গত কয়েকটি বছর বৈশ্বিক উন্নয়নের বাধ্যবাধকতাকে একটি সংজ্ঞায়িত বিন্দুতে নিয়ে এসেছে। এর কারণ চিন–মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ, কোভিড–১৯ অতিমারি, অনিশ্চিত ও অসম অতিমারি–উত্তর পুনরুদ্ধার, ইউক্রেন সংকট এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমশ খারাপ হতে থাকা ফলাফলের কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ–শৃঙ্খলের উপর জটিল আঘাত, যেগুলির সম্মিলিত প্রভাবে গভীরভাবে আহত বিশ্ব একটি ‘পলিক্রাইসিস’–এর মুখোমুখি হয়েছে।
যদিও বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগিতাকে অ্যাজেন্ডা ২০৩০–এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসাবে দেখা হয়েছে, এই ধরনের অংশীদারিত্ব এখন ভূ–রাজনৈতিক ত্রুটি এবং বিরাজমান বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। ২০১৪ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ঘোষণার পর থেকে চিন বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন অংশীদারিত্বের অন্যতম প্রধান চালক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। চিনা উন্নয়ন কর্মসূচির মডেলটিও অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতার একটি প্রধান খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। অ্যাজেন্ডা ২০৩০–এর সঙ্গে একটি সুস্পষ্ট সারিবদ্ধতা এবং আন্তর্জাতিকতার বোধ দেখিয়ে দেয় যে বেজিং তার স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য একটি ভূ–কৌশলগতসহ বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার হিসাবে তার উন্নয়ন সহযোগিতা মডেলকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
সংস্কার ও খোলা দরজা নীতি শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্য থেকে তুলে এনে চিন নিজেকে গ্লোবাল সাউথের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রদানকারীতে রূপান্তরিত করেছে। পরিমাণ ও রাষ্ট্রগুলির পরিপ্রেক্ষিতে চিনের উন্নয়ন সহযোগিতার বিশাল সম্প্রসারণ উন্নয়নের মডেলকে পরিবর্তন করেছে। নতুন সহস্রাব্দে আন্তর্জাতিক মনোযোগ অর্জনের একটি প্রচেষ্টা ছিল প্রথম ফোরাম অন চায়না–আফ্রিকা কোঅপারেশন আয়োজন করা, এবং এইভাবে আফ্রিকার বাজারে নিজের উপস্থিতি থেকে ফয়দা তোলা। প্রকৃতপক্ষে, বেজিং তার জনপ্রিয় পরিকাঠামোগত কর্মসূচি বিআরআই–এর মাধ্যমে যেভাবে ঐতিহ্যগত পশ্চিমী নেতৃত্বাধীন মডেলকে অস্বস্তিতে ফেলেছে, তা বিবেচনা করলে বলতেই হয় যে আন্তর্জাতিক সহায়তা স্থাপত্যে তার একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে।
বিআরআই–এর পেছনে কী লুকিয়ে আছে?
যাই হোক, এর মডেলটি আরও বেশ কয়েকটি কারণেও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। চিনের উন্নয়ন অংশীদারিত্ব কাঠামোর অনুপ্রেরণা, যার মূল প্রতীক হল বিআরআই, একটি ‘উপভোগ–চালিত বৃদ্ধি’র কৌশল থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কৌশলটি উপভোগের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতির মধ্যে বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে। অভ্যন্তরীণ ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ‘উপভোগ–চালিত বৃদ্ধি’ চালিত করার বিষয়টি চিন তার ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছিল।
২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার পর, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)–সহ প্রধান অর্থনীতিগুলিকে প্রভাবিত করেছিল, বেজিং বুঝতে পেরেছিল যে তার ‘রপ্তানি–চালিত বৃদ্ধি’র দর্শন ব্যর্থ হবে৷ এই মন্দা বিশ্বব্যাপী ভোগের চাহিদাকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থের অস্থিরতার উপর নির্ভরশীল একটি অবিশ্বস্ত বৈদেশিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির মধ্যে একটি নির্ভরযোগ্য বৃদ্ধির শক্তি তৈরি করার প্রয়োজন ছিল, যেটি একটি অর্থনৈতিক কুশন হিসাবে কাজ করবে। এর পরিণতিতে গত দশকে চিনে মজুরি ও বেতন এবং ফলস্বরূপ শ্রম ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চিনা নীতিনির্ধারকেরা সঠিকভাবে আশঙ্কা করেছেন যে এটি তাঁদের রপ্তানিকে বহির্বিশ্বের বাজারে কম প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। এই বিষয়টি আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের বাধ্য করে উৎপাদন শৃঙ্খলের উপাদানগুলিকে এমন গন্তব্যে পাঠানোর কথা ভাবতে যেখানে সস্তা ও প্রচুর মানব ও প্রাকৃতিক পুঁজি পাওয়া যায়।
এই স্থানান্তরটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রাধিকার পূরণ, শাসন ব্যবস্থার উন্নতি, জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়া এবং আর্থ–পরিবেশ সুরক্ষার দিকে চালিত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, এর মধ্যে অভিন্ন উন্নয়নের দিকে যৌথ প্রচেষ্টাকে উন্নীত করার জন্য দক্ষিণ–দক্ষিণ সহযোগিতার (এসএসসি) তত্ত্বাবধানে একটি ‘ভাগ করা ভবিষ্যতের বিশ্ব সম্প্রদায়’ তৈরি করার অন্তর্নিহিত উল্লেখ রয়েছে।
‘উপাদান’ ও ‘পণ্য’ বাজার শোষণ: বিআরআই কি ‘বাজার সাম্রাজ্যবাদ’–এর একটি মডেল?
এক অর্থে, বিআরআই আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার ‘উপাদান’ বাজার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাজারগুলি দখল করার জন্য একটি অনুসন্ধানে পরিণত হয়েছিল। অতএব, চিনা পদচিহ্ন মূলত সেই স্থানগুলিতে লক্ষ্য করা যেতে পারে যেখানে রয়েছে সস্তা ও সমৃদ্ধ মানব পুঁজি, এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য মৌলিক প্রাকৃতিক পুঁজি যা প্রায়শই ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ‘ভূমি’ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এই কারণেই বিআরআই–এর উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায় আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের কিছু অংশের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল অঞ্চল জুড়ে।
বেজিংয়ের কৌশলগত অভিপ্রায়কে যা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে, সেই বিআরআই–এর বিশাল আয়তন ‘বিতর্ক ও সমালোচনার চুম্বক’ হয়ে উঠেছে। সংস্থান বা স্থানীয় বাজারে চিনাদের প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত ও সম্প্রসারিত করতে অ–কার্যকর প্রকল্প স্থাপন করার কারণে বিআরআই–কে বেজিংয়ের ‘ঋণ–ফাঁদ কূটনীতি’র হাতিয়ার হিসাবেও অভিহিত করা হয়েছে। এই ছত্র পরিকাঠামো প্রকল্পের অধীনে উন্নয়ন সহযোগিতার চিনা মডেলটি বেশ কয়েকটি দুর্বল অর্থনীতির উপর ভারী ঋণের বোঝা চাপিয়ে আন্তর্জাতিকীকরণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যেমন বারংবার উল্লেখিত শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর এবং আফ্রিকার প্রায় ২২টি দেশের গুরুতর আর্থিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা।
যদিও সাম্প্রতিক যুগল ধারণা গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) ও গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই)–এর সূচনা করে চিন একটি ‘নতুন উন্নয়ন মডেল’–এর দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দিয়ে থাকতে পারে, চিনের উন্নয়ন সহযোগিতা মডেল থেকে বিআরআই–এর মাধ্যমে উপাদান ও পণ্য বাজার দখল করার ‘বাজার সাম্রাজ্যবাদী নকশা’র গন্ধ পাওয়া যায়। জিডিআই ও জিএসআই উভয়কেই একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে দেখা উচিত — একটি হাতিয়ার যা বেজিং বিশ্ব শাসনের ক্ষেত্রে স্বীকৃতি লাভের জন্য ব্যবহার করতে চায়। চিন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) হল বেজিংয়ের উন্নয়নের কৌশলগত মডেল এগিয়ে নিয়ে চলার আরেকটি বিশিষ্ট উদাহরণ। সিপিইসি ২০১৫ সালের এপ্রিলে চালু করা হয়েছিল পাকিস্তানের দুর্বল রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো ক্ষেত্রটিকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে। চিন তার ‘সব–আবহাওয়া’র মিত্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সিপিইসি–কে একটি প্রয়োজনীয় কৌশলগত দায়বদ্ধতা হিসাবেও বিবেচনা করে। যাই হোক, ইসলামাবাদের সাম্প্রতিক ঋণ সংকট সিপিইসি’র অধীনে উন্নয়ন প্রকল্পগুলির সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকারিতার উপর একটি প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে, কারণ এর ফলে অনুৎপাদনশীল ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এর ফলে কি আরেকটি ‘জমি দখল’ হবে? প্রশ্নটা দীর্ঘ ছায়া ফেলছে!
নীলাঞ্জন ঘোষ অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সেন্টার ফর নিউ ইকনমিক ডিপ্লোম্যাসির পরিচালক।
স্বাতী প্রভু অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সেন্টার ফর নিউ ইকনমিক ডিপ্লোম্যাসি (সিএনইডি)–র অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.