Image Source: Reuters
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।
কোনও অবসানের সম্ভাবনা ছাড়াই ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে গাজায় সংঘাত অব্যাহতই রয়েছে এবং একটি ক্রমবর্ধমান দৃশ্যমান বৃহৎ শক্তি প্রতিযোগিতা কিছু অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠীকে এমন সুযোগ করে দিয়েছে, যার সুবিধা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি পেয়েই চলেছে। এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমী মিত্ররা এবং অন্য দিকে রাশিয়া ও চিন একটি ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক বিচ্যুতির সূচনা করেছে, যা অনেক দেশের জন্যই উদ্বেগের বিষয়। তবে হামাস ও আফগান তালিবানদের জন্য এই বিভাজন একটি সুযোগ অবশ্যই।
দ্বিতীর বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ধীর গতিতে ভেঙে পড়ার বিষয়টি অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে কেবল তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও আদর্শগত লক্ষ্যগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যথেষ্ট সুযোগই করে দেয়নি, এর পাশাপাশি রাষ্ট্রপুঞ্জ, ক্লাবহাউস এবং তার নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসি) মতো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় নিজেদের প্রবেশাধিকারের আরও সুযোগ করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম এশিয়ার আঞ্চলিক গণমাধ্যমের বেশ কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, দোহায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর নেতা ইসমাইল হানিয়াহ এবং কাতারে চিনের রাষ্ট্রদূত কাও জিয়াওলিনের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে। হানিয়াহ গাজায় বিদ্যমান যুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জে চিনের ভূমিকা ও অবস্থানের প্রশংসা করেছেন এবং ফিলিস্তিনি আগ্রহের পক্ষে ছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি বেজিংয়ের মানবিক সহায়তার কথাও তুলে ধরেন।
রাশিয়া সম্প্রতি ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যার মধ্যে হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ উভয়েরই প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
অন্য দিকে, রাশিয়া সম্প্রতি ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যার মধ্যে হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ উভয়েরই প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এই বৈঠক চলাকালীন একটি ঐক্যবদ্ধ প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের জন্য তাঁর দেশ অর্থাৎ রাশিয়ার সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এটি এমন একটি প্রচেষ্টা যা হামাসকে ফাতাহের সঙ্গে মিলে কাজ করতে সাহায্য করবে। ফাতাহ আসলে এমন একটি ফিলিস্তিনি আন্দোলন গড়ে তুলছে, যারা রাজনৈতিক ও আদর্শগত পার্থক্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে। যাই হোক, এখানে হামাস সম্পর্কে নয়, বরং প্রশ্নটি উঠছে রাশিয়ার লক্ষ্য ও ভূমিকা নিয়ে। কারণ মস্কো ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে এই প্রথম বার নয়, এর আগেও একাধিক বৈঠকের আয়োজন করেছিল।
রাশিয়া ও চিন নতুন আখ্যান নির্মাণ করতে আগ্রহী
মার্কিন নেতৃত্বাধীন আলোচনা গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে এবং বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তা রাশিয়া ও চিনকে শুধু পশ্চিমকেন্দ্রিকই নয়, বরং বিশেষ করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক শক্তি ও নিরাপত্তামূলক নীলনকশা সংক্রান্ত আখ্যানকে নস্যাৎ করার সুযোগ করে দিয়েছে। বেজিং ও মস্কো উভয়েরই ইরানের মতো দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। এই দু’টি দেশই হামাসের প্রাথমিক পৃষ্ঠপোষক এবং অন্য দিকে আবার কাতার - যেখানে হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয় রয়েছে - মধ্যস্থতার বিকল্প প্রদান করে। এই সবই মধ্য শক্তির রাষ্ট্রগুলির নির্দিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক শিবির বা জোটের পাশে না থাকার বদলে তাদের নিজস্ব কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন গড়ে তোলার সুদৃঢ় ইচ্ছাকেই দর্শায়। এমনটা ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েও দেখা গিয়েছিল, যখন পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দিনের মিত্রদেশগুলি রাষ্ট্রপুঞ্জে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট প্রদানে দ্বিধা প্রদর্শন করেছিল।
এর ফলে শুধু হামাসই লাভবান হচ্ছে না। আফগানিস্তানে এখন প্রায় তিন বছরের কাছাকাছি ক্ষমতায় থাকা তালিবানরাও এই প্রচলিত ধারণা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে যে, তারা একটি ‘বিচ্ছিন্ন’ রাষ্ট্র। কাবুলে ধর্মীয় ছাত্রদের একটি সাম্প্রতিক স্নাতক অনুষ্ঠানে তালিবানের রাজনৈতিক বিষয়ক উপ-প্রধানমন্ত্রী মৌলবী আব্দুল কবীর বলেছেন যে, ইসলামিক আমিরাত গোটা বিশ্বের সঙ্গে ‘ব্যবহারিক সম্পৃক্ততা’য় আবদ্ধ এবং কোনও মতেই তারা বিচ্ছিন্ন নয়। উচ্চশিক্ষার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী নেদা মোহাম্মদ নাদিমও একই সুর টেনে বলেছেন যে, ইসলামি পণ্ডিতদের (উলেমাদের) ইসলামি ব্যবস্থা সংরক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে। এই উভয় অবস্থানকেই নারী শিক্ষা ও অধিকারের মতো বিষয়ে পশ্চিম ও রাষ্ট্রপুঞ্জের নেতৃত্বাধীন দাবির বিরুদ্ধে তালিবানদের ফিরে আসার প্রচেষ্টা হিসাবে মনে করা যেতে পারে। কয়েক সপ্তাহ আগে কাতারে রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় রত হয়েছিল পশ্চিম ও রাষ্ট্রপুঞ্জের দলটি।
তালিবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তান আর ‘বিচ্ছিন্ন’ রাষ্ট্র নয়
তালিবান প্রকৃতপক্ষে ভারত-সহ তার বেশির ভাগ আঞ্চলিক প্রতিবেশীর সঙ্গেই সম্পৃক্ত। গোষ্ঠীটি সম্পর্কে তার সরব আশঙ্কা সত্ত্বেও রাশিয়া মস্কো ফরম্যাটকে সুযোগ করে দিয়েছে এবং নিত্যনৈমিত্তিক ভিত্তিতে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছে। চিন অবশ্য আরও এক পা এগিয়ে রয়েছে। জানুয়ারি মাসে শি জিনপিং ব্যক্তিগত ভাবে বেজিংয়ে তালিবানের নতুন রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র গ্রহণ করেন। চিন বর্তমানে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার ও রাজনৈতিক প্রবক্তা।
চিন অবশ্য আরও এক পা এগিয়ে রয়েছে। জানুয়ারি মাসে শি জিনপিং ব্যক্তিগত ভাবে বেজিংয়ে তালিবানের নতুন রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র গ্রহণ করেন।
‘আমরা বনাম ওরা (পশ্চিম)’ জাতীয় ক্রমবর্ধমান বিভাজনমূলক আখ্যানের মাঝেই রাশিয়া ও চিন উভয়ই আরও অস্থিতিশীল ভৌগোলিক পরিস্থিতি ও সমস্যার বিষয়ে তাদের ঝুঁকি মূল্যায়নকে পুনর্নির্মাণ করেছে। ৯/১১-এর ঘটনাকে রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেতু নির্মাণের একটি সুযোগ বলে মনে করেছিল। সেই সময়ে ক্রেমলিন আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের প্রাথমিক পর্যায়ে আল কায়েদার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য ভাগ করে নিয়েছিল ও এমনকি লজিস্টিক সহায়তাও প্রদান করেছিল।
বহমান বন্ধুত্ব
শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ও চিন উভয়ই ইউরেশীয় অঞ্চল থেকে মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রস্থানকে তাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক স্বার্থের জন্য একটি বড় কৌশলগত বিজয় বলে মনে করে, যদিও এই দুই দেশ তালিবান প্রশাসন সম্পর্কে প্রায়শই পরস্পরবিরোধী মতামত পোষণ করেছে। পশ্চিম এশিয়াতেও একই ধারা পরিলক্ষিত হয়। পণ্ডিত ইউন সান সম্প্রতি বলেছেন যে, চিনের লক্ষ্য শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্থানচ্যুত করাই নয়, বরং নিজেকে প্রতিস্থাপন করাও। এবং রাশিয়ার স্বার্থ বেজিংয়ের সঙ্গে সমাপতিত হয়েছে।
বিশৃঙ্খল তত্ত্বের এই কৌটিল্য মাফিক সংস্করণের মাঝেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধিতে নিরাপত্তার হুমকি হিসাবে যে সব শক্তি মাথা চাড়া উঠেছে এবং টিকে থেকেছে, তারাই বর্তমানে আলোচনায় সমান সুযোগ, মত প্রকাশের মঞ্চ পেতে চলেছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.