সিরিয়ার নতুন ডি-ফ্যাক্টো নেতা হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) মিলিশিয়ার আহমেদ আল-শারা (তবে যুদ্ধের খাতিরে তাঁর নাম আবু মহম্মদ আল-জোলানি) এর আগে আল-কায়েদা ও তথাকথিত ইসলামপন্থী দেশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তিনি বলেছেন যে, দেশটি ‘যুদ্ধে ক্লান্ত’ এবং এখন সংঘাত থেকে দূরে সরে এসে একটি রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চায়। ১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যমান যুদ্ধের দরুন এই ক্লান্তির আর্তি ওয়াশিংটন ডিসি-তেও অনুরণিত হয়েছে, যেখানে ৯/১১ পরবর্তী নিরাপত্তাক্রমকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করা দু’দশক দীর্ঘ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে কেন্দ্র করে একই রকমের মনোভাব দেখা যাচ্ছে।
দামাস্কাসে বাশার আল-আসাদের রাজত্বের উৎখাত আসলে পূর্ববর্তী সরকারের কয়েক দশকের ভয়াবহ কার্যকলাপকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে।
যাই হোক, সিরিয়ার বর্তমান বাস্তবতা একটি নতুন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তনকেই দর্শায়। কারণ পূর্ববর্তী যুগটি মিশ্র ফলাফলের ইতিহাস-সমন্বিত এক অধ্যায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকেছে। দামাস্কাসে বাশার আল-আসাদের রাজত্বের উৎখাত আসলে পূর্ববর্তী সরকারের কয়েক দশকের ভয়াবহ কার্যকলাপকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। সিরিয়ার জনগণ যখন নেতৃত্বের এই পরিবর্তন উদ্যাপন করছেন, তখন দায়িত্বে থাকা বিদ্রোহীরা - যাঁরা নতুন বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে পুরনোকে প্রতিস্থাপন করেছেন - আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী একটি সম্পূর্ণ নতুন প্যান্ডোরার বাক্স উন্মোচন করেছেন।
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপরিকল্পিত সেনা প্রত্যাহার তালিবান ও তার চরমপন্থী মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে জায়গা করে দিয়েছে। বাইডেন প্রশাসন সেনা প্রত্যাহারের পরে কাবুলে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রভাব বহন করলেও কাতারে তালিবানের সঙ্গে তাঁর প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বাক্ষরিত চুক্তিটি এই প্রত্যাহারকে চালিত করে। এই চুক্তির নেপথ্যে ছিল ক্লান্তি সংক্রান্ত মার্কিন জনমত এবং ট্রাম্পের প্রভাবিত না হওয়ার ঘরানার রাজনীতি। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ প্রবাদটি ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে হঠকারিতার সঙ্গে পুনর্নির্মাণ করেছে।
সিরিয়ায় জোলানির জয় সতর্কতার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এমনকি ওয়াশিংটন ডিসি-তে সিরিয়ার দূতাবাসও নিজেদের পতাকা ‘বিপ্লবের’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছে। একগুচ্ছ দেশ ইতিমধ্যে জোলানি এবং তাঁর সিরিয়ান স্যালভেশন সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সংযোগ স্থাপন করেছে এবং ভারত-সহ অনেক দেশেই সিরিয়ার দূতাবাস কার্যকর রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরে অগ্রসর হয়েছে, যা এমন এক সিদ্ধান্ত, যাকে খাটো করে দেখা সম্ভব নয়। বিগত ২০ বছর ধরে জিহাদিদের সঙ্গে লড়াই করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন জিহাদি দ্বারা বিভিন্ন রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (ইউএই) মতো আরব রাজতন্ত্রগুলি - যারা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে মৌলবাদ ও মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো চরমপন্থী মতাদর্শের বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছে – সতর্কতার দাবি জানিয়ে এসেছে এবং অন্য দিকে তুর্কিয়ের গোয়েন্দা প্রধানের মতো ব্যক্তিরা বিদ্রোহীদের একাংশকে সমর্থন করেছেন এবং আসাদের বহিষ্কারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দামাস্কাসে পা রেখেছেন ও প্রতীকী উমাইয়া মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি অথবা আন্তর্জাতিক স্তরে সেই শক্তি প্রয়োগ করার মার্কিন অভিপ্রায় এখনও পর্যন্ত আর্থিক ভাবে বা সম্পদগত ও সামরিক শক্তির দিকে থেকে অবনমনমুখী নয়।
এই দ্রুত পরিবর্তনগুলি মার্কিন শক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে সংশ্লিষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি অথবা আন্তর্জাতিক স্তরে সেই শক্তি প্রয়োগ করার মার্কিন অভিপ্রায় এখনও পর্যন্ত আর্থিক ভাবে বা সম্পদগত ও সামরিক শক্তির দিকে থেকে অবনমনমুখী নয়। যা বদলেছে তা হল, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বাস্তবতা। একটি বৃহৎ শক্তি প্রতিযোগিতার পুনরুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভূ-রাজনীতিও পরিবর্তিত হয়েছে, যা বিদ্যমান একাধিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই মুখ্য চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালে বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও এক দশক সময় ধরে আটকে রাখার চেয়ে এই প্রতিযোগিতায় চিন বা রাশিয়ার কাছে আর কোনও কিছুই বেশি লোভনীয় হবে না।’
জোলানির মতো কেউ যদি সিরিয়া থেকে ইরান ও রাশিয়াকে উৎখাত করতে সাহায্য করতে পারেন – তাঁর বিবৃতি অনুযায়ী যেমনটা তিনি করতেও চান – তবে তা স্বল্পমেয়াদে পশ্চিমীদের জন্য ইতিবাচকই হবে। সিরিয়ার উপকূলে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের মাত্র দুটি সামরিক ঘাঁটি থেকে রাশিয়ার সম্ভাব্য প্রত্যাহারকে স্বাগত জানানো হবে। সিরিয়ায় তার বহুস্তরীয় হস্তক্ষেপের ব্যর্থতায় ইরানের বিস্ময় এই অঞ্চলে দেশটির ভূমিকা এবং তার রাজনীতি ও অর্থনীতির বাস্তবতা সম্পর্কে অনেক অভ্যন্তরীণ বাগ্বিতণ্ডার জন্ম দিয়েছে। সিরিয়ায় আসাদের বিকল্প যদি সে দেশ থেকে রাশিয়া ও ইরান উভয়কেই উৎখাত করতে পারে, তা হলে ইউরোপে সম্ভাব্য শরণার্থী আগমনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে (যা পূর্বে মহাদেশের রাজনীতিকে দক্ষিণপন্থীদের প্রতি পুনর্বিন্যাসের দিকে চালিত করেছিল) এবং তিনি যদি আদর্শগত ভাবে মধ্যমপন্থার স্থিতিশীলতা বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হন, তা হলে অন্তত পক্ষে স্বল্পমেয়াদে গণতান্ত্রিক হোক বা স্বৈরাচারী… এই বিকল্পটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্বাগত হবে। এর অর্থ হল, অতীত থেকে এক সমস্যাযুক্ত দ্বিধাবিভক্তির প্রত্যাবর্তন ঘটবে, যা ‘ভাল’ এবং ‘খারাপ’ সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে পার্থক্য করার কাজটিকে কঠিন করে তুলবে।
আফগানিস্তানে অনেকেই ‘তালিবান ২.০’কে আদর্শ বলে মনে করছেন এবং তাদের স্বাগত জানাচ্ছেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার দুই দশকের দীর্ঘ যুদ্ধ থেকে সরে এসে দেওবন্দি গোষ্ঠীটিকে দেখার এক বাস্তবসম্মত আঙ্গিক। এ হেন সাদৃশ্যগুলি কেবল অস্বাভাবিকই নয়, বরং এক ধরনের নীলনকশা তুলে ধরে - এক স্থিতাবস্থার সমীকরণ - যেখানে জিহাদি গোষ্ঠী ও তাদের নেতৃবৃন্দকে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক নিশ্চয়তার বিনিময়ের দায়িত্ব তাদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। জোলানি ও তালিবানের শক্তিশালী অন্তর্বর্তীকালীন অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি… দু’জনের মাথার উপর আজ অবধি ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থপ্রদানের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থপ্রদান সংক্রান্ত নথিতে বলা হয়েছে, যে কোনও ব্যক্তিই এই পুরস্কারের যোগ্য, যিনি এই দুই ব্যক্তির অবস্থান বা তাঁদের সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, জোলানি ও হাক্কানি উভয়ই প্রতিদিন টেলিভিশনে উপস্থিত হন এবং সেই সকল রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা করেন, যাঁরা নাগরিক সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
সিরিয়ায় তার বহুস্তরীয় হস্তক্ষেপের ব্যর্থতায় ইরানের বিস্ময় এই অঞ্চলে দেশটির ভূমিকা এবং তার রাজনীতি ও অর্থনীতির বাস্তবতা সম্পর্কে অনেক অভ্যন্তরীণ বাগ্বিতণ্ডার জন্ম দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় আইএসআইএস-বিরোধী অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গত এক দশকের কোনও এক সময়ে, সিরিয়ার এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অনেকেই তাদের মতপার্থক্যকে দূরে রেখে আইএসআইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিত্র হয়েছিল। এমনকি আফগানিস্তানে আফগানিস্তান-পাকিস্তান অঞ্চলে দায়েশের ক্রমবর্ধমান শাখা ইসলামিক স্টেট খোরাসান-এর (বা আইএসআইএস-কে) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তালিবানকে ক্রমশ সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে। তালিবানরা প্রথম কয়েক মাস ঐক্যের পরিচয় দেওয়ার পর অভ্যন্তরীণ ভাবে তাদের দলগুলির মধ্যে ক্ষমতার ক্রমে দ্বন্দ্বে ভুগছে। একটি নিরাপদ সরকারি ভবনের অভ্যন্তরে সিরাজুদ্দিনের কাকা ও হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন হাক্কানির ভাই খলিল হাক্কানির সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্র পরিচালনায় উদ্যত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির ধোঁয়াশাকেই দর্শায়।
২০১৯ সালে ট্রাম্পের প্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচিব জিম ম্যাটিস একটি প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ করে বলেছিলেন, যে কোনও যুদ্ধ আদৌ শেষ হয়েছে কি না, তা নির্ণয় করার জন্য শত্রুরাও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায়। ২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তালিবানরা সেই ক্ষমতাই প্রয়োগ করেছিল, যতক্ষণ না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। জোলানির অধীনে সিরিয়ার আখ্যানটি নিতান্তই আনকোরা, অত্যন্ত আশাবাদী এবং দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য জনগণের বর্তমান ও বিদ্যমান স্বস্তির অনুভূতির সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। যাই হোক, এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির লড়াই হতে পারে, যা সিরিয়ার ভবিষ্যৎকে আরও এক বার আকার দিতে পারে।
কবীর তানেজা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর এবং ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.