ২০০১ সালের থেকে আট গুণ বেড়েছে। এই অর্থনীতিগুলির সঙ্গে ভারতের সম্মিলিত বাণিজ্য ২০০১ সালে যেখানে ছিল ৩,৩০০ কোটি মার্কিন ডলার, তা বেড়ে ২০২০ সালে হয়েছিল ২৬,২০০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক সংযোগ বা নেতৃত্ব সীমিত থেকে গেছে। এর মধ্যে আছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকেন্দ্রিক পরিষেবা ক্ষেত্রটির মধ্যে বৈচিত্রের অভাব; ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে কম এফডিআই–প্রবাহ; এবং ভারতে এমন বড় বহুজাতিক সংস্থার অভাব যারা আঞ্চলিক সরবরাহ শৃঙ্খলের বিভিন্ন অংশে নিজেদের যুক্ত করতে পারে।

বিআরআই, প্রায়শই যেটিকে প্রাপক দেশগুলির দীর্ঘমেয়াদি ঋণ–পরিস্থিতি খারাপ করার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, তা এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিতে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ক্রমবর্ধমান চিনা প্রভাব মোকাবিলায় মোটেই যথেষ্ট নয়। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার ক্রিয়াকৌশলের মূল উপাদান হিসেবে ভারত রেখেছে আসিয়ানকে, আর চেষ্টা করছে আসিয়ান–এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারি গড়ে তোলার:‌‌ কিন্তু আসিয়ান-এর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ চিনের ধারেকাছেও নেই। বিষয়টি নিচের চিত্র দেখলেই স্পষ্ট হবে। গত ১২ বছর ধরে চিন আসিয়ান-এর বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, এবং এই বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ছাড়িয়ে আসিয়ান চিনের বৃহত্তম বাণিজ্য ব্লকে পরিণত হয়েছে।

চিত্র 2: চিন-আসিয়ান বাণিজ্য বনাম ভারত-আসিয়ান বাণিজ্য, ২০২০-২১ (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে) Figure 2

 Indo Pacific Economics Inextricable Chinese Linkages Indian Challenges
সূত্র: লেখকের নিজস্ব, চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইমপোর্ট এক্সপো–র, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণাল‌য়ের, এবং ভারত সরকারের তথ্য।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বৃহত্তর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য আসিয়ান-এর সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরতর করার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর অর্থনৈতিক প্রভাব চিনকে এই অঞ্চলে তার অবস্থান সুসংহত করতে সহায়তা করে। একথা ঠিক যে চিনের আক্রমণাত্মক উত্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির কাছে বড় ধরনের কৌশলগত ও নিরাপত্তা উদ্বেগ হিসেবে থেকেই যাচ্ছে;‌ কিন্তু বেজিংয়ের সঙ্গে সমৃদ্ধ বাণিজ্যের সুবিধা বেজিংকে অখুশি করার মতো কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বেশিরভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশকে দু’‌বার ভাবায়। এমনকি অন্যরাও, যেমন বেজিংয়ের বিরুদ্ধে জোটের অগ্রণী অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলিও, একই শ্রেণিভুক্ত। এই দেশগুলি চিনকে তাদের নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য একটি গুরুতর বিপদ হিসেবে দেখলেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই দেশগুলিকে অর্থনৈতিক ভাবে চিনের উপর নির্ভরশীল করে রেখেছে।

চিনের আক্রমণাত্মক উত্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির কাছে বড় ধরনের কৌশলগত ও নিরাপত্তা উদ্বেগ হিসেবে থেকেই যাচ্ছে;‌ কিন্তু বেজিংয়ের সঙ্গে সমৃদ্ধ বাণিজ্যের সুবিধা বেজিংকে অখুশি করার মতো কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বেশিরভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশকে দুবার ভাবায়।

তাই, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত গুরুত্ব অর্জনের জন্য ভারতের নিজস্ব অর্থনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানো ও আঞ্চলিক সমন্বয়ের উদ্যোগ জোরদার করা প্রয়োজন। ভারতীয় অর্থনীতি এখনও দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত অর্থনীতির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো জায়গায় নেই;‌ আর সেই কারণেই কোনও বাণিজ্য চুক্তিতে যোগ দেওয়ার ফলে তার অঙ্গ হিসেবে অন্যান্য দেশ থেকে সস্তা আমদানির প্রবাহ শুরু হলে দেশীয় শিল্পগুলি ভেঙে পড়তে পারে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হল দুটোর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য খুঁজে বার করা।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.