Published on Dec 02, 2021 Updated 0 Hours ago

২০২০ সালের কোনও এক সময়ে চিন ভারতের সঙ্গে বিতর্কিত ভূখণ্ডে একটি গ্রাম নির্মাণ শুরু করে।

ভারতের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভূখণ্ডে চিন কি নতুন নির্মাণকার্য চালাচ্ছে?

২০২০ সালের জুন মাসে গলওয়ান সংঘর্ষের পর থেকে ভারত-চিন সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সামরিক স্তরে এবং কূটনৈতিক মহলে একাধিক দফায় আলাপ-আলোচনা সত্ত্বেও দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াটি খুব ধীর গতিতে এগিয়েছে। এর পাশাপাশি চিন ও ভারতের অস্থায়ী সীমান্ত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এল এ সি) উভয় পাশেই নতুন করে ৫০ থেকে ৬০ হাজার সেনা মোতায়েন করা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চললেও চিন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গ্রাম নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চিনের এই কার্যকলাপ নিয়ে গত প্রায় এক বছর যাবৎ কানাঘুষো শোনা গেলেও ব্যাপারটি ভারতীয় নীতি নির্ধারক মহল এবং সংবাদমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে যখন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সাম্প্রতিক বার্ষিক রিপোর্টে চিনের সামরিক ক্ষমতার হিসেব তুলে ধরা হয়।

এই বছরের জানুয়ারি মাসে চিনের তরফে জানানো হয় যে, অরুণাচল প্রদেশে গ্রাম নির্মাণ ‘নিন্দার ঊর্ধ্বে’। কারণ চিন কখনওই অরুণাচল প্রদেশকে ‘স্বীকৃতি’ দেয়নি। পেন্টাগনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘২০২০ সালের কোনও এক সময়ে পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার পূর্বাঞ্চলে, তিব্বতের স্বশাসিত অঞ্চল এবং অরুণাচল প্রদেশের মধ্যবর্তী বিতর্কিত জমিতে ১০০ পরিবারের একটি গ্রাম নির্মাণ করে।’

এই ঘটনার ফলে ভারত যারপরনাই সংকটে পড়েছে। এক দিকে একাধিক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যে জমিতে গ্রামের নির্মাণ হয়েছে সেটি অন্তত ১৯৫৯ সাল থেকেই চিনের সামরিক নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই নির্মাণ রুখতে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া ভারতের বিশেষ কিছুই করার নেই। সমান্তরাল ভাবে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অন্য ভূখণ্ডে চিন পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে। এই অঞ্চলগুলি ভারত তার নিজের বলে দাবি করলেও আদতে সেগুলি চিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

সামরিক সুরক্ষার স্বার্থ জড়িত থাকলেও চিন সর্বদাই দাবি জানাবে যে, এই গ্রামগুলিতে শুধু মাত্র সাধারণ স্থানীয় মানুষেরা বসবাস করেন। আর ওই অজুহাতে অধিকৃত ভূখণ্ড থেকে যে নির্মিত গ্রাম সরানো সম্ভবপর নয় এবং সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডটি নিয়ে আর কোনও রকম আলাপ-আলোচনার পথও খোলা নেই, এমনটাই তারা প্রতিপন্ন করতে চায়।

সাম্প্রতিক পট পরিবর্তনের ফলে ভারতের সকল পূর্ববর্তী কূটনৈতিক প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। এর আগে ভারত ও চিন উভয় দেশই এই বিষয়ে সহমত পোষণ করেছিল যে, সীমান্ত সমস্যা সমাধানে নেওয়া কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই স্থিতিশীল জনপদকে অশান্ত করে নেওয়া যাবে না। নতুন গ্রাম নির্মাণ এবং সেগুলিকে জনবসতিপূর্ণ করে তোলার মাধ্যমে চিন এমন এক নতুন বাস্তবের জন্ম দিচ্ছে যার ফলে যে কোনও ভবিষ্যৎ চুক্তি আরও কঠিন হয়ে উঠবে। এই নবনির্মিত গ্রামগুলি কি শুধু মাত্র সাধারণ মানুষদের বসবাসের জন্য তৈরি করা, না কি এগুলির মাধ্যমে সীমান্তে চিন লুকিয়ে সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করছে… সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সামরিক সুরক্ষার স্বার্থ জড়িত থাকলেও চিন সর্বদাই দাবি জানাবে যে, এই গ্রামগুলিতে শুধু মাত্র সাধারণ স্থানীয় মানুষেরা বসবাস করেন। আর ওই অজুহাতে অধিকৃত ভূখণ্ড থেকে যে নির্মিত গ্রাম সরানো সম্ভবপর নয় এবং সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডটি নিয়ে আর কোনও রকম আলাপ-আলোচনার পথও খোলা নেই, এমনটাই তারা প্রতিপন্ন করতে চায়।

ভারত সরকারের তরফে  নিয়ে কোনও প্রতিবাদ জানানো হয়নি।

ভারতের সামনে প্রধান প্রশ্নটি হল এই যে, চিন কি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে স্থিতাবস্থা লঙ্ঘন করেছে এবং একই সঙ্গে ভারত কি নতুন করে চিনের কাছে তার ভূখণ্ড খুইয়েছে? ভারত সরকারের সমালোচকেরা এমনটাই দাবি করেছেন। পাশাপাশি ভারত সরকারের সমর্থকেরা বলছেন, এই গ্রাম নির্মাণের ফলে ভারত মোটেও নতুন করে তার কোনও জমি হারায়নি। কারণ এই সব নির্মাণকার্য যে জমিতে হয়েছে, সেগুলি দীর্ঘ দিন যাবৎ চিনের আওতাধীন।

স্পষ্টতই, এই সমস্যাটি এত সহজে মেটার নয়। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের যুক্তিতেই সারবত্তা আছে। এ কথা যদিও ঠিক যে চিন অধ্যুষিত অঞ্চলে সামরিক সংঘাত ছাড়া কোনও প্রকার কাজেই ভারত বাধা দিতে পারে না, তবুও এই নির্মাণের ফলে ভূখণ্ডের সীমান্ত সংক্রান্ত টানাপড়েনের ছবিটা যে বদলে যাবে, সে কথাও অনস্বীকার্য। ভারত এই বিষয়ে আরও বেশি প্রতিবাদী হতে পারত কারণ উভয় দেশের বিতর্কিত সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলির অন্য কোনও স্থানে চিন যে তার এই কৌশলের পুনরাবৃত্তি করবে না, এমনটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যদিও ভারতের তরফে জানানো কোনও রকম আপত্তিতেই চিন কান দেবে না। চিনের ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন হত না, তবুও প্রতিবাদ না জানিয়ে এ হেন ঘটনা মেনে নেওয়া এই ভূখণ্ডে চিনের নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেওয়ারই সমতুল্য।

বর্তমানে এমনটা মনে হতে পারে যে চিন তার সেনাকে অগ্রসর করে এই জায়গাগুলির দখল নিয়ে ভারতীয় টহলদারির ক্ষমতাকে খর্ব করেছে। অরুণাচল প্রদেশে গ্রাম নির্মাণের তুলনায় এই ঘটনাটি অবশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এর ফলে গত বছরের ভারত-চিন সংঘর্ষের ঘটনার প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এক দিকে যখন কূটনৈতিক এবং সামরিক উভয় স্তরেই ভারত রক্ষণশীল মনোভাব নিয়েছে, তখন অন্য দিকে চিন তীব্র আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়েছে এবং আনুষঙ্গিক সামরিক কার্যকলাপে ব্রতী হয়েছে। ভারত কেবল মাত্র এক বারই আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, যখন তারা কৈলাস রেঞ্জে সামরিক অভিযান চালায়। এর ফলে চিন পিছু হঠতে বাধ্য হয়, চিনকে রক্ষণশীল হতে হয় এবং তারা প্যাংগং লেক নিয়ে সমঝোতা করতে রাজি হয়। এগুলি ছাড়া যদিও সীমান্তে উদ্ভূত সংকটের জন্য ভারত চিনকে দায়ী করতে পিছপা হয়নি, তবুও চিনের এই ব্যবহারের জন্য নয়াদিল্লির তরফে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপও করা হয়নি।

ভারতের জন্য একটি বড় ধাক্কা হল লাদাখে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ টহলদারি কেন্দ্র হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। এগুলির সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। প্রবীণ ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক লেফটেন্যান্ট জেনারেল পনাগ ফিংগারস এরিয়া এবং ডেমচকের দক্ষিণ দিকের এমন অন্তত ৯টি টহলদারি কেন্দ্রের কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলির উপরে ভারতের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এই অঞ্চলগুলি আগে ভারতের আওতায় না থাকলেও সেগুলি অন্তত চিনের নিয়ন্ত্রণাধীনও ছিল না। বর্তমানে এমনটা মনে হতে পারে যে চিন তার সেনাকে অগ্রসর করে এই জায়গাগুলির দখল নিয়ে ভারতীয় টহলদারির ক্ষমতাকে খর্ব করেছে। অরুণাচল প্রদেশে গ্রাম নির্মাণের তুলনায় এই ঘটনাটি অবশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিনের কাছে ভূখণ্ড সমর্পণের প্রেক্ষিতে এটি ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি বলে প্রতিফলিত হতে পারে।

সর্বোপরি গত বছর শুরু হওয়া ভারত-চিন চাপানউতোরের সাম্প্রতিকতম পর্যায় নিকট ভবিষ্যতে থামবে বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে ভারতের সদর্থক প্রচেষ্টা থাকলেও সমস্যা সমাধানের উপায় অবলম্বনে চিন খুব একটা আগ্রহী নয়।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.