Author : Sayantan Haldar

Published on May 12, 2023 Updated 0 Hours ago

বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা ইউরোপীয় কুশীলবদের সঙ্গে ভারতের একত্রিত হওয়ার ভিত্তি প্রদান করতে পারে, বিশেষ করে ইন্দো–প্যাসিফিক প্রেক্ষাপটে

ভারত, ইউরোপ ও বঙ্গোপসাগর: সামুদ্রিক নিরাপত্তা স্বার্থের একত্রীকরণ

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি ও ইতালির মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় শক্তি ইন্দো–প্যাসিফিকের প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে দৃঢ় করেছে। তবে ইউরোপের সমমনস্ক অংশীদারদের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততা ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক বিস্তৃতিতে বৃদ্ধি পেলেও নয়াদিল্লির নিরাপত্তা ও কৌশলগত ক্যালকুলাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগর অঞ্চল কিন্তু ভারত–ইউরোপ সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে একটি প্রান্তিক স্থান হিসাবেই থেকে গেছে। এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয় যে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্য ও সংযোগের উপর ক্রমবর্ধমান নজর, এবং ইউরোপীয় কুশীলব ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততার মধ্যে সামুদ্রিক নিরাপত্তা সম্ভবত বঙ্গোপসাগরে ভারত ও ইউরোপের একত্রিত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে।

ইন্দোপ্যাসিফিকে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান

ইন্দো–প্যাসিফিকের ক্রমবর্ধমান ভূ–রাজনীতি গঠনে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলটি ক্রমশই একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি ভারত ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, দুটি মুখ্য কেন্দ্র যাদের চারপাশে ইন্দো–প্যাসিফিকের ভূ–রাজনীতি বিকশিত হতে থাকে, তাদের সংযুক্ত করে। ভারত মহাসাগরে ভারত ও তাইল্যান্ডের মধ্যে অবস্থিত বাংলাদেশ, মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কা হল বঙ্গোপসাগরের প্রধান উপকূলীয় রাষ্ট্র, যারা একটি বিশাল বৈশ্বিক বাজার ও অর্থনীতির আবাসভূমি। বঙ্গোপসাগর, বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর, দ্রুত ইন্দো–প্যাসিফিকের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রতিযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সেইসঙ্গেই বঙ্গোপসাগরে ভারতের সম্পৃক্ততাকে ক্রমশ বেশি করে এর বৃহত্তর ইন্দো–প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির মূল চালক হিসাবে দেখা হচ্ছে। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক গোষ্ঠী কোয়াড–এ নিজের অংশীদারদের সঙ্গে উপসাগরে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নৌ–সম্পৃক্ততা বৃহত্তর ইন্দো–প্যাসিফিকের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের তাৎপর্য স্পষ্ট করে তোলে। এর বিপরীতে, বঙ্গোপসাগর অঞ্চলটি কিন্তু ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে ইউরোপের সম্পৃক্ততার একটি প্রান্তিক দিক হিসাবে থেকে গেছে।

বঙ্গোপসাগর, বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর, দ্রুত  ইন্দো–প্যাসিফিকের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রতিযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।

ইউরোপ  বঙ্গোপসাগর

তবে বঙ্গোপসাগর ইউরোপের কৌশলগত ক্যালকুলাসে কোনও অভিনব সামুদ্রিক ভূগোল নয়। ঐতিহাসিকভাবে, বঙ্গোপসাগরে ইউরোপীয় শক্তির আগমন এই অঞ্চলটিকে বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। অতি সম্প্রতি ইন্দো–প্যাসিফিককে একটি সমন্বিত স্থান হিসাবে গ্রহণ করার সঙ্গেসঙ্গেই এই অঞ্চলে ইউরোপের দৃষ্টি ক্রমবর্ধমানভাবে বাণিজ্য, সংযোগ, এবং তার ফলস্বরূপ সামুদ্রিক নিরাপত্তার উপর নিবদ্ধ হচ্ছে। এই অঞ্চলের একটি প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তির পরিবর্তে ফ্রান্স এখন নিজেকে ইন্দো–প্যাসিফিকের একটি আবাসিক শক্তি হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছে, এবং এইভাবে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক বিস্তৃতির সঙ্গে দেশটি নিজের কৌশলগত ক্যালকুলাসকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলেছে। অতএব, বঙ্গোপসাগরে ভারত ও তার ইউরোপীয় অংশীদারদের মধ্যে স্বার্থের একত্রীকরণের ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তেমন সুযোগ ও ক্ষেত্রগুলির মানচিত্রায়ণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তা তাদের ইন্দো–প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গিকে শক্তিশালী করতে পারে। এই লক্ষ্যে এই যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্য ও সংযোগের উপর বর্ধিত নজর অনুসরণ করে ইউরোপীয় কুশীলবেরা আঞ্চলিক উপকূলীয় দেশগুলির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা আরও গভীর করতে থাকবে, এবং এইভাবে বঙ্গোপসাগর তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। এর ফলে ইউরোপীয় শক্তিগুলিকে এই অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তার দিকেও মনোনিবেশ করতে হবে, যার ফলে ভারতের সঙ্গে তাদের স্বার্থের সমন্বয় ঘটবে।

সামুদ্রিক নিরাপত্তা স্বার্থ সমন্বিত করার সুযোগ শনাক্ত করা

ভারত তার ইন্দো–প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গিকে মজবুত করার ফলে বঙ্গোপসাগরের তাৎপর্য বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গুরুত্বপূর্ণভাবে, ভারতের ইন্দো–প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যেহেতু আসিয়ানকে কেন্দ্রীয়তা দেওয়া হয়েছে, তাই বঙ্গোপসাগরকে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্য একটি অতি–গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ক্ষেত্র হিসাবে দেখা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আর এর পিছনে রয়েছে ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বন্ধন, এবং নয়াদিল্লির তৈরি করা সাম্প্রতিক কৌশলগত পরিপূরকগুলি।

অধিকন্তু, ইন্দো–প্যাসিফিকের প্রেক্ষাপটে, ভারত ও ইউরোপ কৌশলগত অভিন্নতার জায়গাগুলি চিহ্নিত করেছে, এবং তা মজবুত করার জন্য কাজ করেছে। এই অঞ্চলের দিকে ইউরোপের মনোনিবেশের সঙ্গেসঙ্গেই সামুদ্রিক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা ইউরোপীয় শক্তিগুলির গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত ফোকাস হয়ে উঠেছে। যেহেতু ভারত উপসাগরকে সুরক্ষিত করতে আগ্রহী, তাই উপসাগরটি ইউরোপের বাণিজ্য ও সংযোগের সুবিধার্থে একটি মূল ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকলে ইউরোপীয় কুশীলবেরাও আরও বড়ভাবে এর সঙ্গে জড়িত হবে।

এই অঞ্চলের একটি প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তির পরিবর্তে ফ্রান্স এখন নিজেকে ইন্দো–প্যাসিফিকের একটি আবাসিক শক্তি হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছে, এবং এইভাবে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক বিস্তৃতির সঙ্গে দেশটি নিজের কৌশলগত ক্যালকুলাসকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলেছে।

ভারতের জন্য ভৌগোলিক আবশ্যিকতা বঙ্গোপসাগরে তার ব্যস্ততার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ঐতিহাসিকভাবে ভারতের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও আদর্শিক আদান–প্রদানের বেশির ভাগটাই বঙ্গোপসাগর সহজতর করেছে। আজও পূর্ব উপকূলে ভারতের সামুদ্রিক সীমানা তার ক্রমবর্ধমান সমুদ্রবাহিত বাণিজ্যের মূল চাবিকাঠি। যাই হোক, আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল ভারত মহাসাগরে ভারত ও চিনের মধ্যে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হওয়ার ফলে বঙ্গোপসাগর ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক ভূগোল হিসাবে বিকশিত হতে পারে। ভারতের উপকূলবর্তী এলাকায়, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও মায়ানমারে উন্নয়নমূলক প্রকল্পে চিনের সম্পৃক্ততা নয়াদিল্লিতে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সামুদ্রিক নিরাপত্তা ভারতের জন্য একটি জরুরি অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছে। সমমনস্ক অংশীদার দেশগুলির সঙ্গে সামুদ্রিক অনুশীলনের স্থান হিসাবে নয়াদিল্লির দৃষ্টি বঙ্গোপসাগরে স্থানান্তরিত হওয়া, সেইসঙ্গে তার সামুদ্রিক প্রতিবেশী অঞ্চলে তার পৌঁছের একটি মূল হাতিয়ার হিসাবে নৌ–কূটনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এই সবই বঙ্গোপসাগরকে সুরক্ষিত করার জন্য তার গভীর আগ্রহ ও মনোনিবেশের প্রমাণ।

ইউরোপের জন্য ইন্দো–প্যাসিফিকের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা হল এই অঞ্চলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কেন্দ্রীয় স্তম্ভ। কোনও সংশয় নেই যে ইউরোপ বর্তমানে দীর্ঘস্থায়ী রাশিয়া–ইউক্রেন সংঘাতের মধ্য দিয়ে চলছে। দ্বন্দ্বের প্রভাব বিশ্বজুড়ে অনুভূত হয়েছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে, এবং শক্তির বাজারের ওঠানামা পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলস্বরূপ, ইউরোপের জন্য তার সম্পৃক্ততা বৈচিত্র্যময় করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে বাণিজ্য এবং খাদ্য ও শক্তি নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘‌ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, জনসংখ্যাগত ও রাজনৈতিক ওজন’‌–এর কারণে ইন্দো–প্যাসিফিককে ‘‌অত্যাবশ্যক’‌ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। কিন্তু বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের অতি–গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ক্ষেত্রটি ইউরোপের ইন্দো–প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুপস্থিত। তবে ইউরোপ যখন তার ইন্দো–প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গিকে চালিত করার জন্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা গভীর ও প্রসারিত করছে, সেই সময় এই বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

ইন্দো–প্যাসিফিকের প্রধান ইউরোপীয় কুশীলবদের মধ্যে ফ্রান্সই একমাত্র দেশ যেটি বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত ক্ষেত্রটিতে প্রবেশ করেছে। একথা বলাই যায়, অন্য ইউরোপীয় কুশীলবদের মধ্যে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের ফ্রান্সের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়তার সমন্বয় ঘটেছে। ভারত ও ফ্রান্স এই বিষয়টিই ২০২১ সালে বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তুলে ধরেছে লা পেরুজ অনুশীলনে ভারতের প্রথম অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ফরাসি নেতৃত্বাধীন নৌ–মহড়াটি বঙ্গোপসাগরে চারটি কোয়াড দেশকে একত্র করে জটিল ও উন্নত নৌ–অভিযান পরিচালনা করেছিল, এবং উচ্চস্তরের সমন্বয় ও আন্তঃকার্যক্ষমতা দেখিয়েছিল। তারপর  ২০২৩ সালে লা পেরুজ বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ব্রিটেনের অংশগ্রহণও প্রত্যক্ষ করেছে।

ভারত ও ফ্রান্স এই বিষয়টিই ২০২১ সালে বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তুলে ধরেছে লা পেরুজ অনুশীলনে ভারতের প্রথম অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

এই বিশ্লেষণের জন্য ইন্দো–প্যাসিফিকের তিনটি শীর্ষস্থানীয় ইউরোপীয় কুশীলবের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যেতে পারে—ফ্রান্স, ব্রিটেন ও ইতালি৷ এই প্রেক্ষাপটে এই দেশগুলি ও ভারতের মধ্যে অভিন্নতার কিছু সম্ভাব্য ক্ষেত্রের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে।

১। ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্স ভারতের প্রধান ইউরোপীয় অংশীদার। ভারত–ফরাসি নৌ–সম্পর্ক বছরের পর বছর ধরে অগ্রসর হয়েছে নৌ–কূটনীতিতে নয়াদিল্লির বর্ধিত মনোযোগের কথা মাথায় রেখে। ২০২১ সাল থেকে ভারত ও ফ্রান্স বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে লা পেরুজ ইন্দো–ফরাসি সহযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে সহযোগিতা প্রদর্শন করেছে, যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা স্থাপত্যে নতুন কুশীলবদের প্রবেশকে আরও সহজ করে তুলতে পারে। বঙ্গোপসাগরের উপর একটি তীক্ষ্ণ নজর এবং এই অঞ্চলে উদ্ভূত অনন্য সামুদ্রিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলি — যেমন জলবায়ু সঙ্কট এবং সামুদ্রিক সন্ত্রাসবাদ ও জলদস্যুতা থেকে উদ্ভূত অপ্রচলিত সামুদ্রিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলি — ভারত এবং ইউরোপ ও বঙ্গোপসাগরের অন্য কোয়াড দেশগুলির মধ্যে স্বার্থের মিলন ক্ষেত্রগুলিকে আরও গভীর করতে সহায়ক হবে।

২। ইন্দো–প্যাসিফিকে ইউকে–র সম্পৃক্ততা ২০২১ সালে ‘‌প্রতিযোগিতামূলক যুগে বৈশ্বিক ব্রিটেন’‌ এবং পরবর্তীতে ‘‌ইন্টিগ্রেটেড রিভিউ রিফ্রেশ ২০২৩‘ নথিতে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ইন্দো–প্যাসিফিকের জন্য ব্রিটেনের ভিশন ডকুমেন্টে বঙ্গোপসাগরের উল্লেখ পাওয়া যায় না। যাই হোক, ভারত ও আসিয়ানের সঙ্গে ব্রিটেনের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা বঙ্গোপসাগরের দিকে তার নজর স্থানান্তরিত করতে সহায়তা করবে।  ব্রিটেন উল্লেখযোগ্যভাবে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের কুশীলবদের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। দেশটি সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের জন্য একটি নতুন হাব চালু করেছে, সেইসঙ্গে ২০২২ সালে একটি ‘‌সংলাপ অংশীদার’‌ হয়ে আসিয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করেছে৷ উপরন্তু, ইন্ডিয়া–ইউকে রোডম্যাপ ২০৩০ অনুযায়ী ভারত ও ব্রিটেন ২০২১ সালে একটি ‘‌ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারি’‌তে সম্মত হয়েছে । ২০২৩ ভিশন ডকুমেন্টে ইউকে ভারতের সঙ্গে অভিন্নতার মূল ক্ষেত্রগুলিকে তালিকাভুক্ত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ভারতের ইন্দো–প্যাসিফিক ওশান’‌স  ইনিশিয়েটিভ অনুযায়ী নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা অংশীদারি শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিতে সহযোগিতার অগ্রগতি, এবং সামুদ্রিক সুরক্ষায় সহযোগিতা করা। এই উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এটি লক্ষণীয় যে উপসাগরের মূল কুশীলবদের সঙ্গে লন্ডনের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততার সঙ্গে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ব্রিটেনের জন্য অগ্রাধিকার হিসাবে বিকশিত হতে পারে।

৩। ইতালি হল ইন্দো–প্যাসিফিক রুব্রিকে সর্বশেষ ইউরোপীয় প্রবেশকারী। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির ভারত সফর ইন্দো–প্যাসিফিকের বিকশিত ভূ–রাজনীতিতে এবং এই অঞ্চলে পরবর্তী অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে রোমের গভীর আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়। যদিও ইতালি এখনও স্পষ্টভাবে তার দৃষ্টিভঙ্গি বা ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজের জন্য কী ভূমিকার কথা ভাবছে তা বলেনি, সম্ভবত এশিয়ার সঙ্গে রোমের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা তার ইন্দো–প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নির্দেশিত করবে। ভারতের ক্ষেত্রে, ইতালি ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৃতীয় সর্বোচ্চ বাণিজ্য অংশীদার। যাই হোক, শক্তিশালী ভারত–ইতালি সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা ইন্ডিয়া–ইতালি–জাপান ট্রাইল্যাটরাল ২০২১ সালে চালু করা হয়েছে৷ জাপান বঙ্গোপসাগরের থিয়েটারে ফিরে এসেছে, এবং ভারত ও জাপান উপসাগরে ব্যাপক মনোযোগ দিয়ে কৌশলগত অংশীদারদের নেতৃত্ব দিচ্ছে৷  উপরন্তু বাংলাদেশ, মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কায় গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক প্রকল্পে জাপান জড়িত। ইন্দো–প্যাসিফিকে ভারত–জাপান সম্পৃক্ততার মূলে রয়েছে উপসাগরীয় অঞ্চলটি। ইতালি ও জাপানও তাদের সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ উন্নীত করে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতি করেছে। একইভাবে, ভারত–ইতালি–জাপান ত্রিপাক্ষিকও ইতালির জন্য ইন্দো–প্যাসিফিকের ভূমিকা বাড়াতে একটি কৌশলগত বিন্দু হতে পারে। বঙ্গোপসাগরের বাণিজ্য ও সংযোগের দিকটির উপর ক্রমবর্ধমান নজর পড়ার পর এই অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তার অগ্রাধিকার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

উপসংহার

বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ইউরোপের উপস্থিতি এখনও প্রান্তিক পর্যায়েই রয়েছে। যাই হোক, ইন্দো–প্যাসিফিকের দিকে তাদের বর্ধিত নজর এবং ভারত ও বঙ্গোপসাগরের অন্য উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে উপসাগর সম্ভবত ইউরোপীয় কুশীলবদের জন্য অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র হিসাবে আবির্ভূত হবে। ভারতের জন্য বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা তার অবস্থানের ভৌগোলিক প্রয়োজনীয়তার কারণেই একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসাবে থাকবে;‌ অন্যদিকে ইউরোপের জন্য বঙ্গোপসাগর তাদের ইন্দো–প্যাসিফিক সম্পৃক্ততার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং, যেহেতু বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত পরিবেশ ভারত ও ইউরোপীয় দেশগুলির বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই এই অঞ্চলকে সুরক্ষিত করা এবং বিস্তৃত ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা তাদের নিজ নিজ কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রস্থলে রয়েছে।

ভারতের জন্য বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা তার অবস্থানের ভৌগোলিক প্রয়োজনীয়তার কারণেই একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসাবে থাকবে;‌ অন্যদিকে ইউরোপের জন্য বঙ্গোপসাগর তাদের ইন্দো–প্যাসিফিক সম্পৃক্ততার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

ঐতিহাসিক অতীত, পূর্ববর্তী ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের সময় ইউরোপীয় শক্তিগুলির ভূমিকা, এবং ভারত মহাসাগরের ভূ–রাজনীতির পরিবর্তনে এর দীর্ঘায়িত প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে, ইউরোপের নীতিনির্ধারকেরা যদি এই অঞ্চলে তাঁদের ভূমিকা চিহ্নিত করার সময় এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা অন্বেষণের সময় সচেতন হন, তবে তা সহায়ক হবে। উপরন্তু, ভারত তথা ইউরোপের নীতিনির্ধারকদের সতর্কতার সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে চিনা প্রেসিডেন্ট শি–র সাম্প্রতিক বৈঠক এবং একটি উদীয়মান চিন–রাশিয়া অক্ষের সম্ভাবনার দিকে নজর রাখা উচিত।

তবে ইন্দো–প্যাসিফিকের উপর ইউরোপের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত দৃষ্টিপাত এবং আঞ্চলিক কুশীলবদের সঙ্গে গভীর সহযোগিতার সময়ে বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবে ইউরোপীয় কুশীলব ও ভারতের মধ্যে একমুখিতার ভিত্তি প্রদান করতে চলেছে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.