Author : Arun Krishnan

Published on Dec 14, 2021 Updated 0 Hours ago

১৯৯১ সালের সংস্কার ছিল সংহত ও অনেকটা ক্ষেত্রব্যাপী সংস্কার, আর তার ব্যাপ্তি ছিল অর্থনীতির এক বিরাট অংশ জুড়ে। তবে সামগ্রিক ভাবে সেই সময়কার রাজনৈতিক অর্থনীতি এই প্রয়াসটিকে অনেকখানি বাধার সম্মুখীন করেছিল।

ভবিষ্যৎকে বরণ

নিবন্ধটি একটি সিরিজের অংশ যার নাম — ‘৩০ বছর পরে: সংস্কার কর্মসূচির পর্যালােচনা ও পুনর্নবীকরণ’


ভূমিকা

ওআরএফ-এর সনদ হল ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সংক্রান্ত। ১৯৯১ সালে এর প্রথম প্রকাশনার নাম ছিল ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি: যৌথ বিবৃতি’। এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা। ছিলেন পি এন ধর, এম নরসিংহম, আই জি পটেল এবং আর এন মালহােত্র। তাঁদের প্রত্যেকের ছিল নিজ নিজ ক্ষেত্রে অগাধ প্রজ্ঞা, আর ছিল আমাদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নানা বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার জটিলতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা। সাধারণ ভাবে যাকে রাজনৈতিক অর্থনীতি বলা হয়, তার সীমা সম্পর্কে তাঁরা অবহিত ছিলেন।

আমাদের গত ৩০ বছরের যাত্রা কী ভাবে সম্পন্ন হয়েছে সেই সংক্রান্ত একগুচ্ছ নিবন্ধের ভূমিকা লিখতে পেরে আমি গর্ববােধ করছি। যাঁরা এই নিবন্ধগুলি লিখেছেন, তাঁরাও একই রকম ভাবে আমাদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলি সম্পর্কে অবহিত, এবং এঁদের অনেকেই গত তিনটি দশকে আমাদের অগ্রগতি ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখেছেন। এঁদের প্রত্যেকেই যে সমস্ত পরিবর্তন ঘটেছে তার বিভিন্ন দিক নিয়ে, এবং সেই সঙ্গে আমরা যে সব পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছি তার উপর, মতামত দিয়েছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তাঁরা ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন।

১৯৯১ সালের ব্যালান্স অফ পেমেন্টস ক্রাইসিস (আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থ আদান-প্রদানের ভারসাম্যজনিত সঙ্কট) ছিল বিভিন্ন সময়ে আর্থিক অমিতব্যয়িতা সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যবস্থা নানেওয়ার প্রবণতার কারণে আশির দশক থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া নানা চ্যালেঞ্জের নিট ফল।

কোনও সন্দেহ নেই ১৯৯১ সালের ব্যালান্স অফ পেমেন্টস ক্রাইসিস (আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থ প্রদানের ভারসাম্যজনিত সঙ্কট) কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। তা ছিল বিভিন্ন সময়ে আর্থিক অমিতব্যয়িতা সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যবস্থা না-নেওয়ার প্রবণতার কারণে আশির দশক থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া নানা

চ্যালেঞ্জের নিট ফল। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে টাকা ব্যবহার করা সংক্রান্ত নানা চুক্তি, এবং তার পাশাপাশি কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার ভিত্তিতে চলা বিভিন্ন অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, আমাদের এক ধরনের নিরাপত্তা এবং কখনও কখনও সম্পদও এনে দিয়েছিল। বহু সময় বিভিন্ন বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে আশু সমস্যাগুলাের মােকাবিলা করত ভারত। আর্থিক ক্ষেত্রেই হােক, বা আরও গুরুত্বপূর্ণ কাঠামােগত সংস্কারের প্রশ্নেই হােক, আমরা ক্রমাগত সুসংহত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিকে পিছিয়ে দিচ্ছিলাম। অথচ ততদিনে চিন এবং এশিয়ার আরও অনেক দেশ সেই কাজ শুরু করে দিয়েছিল। সেই যে বলে না তােমার যা সংস্থান তার থেকে বেশি ব্যয় করে তুমি সারাটা জীবন কাটাতে পারবে না, সেই কথাটাই ১৯৯১ সালে আমাদের মারাত্মক ভাবে তাড়া করতে শুরু করল।

এর অবয়ব স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল ১৯৮৯ সালে। এবং সেটা ঘটেছিল আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) একটা সেফটি নেট প্রােগ্রাম বা নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি নেওয়ার জন্য আমাদের বার বার সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও। তখন ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল আসন্ন নির্বাচন পর্যন্ত। ইতিহাস অবশ্য অনেক সময়ই আর একটা সুযােগ দেয় না।

সেই যে বলে না তােমার যা সংস্থান তার থেকে বেশি ব্যয় করে তুমি সারাটা জীবন কাটাতে পারবে না, সেই কথাটাই ১৯৯১ সালে আমাদের মারাত্মক ভাবে তাড়া করতে শুরু করল।

১৯৮৯ ও ১৯৯১ সালের মধ্যে চন্দ্র শেখরের নেতৃত্বাধীন সরকার বেশ কিছু সুদৃঢ় ব্যবস্থা নিয়েছিল, যার মধ্যে ছিল ঋণ পরিশােধে ব্যর্থতা ঠেকাতে সােনা বন্ধক দেওয়া। বার বার সরকার বদলে যাওয়ায় অস্থিরতা বেড়ে চলেছিল। শুধু রাজনৈতিক প্রয়ােজনের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রবণতা ধীরে ধীরে আকর্ষণ হারাচ্ছিল। ঋণ ও আর্থিক অমিতব্যয়িতা এমন একটা পর্যায়ে পৌছে গেছিল যা আর বহন করা যাচ্ছিল না। এবার তা কমানাের জন্য প্রয়াস শুরু হল।

১৯৯১ সালের সংস্কার এবং তার তাৎপর্য

সে সব এখন ইতিহাস। ১৯৯১ সালের সংস্কার ছিল সংহত ও অনেকটা ক্ষেত্রব্যাপী সংস্কার, আর তার ব্যাপ্তি ছিল অর্থনীতির এক বিরাট অংশ জুড়ে। তবে সামগ্রিক ভাবে সেই সময়কার রাজনৈতিক অর্থনীতি এই প্রয়াসটিকে অনেকখানি বাধার সম্মুখীন করেছিল। এই বিষয়টির উপরে এ কে ভট্টাচার্য তাঁর নিবন্ধে আলােকপাত করেছেন। যে বিষয়টি রাজনৈতিক অর্থনীতি ও তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতি মােটেই অনুধাবন করতে পারেনি তা হল এই সঙ্কট অদ্ভুত ভাবে আমাদের সামনে বিভিন্ন সুযােগ তৈরি করে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে বাণিজ্যনীতি, শিল্পে লাইসেন্স দেওয়া, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের উন্নতি, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়ােগের রাস্তা খানিকটা খুলে দেওয়া এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামােগুলির আরও নানা ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অবশ্যই সামগ্রিক, আর্থিক এবং দূরপ্রসারী কাঠামােগত সংস্কার শুরু করা হয়েছিল।

গৌতম চিকারমানে তাঁর দুটি নিবন্ধে দেখিয়েছেন দুটি প্রশ্নে — কতটা সংস্কার করা উচিত এবং দৃঢ় ভাবে বিশ্বাসের পথে বাধা — আমাদের মানসিক বােঝা কী ভাবে সংস্কার কর্মসূচিতে আস্থা রাখার ক্ষেত্রে অন্তরায়

হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যা আমাদের পেছনে টেনে ধরছিল তা হল বেসরকারি পুঁজি সম্পর্কে আমাদের সংশয়, আর সরকারি খরচ বাড়িয়ে আরও বেশি অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার অর্জন করা সম্ভব বলে আমাদের বিশ্বাস।

তবে ব্যাঙ্কগুলিকে পুরাে স্বাধীনতা দেওয়া অথবা আর্থিক সংস্থাগুলির প্রগতিশীল বেসরকারিকরণের অনুমতি দেওয়ার মতাে বিষয়গুলি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছিল। ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের প্রশ্নটি তাে ঐতিহাসিক ভাবেই ছিল একটা অত্যন্ত অপছন্দের বিষয়।

একই ভাবে আর্থিক ক্ষেত্রের সংস্কারের প্রশ্নে কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল তা মনিকা হালান তাঁর নিবন্ধে তুলে ধরেছেন। নরসিংহম কমিটির রিপাের্টের সুপারিশগুলি ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল। সেগুলি ছিল অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলিতে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং প্রশাসনিক ভাবে নির্ধারিত সুদের হার থেকে মুক্ত করার জন্য ব্যাঙ্ককে অনেক বেশি স্বাধীনতা দেওয়া সংক্রান্ত। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বাের্ড অফ ইন্ডিয়াকে একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে তৈরি করাটাও ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। তবে ব্যাঙ্কগুলিকে পুরাে স্বাধীনতা দেওয়া অথবা আর্থিক সংস্থাগুলির প্রগতিশীল বেসরকারিকরণের অনুমতি দেওয়ার মতাে বিষয়গুলি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছিল। ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের প্রশ্নটি তাে ঐতিহাসিক ভাবেই ছিল একটা অত্যন্ত অপছন্দের বিষয়।

হর্ষ পন্থ এই সিরিজের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধে সংস্কার কর্মসূচি এবং বৈদেশিক নীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করেছেন। কোনও সন্দেহ নেই বিরাট শক্তিশালী সােভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া ও রাশিয়ার বেড়ে চলা অর্থনৈতিক সমস্যা, আর সেই সঙ্গে কুয়েত-ইরাক যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল আমাদের রফতানি এবং আমাদের সামনে কী কী বিকল্প আছে তার উপর। একই ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের সঙ্গে আমাদের বেড়ে চলা ঘনিষ্ঠতাও (যার ভিত্তি ছিল এই সংস্কার প্রক্রিয়া যা ভারতীয় অর্থনীতিতে মুক্ত করছিল) ছিল বৈদেশিক ও অর্থনৈতিক নীতির পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফল।

ক্রেতাদের সামনে এখন যে বিশাল বিকল্প রয়েছে ১৯৯১ সালে ছবিটা ছিল তার একদম বিপরীত। যে পরিবর্তন হয়েছে এবং যে আলাপ-আলােচনার পরিসর তৈরি হয়েছে তা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতাে।

সব মিলিয়ে এটা খুব স্পষ্ট যে ৩০ বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রাপ্তি এখন আমাদের সামনে নানা ভাবে প্রতিভাত। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কমে গিয়েছে। ২০২০ সালের একটি ইউএনডিপি রিপাের্ট দেখিয়েছে যে ২০০৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এক দশকে রেকর্ড তৈরি করে ২৭ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে চলে এসেছেন। এই সময়ে আমরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিধি বিস্তৃত করেছি, ক্রেতাদের সামনে বিকল্প বাড়িয়েছি, এবং ছােট ব্যবসা ও নতুন চিন্তাপ্রসূত

উদ্যোগের ক্ষেত্রে একটা নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে পেরেছি। সেই সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে পরিষেবা ক্ষেত্র একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিতে পেরেছে। ক্রেতাদের সামনে এখন যে বিশাল বিকল্প রয়েছে ১৯৯১ সালে ছবিটা ছিল তার একদম বিপরীত। যে পরিবর্তন হয়েছে এবং যে আলাপ-আলােচনার পরিসর তৈরি হয়েছে তা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতাে।

রাজ কৃষ্ণ আমাদের অতীতের বৃদ্ধির হার প্রসঙ্গে কটাক্ষমূলক শব্দচয়ন করে সেটিকে হিন্দু রেট অফ গ্রোথ বা বৃদ্ধির হিন্দু হার’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। যে দেশ সেই পরিধির মধ্যে আটকে ছিল তার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনগুলাে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যদি আমরা এই বৃদ্ধির হিন্দু হারের মতাে নিচু স্তরের ভারসাম্য ভেঙে বেরিয়ে এসে থাকতে পারি, তা হলে আজকের চ্যালেঞ্জগুলাে একদম ভিন্ন রকমের। এখন আমাদের প্রয়ােজন দুই সংখ্যার বৃদ্ধির হার, যা দারিদ্র্যকে অনেকখানি নির্মূল করতে পারে, জীবনের মান এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামাের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতিসাধন করতে পারে, নতুন চিন্তাপ্রসূত উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে পারে, প্রযুক্তিগত লাভের ফসল তুলতে পারে এবং মুক্ত নীতির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

এই প্রকাশনায় অনেকগুলি নিবন্ধে এই জিনিসগুলির রেখাচিত্র আঁকা হয়েছে। তার মধ্যে আছে পূজা মেহরার ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে ১৯৯১-এর সংস্কার প্রসঙ্গে চিন্তাভাবনা এবং মিহির শর্মার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রয়ােজনীয় সংস্কার বিষয়ক নিবন্ধ।

আগামী দিনের সংস্কারের সাফল্যের জন্য যা প্রয়ােজন

এই নতুন এবং প্রায় কল্পনাতীত বৃদ্ধির হার অর্জন করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেকগুলি ব্যবস্থা নিতে হবে, যেমন:

প্রথমত, আমাদের ক্রমাগত এই বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে যে অবশ্যম্ভাবী পরিকাঠামােগত সংস্কার ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থায়িত্বের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে যে ঋণ ও আর্থিক ঘাটতির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সব সময়ই অগ্রাধিকার হিসেবে থাকবে, এমনকী বিশ্বজনীন সমস্যা বা অতিমারির মতাে বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিতেও। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে অবশ্য এটা সৌভাগ্যের কথা যে বর্তমান নেতৃত্ব এই বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক অবহিত যে সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব, বিশেষ করে ঋণ ও আর্থিক ঘাটতির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, সব সময়ই মূল বাঁধন হিসেবে কাজ করবে।

আমাদের বুঝতে হবে যে ঋণ ও আর্থিক ঘাটতির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সবসময়ই অগ্রাধিকার হিসেবে থাকবে, এমনকী বিশ্বজনীন সমস্যা বা অতিমারির মতাে বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিতেও।

এর সঙ্গে আমাদের সারাক্ষণ আর্থিক ক্ষেত্রের সংস্কারের জটিলতা এবং ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইব্যুনালের কাজের মানের উন্নতি ঘটিয়ে দ্রুত ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার পথ প্রশস্ত করার মতাে বিষয়গুলির দিকে নজর দিতে হবে। এখনকার পাইলট পরীক্ষামূলক ব্যবস্থাগুলি থেকে বেরিয়ে এসে খতিয়ে দেখতে হবে যে ব্যাঙ্কের মালিকানা রাষ্ট্রের বহন করে চলা কতটা যুক্তিসঙ্গত, আর সেটাই হবে

ইতিহাসের বােঝা বহনের সমাপ্তি ঘটানাের একটা দিক। বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা ফরমাল সেক্টর এবং অনিয়ন্ত্রিত বা ইনফরমাল সেক্টর, উভয় ক্ষেত্রেই লাভজনক অর্থনৈতিক কাজকর্মের প্রসার ঘটানাে এবং কম সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। আর সকলের জন্য ঋণদানকারী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যাঙ্কিং ও বিমা ক্ষেত্রের একটি অপরিহার্য ভূমিকা আছে।

দ্বিতীয়ত, দীর্ঘকাল ধরে বৃদ্ধির উচ্চহার বজায় রাখতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলি এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয় একটা অপরিহার্য বিষয়। মুদ্রাস্ফীতির মাত্রার সংসদের বেঁধে দেওয়া সীমা অনুযায়ী কাজ করা, বৃদ্ধির হার আরও বাড়ানাে ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে টাকার জোগানের ব্যবস্থা করার জন্য একটি নমনীয় নীতি তৈরি করা প্রয়ােজন, আর এই সব প্রশ্নে আরবিআই-এর ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।

তৃতীয়ত, সরকারি নিয়ম বিধি মেনে প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কার। লক্ষ্য করার মতাে বিষয় হল সরকারের স্থায়ী সিভিল সার্ভিস-এর যে কাঠামাে রয়েছে তা কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই ধরনের প্রয়ােজন মেটায়। একদিকে তা যেমন উৎকর্ষ ও সকলের প্রয়ােজন মেটানাের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে, অন্যদিকে তা স্থায়িত্বের স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। এই স্থায়ী সিভিল সার্ভিস-এর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন নানা রাজ্য সরকারের স্থায়িত্বের সঙ্কট তৈরি হয়। ক্যাবিনেট অফিসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কাজকর্মের যে মূলগত ভূমিকা রয়েছে, তা স্থায়িত্ব এবং ধারাবাহিকতার একটি স্তম্ভ। মন্ত্রকগুলির, পুরাে ব্যবস্থার এবং প্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্গঠন এবং একটি নতুন শাসনের স্থাপত্য তৈরির প্রয়াস ক্রমাগত আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে।

স্থায়ী সিভিল সার্ভিস-এর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন নানা রাজ্য সরকারের স্থায়িত্বের সঙ্কট তৈরি হয়।

এখন মামলা-মােকদ্দমার প্রক্রিয়া ও বিবাদ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যে অগােছালাে ব্যবস্থা রয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় বিচারবিভাগীয় সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাচ্ছন্দ বাড়ানাের ক্ষেত্রে প্রয়ােজন একটা সন্নিবদ্ধ মনােভাবের, যা মামলা-নির্ভর মনােভাবের বিপরীত (এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে এখনও সরকার হল অন্যতম প্রধান মামলাকারী)। আমাদের প্রয়ােজন আইন প্রণয়নের প্রতিষ্ঠান এবং বিচার বিভাগীয় কাজকর্মের মধ্যে আরও অনেক বেশি সমন্বয়।

চতুর্থত, আমাদের আকাঙক্ষার তুলনায় সামাজিক পরিকাঠামাে এখনও পেছনে পড়ে রয়েছে। আমাদের নতুন শিক্ষানীতি, যা শিক্ষাদানের পদ্ধতির ক্ষেত্রে নতুনত্ব নিয়ে এসেছে, তার সুসংহত রূপায়ণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিকল্প ও পছন্দের ক্ষেত্র বিস্তৃত করা, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােকে আরও স্বাধিকার দেওয়া, এবং উচ্চমানের বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও সুযােগ তৈরি করে দিয়ে তাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার ফলে যােগ্যতা, কাজের নানা বিকল্প এবং আরও অনেক সুযােগ অকল্পনীয় ভাবে বাড়বে।

পঞ্চমত, বর্তমান অতিমারি নাটকীয় ভাবে সামনে নিয়ে এসেছে স্বাস্থ্যগত পরিকাঠামােকে ক্রমাগত অবহেলা করার বিষয়টি। এর জন্য প্রয়ােজন নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া। এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে

সরকারি খরচ — যা এখন মােট আভ্যন্তর উৎপাদনের এক থেকে তিন শতাংশের কাছাকাছি জায়গায় আটকে রয়েছে — তা বাড়ানাে ছাড়াও প্রয়ােজন মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার মতাে সংস্থাগুলির কাঠামােগত পরিবর্তন। সম্পর্কিত ক্ষেত্রগুলিতে মেধা বাড়ানাের প্রয়াস প্রয়ােজন, যার মধ্যে থাকবে। ডিপ্লোমেট অফ ন্যাশনাল বাের্ড (ডিএনবি)-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া, তৃণমূল স্তরে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিসহ সার্বিক স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি, এখনকার এবং ভবিষ্যতের অতিমারি সম্পর্কে দেশকে তৈরি করা, এবং তৃতীয় স্তরের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ।

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সরকারি খরচ — যা এখন মােট আভ্যন্তর উৎপাদনের এক থেকে তিন শতাংশের কাছাকাছি জায়গায় আটকে রয়েছে — তা বাড়ানাে ছাড়াও প্রয়ােজন মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার মতাে সংস্থাগুলির কাঠামােগত পরিবর্তন।

ষষ্ঠত, বৈদেশিক বাণিজ্য যাতে বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে তার জন্য শুল্ক এবং অন্যান্য (tariff and non-tariff) বাধা সংক্রান্ত আমাদের মানসিক বাধা পেরনাে প্রয়ােজন। এর ফলে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনীতির সামগ্রিক যােগ্যতামান বেড়ে যাবে। পৃথিবীতে কেউ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে সমৃদ্ধ হতে পারে না। যারা বাকি পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে এবং অর্থপূর্ণ ভাবে কাজ করতে পারে, আর সেই সঙ্গে দেশের মধ্যে কাজের সুযােগ বাড়াতে পারে এবং তাদের নিজস্ব। প্রতিভার সন্ধান করতে পারে, তারাই দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে সম্পদশালী হয়ে উঠতে পারে। আত্মনির্ভর ভারত তৈরির সঙ্গে আরও বেশি প্রতিযােগিতামূলক বাণিজ্যিক বাস্তুতন্ত্র গড়ে তােলার বিষয়টি সঙ্গতিপূর্ণ।

সপ্তমত, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে আসতে হবে। এর অর্থ হল ডিজিটাল প্রযুক্তিকে নানা ভাবে ব্যবহার করতে হবে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুযােগ-সুবিধা সরাসরি হস্তান্তরিত করার প্রকল্পগুলির রূপায়ণের ক্ষেত্রে নজরদারি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, এবং শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কৃত্রিম ও যন্ত্রসংক্রান্ত । শিক্ষাকে মূলস্রোতের মধ্যে নিয়ে আসা, এসবই 5G পৃথিবীতে দ্রুত উন্নীত হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে। আর এটাই অপরিহার্য ভাবে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিচালনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।

অষ্টমত, কৃষিক্ষেত্রে অনেকগুলি বিষয় রয়েছে যার সংস্কার প্রয়ােজন। কৃষিক্ষেত্রে আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রাটি আমাদের কৃষিক্ষেত্রের বাধাপ্রাপ্ত সংস্কার প্রক্রিয়ায় গতি আনবে এবং কৃষিক্ষেত্রে আরও প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে। এর ফলে জলের সঙ্কট মােকাবিলার মতাে চ্যালেঞ্জ এবং কম শক্তিনিবিড় ও দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে এমন ক্ষেত্রে বিনিয়ােগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে আমাদের কৃষিকাজের ধরনধারণ বদলে ফেলা যাবে, এবং তার পাশাপাশি কৃষি এবং কৃষি-সম্পর্কিত ক্ষেত্রে নতুন কাজের সম্ভাবনা তৈরি হবে।

কৃষিক্ষেত্রে আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রাটি আমাদের কৃষিক্ষেত্রের বাধাপ্রাপ্ত সংস্কার প্রক্রিয়ায় গতি আনবে এবং কৃষিক্ষেত্রে আরও প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে।

নবম বিষয়টি হল নতুন অর্থনীতির ক্ষেত্রটি। শক্তির ক্ষেত্রে আমাদের প্রগতিশীল ভাবে এমন একটা বৃদ্ধির পথ তৈরি করতে হবে যা বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন এবং পরিবেশের পরিবর্তনের মােকাবিলার প্রয়ােজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পুনর্নবীকরণযােগ্য শক্তির নানা নতুন নতুন প্রকরণকে তুলে ধরার জন্য প্রয়ােজন নতুন এবং নতুন চিন্তাপ্রসূত নানা অর্থনৈতিক কাজকর্ম, এই সময়ের নতুন মন্ত্র হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে আমরা যখন কয়লার ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসব, তখন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নতুন আগ্রহসৃষ্টি এবং উৎসাহ দানের জন্য অনেক বেশি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের প্রয়ােজন পড়বে। তা দিয়ে আমরা একদিকে যেমন সৌর, বায়ু, ও সবুজ হাইড্রোজেন শক্তি তৈরির দিকে এগােতে পারব, তেমনই ব্যাটারি তৈরি করার প্রয়ােজনীয় গবেষণার জন্য টাকা-পয়সার জোগান দেওয়া যাবে।

দশম, এখন অবধি আইন প্রণয়ন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে বিতর্কের মতাে বিষয়গুলি বাদে আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক কৌশলের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে সংযুক্ত করা হয়নি। সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলি পুনর্গঠিত করা, বিতর্কের পরিবর্তিত ক্ষেত্র তৈরি করা, এবং রাজ্য ও কেন্দ্রের আইন পরিষদগুলােকে আরও বেশি সংযুক্ত করার জন্য সংসদীয় সংস্কারের প্রয়ােজন রয়েছে। তা ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির স্বাধীন কাজকর্মের পরিণতি এই হয় যে মন্ত্রক বা সংসদের পর্যালােচনা তারা এড়িয়ে যায়।

শেষ কথাটি হল সরকারের সাম্প্রতিক বাজেটে মনােভাবের পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের বােঝা পেছনে ফেলে এমন একটা পৃথিবীতে পৌঁছনাের চেষ্টা শুরু হয়েছে যেখানে সরকারি খরচের লক্ষ্য হবে সরকারি কাজের সর্বাধিক ফল পাওয়া। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলির উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা একটা বিরাট পরিবর্তনের সূচক।

সরকারের সাম্প্রতিক বাজেটে মনােভাবের পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের বােঝা পেছনে ফেলে এমন একটা পৃথিবীতে পৌঁছনাের চেষ্টা শুরু হয়েছে যেখানে সরকারি খরচের লক্ষ্য হবে সরকারি কাজের সর্বাধিক ফল পাওয়া।

একই ভাবে, বৃদ্ধির প্রশ্নে যা কেন্দ্রীয় স্থানে থাকে তা হল একটা নতুন যুক্তরাষ্ট্রীয় মডেল, যার লক্ষ্য হবে দেশের রাজ্যগুলির আর্থিক ভ্রাতৃত্ব, যেখানে আরও উন্নত বােঝাপড়ার ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজ্যগুলিই সমৃদ্ধি। বাড়ানাের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেবে। যে হেতু ভবিষ্যতে রাজ্যের সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে এবং আঞ্চলিক দলের সংখ্যাও বাড়তে পারে, তাই এখনকার এবং ভবিষ্যতের মাের্চাগুলাের সঙ্গে একটা অর্থপূর্ণ যােগাযােগের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য প্রয়ােজন একটা স্থায়ী পরামর্শ-ব্যবস্থা, যা রাজ্যগুলির বিশ্বাসভাজন হবে এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রের এখনকার ও আগামী দিনের অর্থনৈতিক সংস্কারের সহায়ক হবে।

আমাদের প্রয়ােজন নানা দিক থেকে আমাদের সংবিধানের মৌলিক পুনর্মূল্যায়ন, যেমন সংবিধানের ৭ম তফসিল, যা মূল ধারণার থেকে ধীরে ধীরে সরে এসেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, তা নতুন করে লেখা। বিংশ শতাব্দীর প্রতিষ্ঠানগুলােকে দিয়ে তাে আর একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জের মােকাবিলা করা সম্ভব নয়।

আমরা এখন কী করছি তার উপরেই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।” — মহাত্মা গান্ধী

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.