Image Source: Getty
পেরুর চিন-নির্মিত চাঙ্কায় বন্দরটিকে অনেকেই লাতিন আমেরিকার জন্য এক নতুন যুগের চিহ্ন বলে মনে করেন। কারণ বেজিং লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের মতোই প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বলয়ে থাকা দেশগুলিকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার নিরিখে এই চাঙ্কায় বন্দরটি আসলে চিনের বছরের পর বছর ধরে অনুসৃত ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের চূড়ান্ত পরিণতি। আর এই সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে। লাতিন আমেরিকাকে ক্রমাগত আকৃষ্ট করার চিনা প্রচেষ্টা অঞ্চলটি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সমাপতিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ ও অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করার জন্য ক্রমশ হুমকি দিয়ে চলেছে, যা নতুন অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার পরিসরকে সঙ্কুচিত করছে। তাই লাতিন আমেরিকায় নিজের অংশীদারিত্ব প্রসারিত করার জন্য চিনের ইচ্ছা স্বাভাবিক ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণে চিনের সদিচ্ছাকে এই অঞ্চলের সরকারগুলি এক স্বাগত সুযোগ হিসাবে দেখে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন-লাতিন আমেরিকা সম্পর্কের বিরক্তির কারণগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক কি না… তা দেখার বিষয়।
তাই লাতিন আমেরিকায় নিজের অংশীদারিত্ব প্রসারিত করার জন্য চিনের ইচ্ছা স্বাভাবিক ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণে চিনের সদিচ্ছাকে এই অঞ্চলের সরকারগুলি এক স্বাগত সুযোগ হিসাবে দেখে।
চাঙ্কায় বন্দরটি চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ। এই অঞ্চলে বিআরআই প্রকল্পের এক দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল ‘কোস্টা রিকার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তা; বলিভিয়া ও আর্জেন্টিনায় রেলপথ; ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে শিল্প পার্ক এবং একটি কন্টেনার বন্দর; ইকুয়েডরের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র; এবং চিন থেকে চিলি পর্যন্ত প্রসারিত প্রথম ট্রান্সওশিয়ানিক ফাইবার-অপটিক কেবল যা এশিয়াকে দক্ষিণ আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করবে।’ বর্তমানে লাতিন আমেরিকার ২২টি দেশ এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ বিআরআই-তে স্বাক্ষর করেছে এবং কলম্বিয়াও সেই তালিকায় নিজের নাম লেখাতে চলেছে। চাঙ্কায় সম্ভবত চিন দ্বারা রূপায়িত সফল বিআরআই প্রকল্পগুলির মধ্যে অন্যতম হতে পারে। কিন্তু এই বাস্তবতা রাজনৈতিক দুর্নীতি, শ্রম লঙ্ঘন, পরিবেশগত সমস্যা বা জনগণের প্রতিবাদের কারণে স্থবির হয়ে পড়া অন্য বিআরআই প্রকল্পগুলির বর্তমান পরিস্থিতিকে ঢেকে দিতে পারে না। তবে চাঙ্কায়ের জন্য চিনের অবশ্যই কৃতিত্ব প্রাপ্য।
চিন ইতিমধ্যে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে উঠেছে। সে ক্ষেত্রে চাঙ্কায় দক্ষিণ আমেরিকা ও চিনের বাণিজ্যকে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে। পেরুর মধ্যে ‘চাঙ্কায় থেকে সাংহাই’ প্রবাদটি এখন প্রায় সর্বজনবিদিত… যা লাতিন আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে চিনের অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলির মধ্যে বিশাল দূরত্বের সেতুবন্ধনসম। চাঙ্কায় বন্দরটি চিত্তাকর্ষকও বটে: লিমা থেকে ৮০ কিমি দূরে একটি শান্ত মাছ ধরার গ্রাম দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম বন্দরগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে। এর নেপথ্যে রয়েছে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে চিনের কসকো শিপিং দ্বারা ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘটনা। চাঙ্কায় বন্দরটি বার্ষিক ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ উপার্জন করবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং ৮০০০-এরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, যা পেরু ও চিনের মধ্যে বাণিজ্য খরচ ২০% হ্রাস করবে। পেরু থেকে চিনগামী প্রথম জাহাজটি আন্দিয়ান দেশ থেকে ফল নিয়ে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যাত্রা করেছে। সর্বোপরি চাঙ্কায় এমন একটি আধুনিক বন্দর, যা ৮.৫ তীব্রতা পর্যন্ত ভূমিকম্প সহ্য করতে সক্ষম এবং এটি প্রায় সম্পূর্ণ রূপে স্বয়ংক্রিয় বন্দর। এখানে কনটেনার স্থানান্তরের জন্য চালকবিহীন বৈদ্যুতিক যানবাহন, পণ্য ওঠা-নামা করানোর জন্য স্বয়ংক্রিয় ক্রেন, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য মুখাবয়ব শনাক্তকরণ ব্যবস্থা, পণ্যের চলাচলের উপর নজরদারি চালাতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সিস্টেম এবং বন্দর জুড়ে ৫জি ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয়। এই বন্দরব্যবস্থার অবকাঠামোর অধিকাংশই চিনের পরিকল্পিত, যেখানে বিওয়াইডি পিক-আপ ট্রাক এবং হুয়াইয়ের ৫জি টাওয়ার রয়েছে। এই বন্দরটি চিনের কসকো শিপিং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যে সংস্থটির এই প্রকল্পে ৬০% অংশীদারিত্ব রয়েছে এবং অবশিষ্ট ৪০% অংশীদারিত্ব রয়েছে ভলকান নামক পেরুর এক খনি সংস্থার কাছে।
বর্তমানে লাতিন আমেরিকার ২২টি দেশ এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ বিআরআই-তে স্বাক্ষর করেছে এবং কলম্বিয়াও সেই তালিকায় নিজের নাম লেখাতে চলেছে।
চাঙ্কায় এবং পেরু সকলের নজর কাড়লেও এই প্রকল্প নিয়ে চিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পেরুর সীমান্তেই সীমাবদ্ধ নয়। চাঙ্কায়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল লাতিন আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে এশিয়া পর্যন্ত সফরের ক্ষেত্রে একটি স্প্রিংবোর্ড হিসাবে কাজ করা, যা পেরু থেকে চিন পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রার ব্যাপ্তিকে ৩৫ থেকে ২৩ দিনে কমিয়ে আনে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই বন্দরটির দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। প্রথমটি স্বল্পমেয়াদি। এর আগে দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে জাহাজগুলি মেক্সিকোর মানজানিলা বন্দর বা ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচ হয়ে এশিয়ায় দিকে যাত্রা করত। এই দুটি বন্দরই এখন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে উদ্ভূত কম জাহাজ চলাচলের সাক্ষী থাকবে। দ্বিতীয় প্রভাবটি দীর্ঘমেয়াদি এবং এখনও অজানা। এটি আর একটি বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত, যার লক্ষ্য হল পেরুকে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করা, যাতে তারা প্রশান্ত মহাসাগরের মাধ্যমে এশিয়ায় সহজেই প্রবেশ করতে পারে। পেরুর চাঙ্কায় চেম্বার অফ কমার্সের পরিচালকের মতে, ‘মেগাপোর্টের উন্নয়নের জন্য চিনের প্রধান প্রেরণা ছিল প্রতিবেশী ব্রাজিল প্রবেশ করা, যেখানে সয়াবিন ও লোহা আকরিকের মতো ব্রাজিলীয় পণ্য রফতানি করার জন্য একটি নতুন রেললাইনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।’ ব্রাজিল ও পেরুর মধ্যে নতুন পরিকল্পিত রেললাইনের জন্য ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন এখনও বিশ বাঁও জলে। অনুরূপ ভাবে পেরুর পরিবহণমন্ত্রী রাউল পেরেজ রেয়েস উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর দেশের লক্ষ্য হল ‘লাতিন আমেরিকার সিঙ্গাপুর হয়ে ওঠা, যাতে এশিয়াগামী বন্দর কার্গোগুলি এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে। যখন ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা থেকে কেউ এশিয়ায় পৌঁছতে চাইবেন, তখন তাদের পেরুকেই প্রস্থানের বিন্দু হিসেবে ভাবা উচিত।’ সম্ভবত কিছু পণ্য এখন প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য লাতিন আমেরিকার বন্দর থেকে চাঙ্কায়তে যেতে পারে এবং তার পরে এই নতুন বাণিজ্য পথের মাধ্যমে এশিয়ার দিকে রওনা হতে পারে। আটলান্টিকের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল থেকে পেরুর চাঙ্কায় পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ব্রাজিল ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পেরুর উপকূলকে সড়কপথে সংযুক্তকারী ‘বাই-ওশিয়ানিক রেলওয়ে’ নামক পথটি এখনও এক সুদূর পরিকল্পনা।
হরি শেষশায়ী অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভিজিটিং ফেলো এবং কনসিলিয়াম গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.