Published on Jan 06, 2023 Updated 0 Hours ago

চিনে ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে শি-এর নতুন মেয়াদের জমি শক্ত নয়

চিনের অভ্যন্তরে বিক্ষোভ কি শি-র ক্ষমতাকে উদ্বেগের মুখে ফেলেছে?

চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ২০তম ন্যাশনাল কংগ্রেস চলাকালীন চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের চাতুর্যের সঙ্গে তৃতীয় দফায় ফের ক্ষমতায় আসার মুহূর্তটির উপর ছায়া ফেলেছে তাঁর শূন্য-কোভিড বা জিরো-কোভিড কৌশলের অবসান ও প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবিতে লড়তে থাকা প্রতিবাদীদের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ। শি নিজের তৃতীয় মেয়াদ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে অতিমারির এক মারাত্মক পুনরুত্থানের সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে শহরগুলিতে ফের লকডাউন জারি করতে হয়েছে এবং তা সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তীব্র অসন্তোষের সূচনা করেছে। 

জাতীয় ভাবাবেগের ভুল ব্যাখ্যা

লকডাউনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হ্রাসের পাশাপাশি চিনের শূন্য-কোভিড কৌশলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত দুর্ঘটনার ধারাবাহিকতা জনসাধারণের ক্ষোভকে বাড়িয়ে তুলেছে। সর্বশেষ ঘটনাটি জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমচিতে ২৪ নভেম্বর ঘটে, যেখানে একটি আবাসনে আগুন লেগে কমপক্ষে ১০ জন মানুষ প্রাণ হারান। সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টগুলিতে উঠে এসেছে যে, চলাচল রোধ করার জন্য বাধা ও গ্রিলের দরুন অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হয় এবং শহরটি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আবাসনের ব্লকের দরজায় যখন এই গ্রিলগুলি স্থাপন করা হচ্ছিল, তখনই কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সংঘর্ষের বিষয়টি চিনের নানা অঞ্চল থেকে প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসে, যা আখেরে এ কথাই দর্শায় যে, কোভিড-যুদ্ধ সংক্রান্ত কৌশল প্রয়োগের ফলে কঠোর বিধিনিষেধের প্রতি নিম্ন স্তরের প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টগুলিতে উঠে এসেছে যে, চলাচল রোধ করার জন্য বাধা ও গ্রিলের দরুন অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হয় এবং শহরটি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে

গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি সড়ক দুর্ঘটনা কোভিড কড়াকড়ির অপ্রীতিকর দিকগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গুইয়াং (গুইঝো প্রদেশের রাজধানী) থেকে একটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগামী যাত্রীপরিবহণকারী বাস উলটে যাওয়ার ঘটনায় ৩০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। যেহেতু মধ্যরাতের অন্ধকারে এই পরিবহণের আয়োজন করা হয়েছিল, ফলে তা স্বাভাবিক ভাবেই জনমানসে এ হেন পদক্ষেপের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে: প্রাদেশিক রাজধানীতে সংক্রমণের সংখ্যা ন্যক্কারজনক ভাবে কম দেখানোর উদ্দেশ্যেই কি গোপনে স্থানান্তরের চেষ্টা চালানো হয়েছিল? এর আগে কোনও অঞ্চলে পরিস্থিতির অবনতি হলে বেজিং নেতৃত্ব প্রায়শই বর্ষীয়ান পর্যবেক্ষকদের পরিদর্শন পরিচালনা করতে পাঠাত। যেহেতু ঘটনাটি ২০তম পার্টি কংগ্রেসের আগে ঘটে, এ প্রশ্ন সহজেই উত্থাপিত হয়েছে যে, প্রাদেশিক কর্মকর্তারা কি বেজিং নেতৃত্ব দ্বারা নির্ধারিত গোষ্ঠী সংক্রমণের অভ্যন্তরীণ মাত্রাকে একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে বজায় রাখার জন্যই মানুষদের রাতের অন্ধকারে স্থানান্তর করছিলেন? এর পাশাপাশি, লকডাউনের প্রভাব এবং মানুষকে নির্বিচারে ও দীর্ঘ সময় ধরে আলাদা করে রাখার সিদ্ধান্ত মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে বলে জানা যায়। এই প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চিনের ভয়ঙ্করতম বিমান বিপর্যয় সূত্র হতে পারে। মার্চ মাসে বিমান দুর্ঘটনার নেপথ্যে পরিস্থিতি ঠিক কী ছিল যার জন্য ১০০ জনেরও বেশি যাত্রী মারা যান? এর নেপথ্যেও কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল? না কি লকডাউন-প্ররোচিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি বিমানচালককে ইচ্ছাকৃতভাবে প্লেনটিকে ধ্বংস করতে বাধ্য করেছিল? এটি কি সম্ভব যে এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলির বিশ্লেষণে বেজিং নেতৃত্ব যথেষ্ট মনোযোগ দেননি এবং প্রতিটি দুর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট সরকারি ব্যাখ্যা ও সমবেদনার অভাব কোভিড মোকাবিলা কৌশলের বিরুদ্ধে বিরোধিতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা  পালন করেছে? 

র্থনৈতিক চাপানউতোর

যদি এই ঘটনাগুলিও যথেষ্ট না হয়, তা হলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও রয়েছে খারাপ খবর। সিপিসি-র দুর্বলতাকে লুকোনোর জন্য ২০তম পার্টি কংগ্রেসের পরে প্রকাশিত সরকারি তথ্য এ কথাই তুলে ধরে যে, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে জিডিপি ৩.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু অনুমান এ কথাও বলে যে, পার্টি হয়তো এ বছর তাদের বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫.৫ শতাংশ পূরণ করতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে প্রযুক্তি এবং পুঁজি ব্যবহারের সুযোগ দিতে অস্বীকার করায় চিন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। এরই মাঝে ফক্সকনের ঝেংঝোউ প্ল্যান্টে শ্রমিক অসন্তোষ চিনের অর্থনীতির এক নেতিবাচক ভাবমূর্তিই গড়ে তোলে। বিশ্বের বৃহত্তম আইফোন কারখানার কর্মীরা, যা উত্পাদনের প্রায় ৭০ শতাংশের জন্যই দায়বদ্ধ, কঠোর কোভিড বিধিনিষেধের কারণে নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে অ্যাপল স্টক প্রভাবিত হয়েছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে এর ফলে অ্যাপল ফোনের উত্পাদন ব্যাহত হতে পারে। এই কারণে বিনিয়োগকারীরা সংস্থাটির নিজস্ব সরবরাহ শৃঙ্খল বজায় রাখার ক্ষেত্রে চিনের উপর অতিনির্ভরতা পুনরায় ভেবে দেখার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করবেন। যদি অ্যাপলের মতো বাজারের একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব তার সরবরাহ শৃঙ্খলে চিনের উপর নির্ভরতা পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে তা অন্য কর্পোরেটদের কাছ থেকে অনুরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে প্রযুক্তি এবং পুঁজি ব্যবহারের সুযোগ দিতে অস্বীকার করায় চিন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। 

মতপ্রচার ও জবরদস্তির সীমাবদ্ধতা

শি মাওয়ের আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর তৃতীয় দফার শাসনভার গ্রহণ করেছেন এবং দেশের যুবসম্প্রদায়কে চালিত করার লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেছেন। এটি শুরু হয়েছিল নতুন শাসক অভিজাতদের ইয়াননে যাত্রা করার মাধ্যমে, যেটি ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল কমিউনিস্টদের ঘাঁটি। শি হংকি  খালও পরিদর্শন করেছিলেন, যা মাও যুগে ছিল শ্রমিকদের অর্জনের প্রতীক। তিনি তরুণদের হংকি খালের চেতনা অনুকরণ করার আহ্বান জানান, যা কঠোর পরিশ্রমের গুরুত্বকে প্রাধান্য দেয়। পার্টির কাছে তাঁর কাজের প্রতিবেদনের আগে, শি জাতীয় পুনর্জাগরণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন, যা মূলত চিনের মহত্ত্বকে তুলে ধরে, একই সঙ্গে এর উত্থান নিয়ন্ত্রণে বহিরাগত শক্তির প্রচেষ্টার বিষয়েও সতর্ক করে। বিক্ষোভের বর্তমান প্রবাহ এ কথাই তুলে ধরে যে, যুব মনোবল বাড়ানোর জন্য অতীতের সংগ্রামগুলিকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ফল নেতিবাচক হতে পারে। চিন নিরাপত্তা বাড়িয়ে বিক্ষোভের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কিছু গ্রামীণ ব্যাঙ্ক সাধারণ মানুষকে তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যবহারে বাধা দেওয়ার ফলে সৃষ্ট বিক্ষোভ থেকে এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই আজ চিনের তরুণরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত হওয়ায় এই ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শি চিনা দাবা খেলার একটি ক্লাসিক জুগজওয়াং চালের মুখে পড়েছেন। শিকে যেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, এ কথা ঠিক, তেমনই আবার সামনের পথে বিপদও আছে। এ ক্ষেত্রে যে কোনও রকম ছাড় দুর্বলতার চিহ্ন হিসেবে দেখা হতে পারে এবং তা প্রতিবাদকারীদের সাহস জোগাতে যথেষ্ট। কিন্তু দমন ও পীড়নের পথ নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সুতরাং সিপিসিকে ক্ষমতায় বহাল রাখার নেপথ্যের তিনটি স্তম্ভ – প্রচার, হিংসা এবং অর্থনৈতিক সাফল্য নড়ে গিয়েছে। 

বিক্ষোভের বর্তমান প্রবাহ এ কথাই তুলে ধরে যেযুব মনোবল বাড়ানোর জন্য অতীতের সংগ্রামগুলিকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ফল নেতিবাচক হতে পারে। 

অভূতপূর্ব বিজয়ের উচ্ছ্বাস কখনও কখনও অনেকের, এমনকি এক জন অভিজ্ঞ নেতারও দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দিতে পারে। তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর শি, যিনি দীর্ঘ দিন ধরে বিদেশ সফর এড়িয়ে গিয়েছিলেন, ইন্দোনেশিয়ায় জি২০ সম্মেলনের পর এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা শীর্ষ সম্মেলনের জন্য তাইল্যান্ডে তাঁর সাম্প্রতিক সফরের মাধ্যমে বিশ্ব মঞ্চে পুনরাবির্ভূত হয়েছেন। রোমানিয়ার নিকোলাই চাউসেস্কুর ভাগ্যের কথা এ ক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি, যিনি ব্যক্তিগত ক্ষমতাকে ব্যাপক ভাবে কেন্দ্রীভূত করতে সক্ষম হলেও কিন্তু বিভিন্ন দল, সেনাবাহিনী এবং তাঁর নিজের কমিউনিস্ট পার্টির সহকর্মীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হন। শি-কেও মনে রাখতে হবে যে, কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.