মধ্য তেহরানে হামাসের পলিটব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়াহের হত্যাকাণ্ড গত কয়েক মাস ধরে গাজা যুদ্ধ-কেন্দ্রিক আলোচনার আখ্যানকে মৌলিক ভাবে পরিবর্তন করেছে। সংঘাতের অগ্রভাগে থাকা ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস গাজায় তাদের প্রথম সারির নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে নতুন প্রধান হিসাবে ঘোষণা করেছে।
ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ৭ অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য সিনওয়ার এখন মধ্যপ্রাচ্যের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ব্যক্তি। বর্তমানে গাজায় ইজরায়েলি সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু বাড়ছে। তার মধ্যেই সিনওয়ার এই ভৌগোলিক পরিসরে অবস্থিত গভীর সুড়ঙ্গগুলির ভিতরে রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে, যেগুলি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা এবং হামাস ও মিত্রদের বিমানপথে বোমা হামলা থেকে নিরাপদ রাখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। হানিয়াহের স্থলাভিষিক্ত সিনওয়ারের ক্ষমতায় আসা আঞ্চলিক ঝুঁকিমুক্তকরণের প্রচেষ্টা ও যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা… উভয়ের জন্যই দুঃসংবাদ। লেবাননের হিজবুল্লাহ ক্রমশই ইজরায়েলের সঙ্গে এমন সম্পর্কে পৌঁছচ্ছে যে, আরব রাষ্ট্র বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তাদের মধ্যে কোনো সমঝোতার চেষ্টা প্রায় অসম্ভব। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা আরো বেশি ধোঁয়াটে হয়ে পড়ছে।
লেবাননের হিজবুল্লাহ ক্রমশই ইজরায়েলের সঙ্গে এমন সম্পর্কে পৌঁছচ্ছে যে, আরব রাষ্ট্র বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তাদের মধ্যে কোনো সমঝোতার চেষ্টা প্রায় অসম্ভব।
হত্যার আগে পর্যন্ত হানিয়াহ হামাসের মধ্যে এমন একটি চক্রের অংশ ছিলেন, যা আল-কাসাম ব্রিগেডের অধীনে পরিচালিত গোষ্ঠীর জঙ্গি শাখা থেকে মূলত আলাদা ছিল। কোনো মতাদর্শগত পার্থক্য না থাকলেও রাজনৈতিক শাখাটি বিশেষ করে গত বছরের অক্টোবর থেকে মধ্যস্থতাকারী এবং ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মধ্যে একটি সেতুর ভূমিকা নিয়েছিল, গাজা এবং বন্দি ইজরায়েলিরা যাঁর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমনকি এই খবরও ছিল যে, আলোচনার শর্তাবলি নিয়ে সিনওয়ার এবং হামাস পলিটব্যুরোর মধ্যে মতপার্থক্য অব্যাহত থেকেছে। হানিয়াহ চাইছিলেন সিনওয়ার আর একটু নরম মনোভাব দেখান। অবশ্য ইজরায়েলের প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘন ঘন নিজের মত পরিবর্তন করেছেন। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, সিনওয়ার গাজায় জনপ্রিয়তা হারাতে চান না এবং নেতানিয়াহুর উপর আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও তাঁরা অচলাবস্থা ভাঙতে রাজি হননি।
হানিয়াহের স্থলাভিষিক্ত সিনওয়ার এখন নিজের চারপাশে একচেটিয়া ভাবে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করছেন। হামাসের নতুন রাজনৈতিক প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে মাত্র কয়েক দিন আগে পর্যন্তও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল এবং এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ দলের রাজনৈতিক দূতদের নাম উঠে এসেছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাক্তন নেতা খালেদ মাশাল বা কাতার-ভিত্তিক খলিল আল-হাইয়া, যিনি দৈনন্দিন ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সিনওয়ারের নিয়োগ কার্যকর ভাবে হামাসের আলোচনার প্রচেষ্টার জনদরদি মুখের অবসান ঘটাতে পারে। এ ক্ষেত্রে অনেকটা গত দশকের তালিবানের উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে গোষ্ঠীর মূলকেন্দ্রটি তাদের নিজস্ব কর্মকর্তাদের প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল, যাঁরা কাতারের রাজধানী দোহায় ও পশ্চিমীদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। গাজায় গোষ্ঠীটির মূল অংশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সশক্তিকরণের অনুরূপ গতিপথ লক্ষ করা গিয়েছে, যা কার্যকর ভাবে রাজনৈতিক ও সামরিক শাখাকে একত্রিত করেছে।
২০১১ সালে হামাসের সঙ্গে কুখ্যাত ‘শালিত চুক্তি’র অংশ হিসাবে সিনওয়ারকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল যেখানে ১০২৭ জন ফিলিস্তিনিকে বন্দি ইজরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিতের বিনিময়ে মুক্ত করা হয়েছিল।
সিনওয়ার ইজরায়েলি রাজনীতি এবং কৌশলগত চিন্তাভাবনার বিষয়ে ভাল ভাবে অবগত। তিনি ২৩ বছর ইজরায়েলি জেলে কাটিয়েছেন, দেশদ্রোহী বলে অভিযুক্ত ফিলিস্তিনিদের হত্যার দায়ে চার বার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। তাঁর কারাবাসের সময়, তিনি নিজে নিজেই হিব্রু শিখেছিলেন এবং ইজরায়েলি রাজনীতি ও কৌশলগত আখ্যান সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেছিলেন। ২০১১ সালে হামাসের সঙ্গে কুখ্যাত ‘শালিত চুক্তি’র অংশ হিসাবে সিনওয়ারকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল যেখানে ১০২৭ জন ফিলিস্তিনিকে বন্দি ইজরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিতের বিনিময়ে মুক্ত করা হয়। তার পর থেকে তাঁর আদর্শগত সংকল্প এবং ইজরায়েল সম্পর্কে গভীর জ্ঞান তাঁকে গোষ্ঠীটির নেতৃত্বের অগ্রভাগে স্থান করে দিয়েছে।
সিনওয়ারকে গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে নির্বাচনের সিদ্ধান্তে হামাসের রাজনৈতিক মহল আদৌ আপত্তি জানিয়েছিল কি না বা ইরানের মতো বহিরাগত পৃষ্ঠপোষকরা কোনও অভ্যন্তরীণ জটিলতাকে কাজে লাগিয়েছিল কি না… তা আজ অবধি অজানা। তেহরানের জন্য সিনওয়ারের নিয়োগ সুবিধাজনক। কারণ তা দ্বন্দ্বটিকে স্থবির করে দেবে। সর্বোপরি, রাশিয়া এবং চিন তাদের আঞ্চলিক মিত্র ইরানকে সমর্থন করায় এই অঞ্চলে বৃহৎ শক্তি প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি জটিল ধাঁধার জন্ম দিয়েছে। বেজিং এবং মস্কো উভয়েই হামাসের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের আতিথ্য দিয়েছে। পলিটব্যুরো এখন আকারে ছোট হয়ে গেলেও সিনওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধে কেবল ইরানের মাধ্যমে বা তাঁর পছন্দের কোনও মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমেই হতে পারে, যাঁকে রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এ দিকে ইজরায়েল সিনওয়ারকে নির্মূল করার জন্য নিজেদের সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেছে, যখন হামাস প্রধান বর্তমানে স্থবির আলোচনার অংশ হিসাবে নিজের জন্য একটি নিরাপদ নিষ্ক্রমণ পথের দাবি করেছেন বলে জানা গিয়েছে।
পলিটব্যুরো এখন আকারে ছোট হয়ে গেলেও সিনওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধে কেবল ইরানের মাধ্যমে বা তাঁর পছন্দের কোনও মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমেই হতে পারে, যাঁকে রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
অবশেষে এ কথা বলা যায়, হানিয়াহের হত্যাকাণ্ড সম্ভবত সময়োচিত নয়। কোনও দেশ বা সংস্থা আনুষ্ঠানিক ভাবে এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার না করলেও, মার্কিন সংবাদমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ইজরায়েল ব্যক্তিগত ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে নিজের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছে। ২০১৭ সালে হামাস কর্তৃক প্রকাশিত ইশতেহারের মতো নথিটি আজ পর্যন্ত গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সম্পর্কে সবচেয়ে বিশদ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। সেখানে এ কথা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, তাদের রাজনৈতিক গতিবিধি শুধুমাত্র প্রাথমিক কৌশলের পরিপূরক, যা সামরিক অভিযান দ্বারা পরিচালিত হয়। এই নথিতে বলা হয়েছে, ‘সমস্ত উপায় ও পদ্ধতি দিয়ে দখলকে প্রতিরোধ করা, ঐশ্বরিক আইন এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইন দ্বারা নিশ্চিত করা একটি বৈধ অধিকার। এই সবের কেন্দ্রে রয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধ।’ ২০১৭ সালের পর থেকে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে এবং আরও নির্দিষ্ট ভাবে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে তো বটেই।
অলরাউন্ড বা সর্বগুণসম্পন্ন নেতা হিসাবে সিনওয়ারের আরোহণ এখন মধ্যপ্রাচ্যকে ক্রমশ এক ধূসর বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ ইজরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গে ইরানের নিজস্ব চাপানউতোর গভীরতর হয়েছে এবং গাজায় সংঘাতের জন্য কোনও শাখাপথ বা অফ র্যাম্প আদতে মরীচিকাসম। নেতানিয়াহু এবং সিনওয়ারের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ প্রায় অসম্ভব হওয়ার দরুন বিদ্যমান আলোচনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতার দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে।
কবীর তানেজা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.