ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ দেশটিকে ধ্বংস করেছে এবং রাশিয়াকেও শূন্য করে দিচ্ছে। কিন্তু যেভাবে বৃহৎ রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের ক্ষমতার অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল, ঠিক তেমনই পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞাগুলির কারণে রাশিয়ার কাজ করার ক্ষমতা এবং তার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ পরিচালনা করার দৃঢ় সংকল্পের অবমূল্যায়ন করারও প্রবণতা রয়েছে। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি এই দুই মেরুর মধ্যে অস্বস্তিকরভাবে ঝুলে আছে।
ঘটনাপ্রবাহ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই বিশ্বাসকে ব্যর্থ করেছে যে এখন ‘যুদ্ধের যুগ’ নয়। নয়াদিল্লির কাছে রাশিয়া–কেন্দ্রিক নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবহারিক কারণ রয়েছে, যা তার অস্ত্রাগারে রুশ সিস্টেমের উপর ব্যাপক নির্ভরতা থেকে উদ্ভূত, আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সস্তায় রুশ তেল পাওয়ার কিছুটা সুবিধাবাদী সুযোগ।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর মন্তব্য সম্ভবত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উদ্দেশে একটি তির্যক উপদেশ ছিল। তবে, সামরিক বাহিনীর কথা বললে, তাদের কর্মী ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলি কিন্তু যুদ্ধের থেকে কী কী পাঠ পাওয়া যাচ্ছে তার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে।
জানুয়ারি মাসে পুনেতে এক ভাষণে সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পান্ডে বলেছিলেন চলতি সংঘাত তুলে ধরেছে ‘অপ্রতিসম যুদ্ধের প্রভাব, তথ্য যুদ্ধের সম্ভাবনা, ডিজিটাল স্থিতিস্থাপকতা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অস্ত্রায়ন, যোগাযোগ অনাবশ্যকতা, মহাকাশভিত্তিক সিস্টেম এবং আরও অনেক কিছু, যা সবই প্রযুক্তিগত দক্ষতা দ্বারা চালিত’। ইউক্রেনের যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করার সময় গত বছর যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছিল সেগুলির কিছু বিষয়ে রায় এখন স্থগিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ট্যাঙ্ক অপ্রচলিত হয়ে যায়নি। এটি এখনও যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ইউক্রেনীয়রা জার্মান লেপার্ড ও ইউএসএম ১ ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে শক্তিবৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। প্রযুক্তি, যেমন নেটওয়ার্কযুক্ত ড্রোন, যুদ্ধক্ষেত্রকে অনেক বেশি স্বচ্ছ করে তুলেছে এবং এটি যে কোনও আক্রমণকারীর কাছ থেকে একটি মূল্য আদায় করে।
ইউক্রেনের যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করার সময় গত বছর যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছিল সেগুলির কিছু বিষয়ে রায় এখন স্থগিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
সাঁজোয়া বাহিনী এখনও যুদ্ধের রানি হিসাবে রয়ে গিয়েছে, এবং এর ব্যবহার ধ্বংসাত্মক। যাই হোক, ইউক্রেনীয়দের দ্বারা ব্যবহৃত পশ্চিম–সরবরাহকৃত সিস্টেমের অভ্রান্ততা ও দীর্ঘ পরিসর এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে যে রুশ শৈলীর ভরযুক্ত কামানের দিন গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, মার্কিন অস্ত্রের জন্য ইউরোপে চাহিদা যে বাড়ছে তার কারণ তার কাঁধে বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, সাঁজোয়া উপকরণ ও ড্রোনের মতো কম দামের আইটেমগুলি, যা দামি জেট বা ট্যাঙ্কের থেকে বেশি উপযোগী হিসাবে ইউক্রেনে নিজেদের প্রমাণ করেছে। ফলস্বরূপ, যে যোগাযোগহীন যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, তার পরিবর্তে ইউক্রেনের যুদ্ধটি মানুষে মানুষে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।।
অপ্রতিসম যুদ্ধের বিষয়ে জেনারেল পান্ডের উল্লেখ ইউক্রেনের এই প্রধান পাঠ সম্পর্কে যে আধুনিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ একটি সংক্ষিপ্ত, তীক্ষ্ণ বিষয় নয়। যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি শুরু হবে। ইউক্রেনের জনসংখ্যার তিনগুণ এবং একটি বিশাল সামরিক শিল্প ঘাঁটি ও অস্ত্রের মজুত–ভান্ডার হওয়ার কারণে রাশিয়ার এমন ওজন আছে যা প্রতিহত করা যায় না, তা পশ্চিম কিভকে যতই সমর্থন করুক না কেন।
অ–প্রতিসমতার দিক থেকে, চিন একই ধরনের চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে। চিনের সামরিক ব্যয় ২২৯ বিলিয়ন ডলার হল ভারতের তিনগুণ। সংখ্যার দিক থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর একে অপরের মুখোমুখি সৈন্যদের সংখ্যা মোটের উপর সমান হতে পারে, কিন্তু তার চমৎকার পরিকাঠামো সহ তিব্বত মালভূমি চিনাদের এক মাসের মধ্যে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ, তিনগুণ করতে সক্ষম করে। হতে পারে ভারতীয় পরিকাঠামো সম্প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু এটি চিনাদের যে ভৌগোলিক সুবিধা রয়েছে তার সমান হতে পারবে না।
ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তার সাঁজোয়া শক্তি — কামান ও ক্ষেপণাস্ত্র — বহুগুণ বাড়াতে হবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল সিস্টেমে ড্রোনকে একীভূত করা। দুর্ভাগ্যবশত, প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) ড্রোন উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে।
ইউক্রেন থেকে আরেকটি শিক্ষা হল যে বাস্তব যুদ্ধে গোলাবারুদের খরচ কাগুজে হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রার হবে। সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল এই বিষয়টি নিশ্চিত করা যে, সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ গোলাবারুদ যেন ভারতে তৈরি করা হয় এবং এমন সংস্থাপন থাকে যাতে উৎপাদন দ্রুত বাড়ানো যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হল মহাকাশ, যেখানে চিনারা বিভিন্ন কাউন্টার স্পেস সিস্টেম তৈরি করেছে যা সংঘর্ষের সময় মোতায়েন করা যেতে পারে। ইউক্রেন আমেরিকার সাহায্যে রাশিয়ান আধিপত্য বানচাল করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু এই ধরনের সমর্থন ভারতের জন্য নাও আসতে পারে। তাই ভারতকে অবশ্যই তার ডিজিটাল স্থিতিস্থাপকতার বিকাশ ঘটাতে হবে।
গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে বক্তৃতাকালে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন যে ভারত ‘সার্ভিসিং বা সরঞ্জামের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হয়নি’। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে কিলো ক্লাস সাবমেরিন, মিগ–২৯ ফাইটার ও এমআই–১৭ পরিবহণ হেলিকপ্টার–এর স্পেয়ার পাওয়া, এবং সেইসঙ্গে একে ২০৩ অ্যাসল্ট রাইফেল তৈরির প্রকল্প ও চারটি গ্রিগোরোভিচ (তালওয়ার) শ্রেণির গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট (যার ইঞ্জিন ইউক্রেনে তৈরি হত) সরবরাহে বিলম্ব হয়েছে।
আবার, এই প্রতিবেদনগুলির বিপরীতে, ভারত তার এস–৪০০ মিসাইল রেজিমেন্টগুলি সময়সূচি অনুযায়ী পাচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী যে পাঁচটি পাওয়ার কথা তার দুটি হাতে এসে গিয়েছে, এবং তৃতীয়টি শীঘ্রই পৌঁছনোর কথা৷ সম্প্রতি রাশিয়ার ফেডারেল সার্ভিস ফর মিলিটারি–টেকনিক্যাল কোঅপারেশনের প্রধান দিমিত্রি শুগায়েভ দাবি করেছেন যে ভারত এখনও রুশ অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা, এবং রাশিয়ার ১৫ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক রপ্তানির ২০% ভারতে যায়। গত পাঁচ বছরে ভারত ১৩ বিলিয়ন ডলারের সরবরাহ আমদানি করেছে, এবং ১০ বিলিয়ন ডলারের রুশ সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রের অর্ডার দিয়েছে।
রাশিয়া তার সাজসরঞ্জাম প্রদর্শনের জন্য ১৪তম আন্তর্জাতিক মহাকাশ প্রদর্শনীর (এয়ারো ইন্ডিয়া ২০২৩) সুযোগ কাজে লাগিয়েছে, যা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রদর্শনীর জন্য প্রায় ২০০টি অস্ত্র ও সরঞ্জাম আনা হয়েছিল। গত বছরের এপ্রিলে ভারত একটি স্বল্প পাল্লার হ্যান্ড–হেল্ড সারফেস টু এয়ার মিসাইল ইগলা এস অন্তর্ভুক্ত করেছে। রুশ কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন যে ভারত এয়ারো ইন্ডিয়ার সময় লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও খবর নেই।
এই সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লি বুঝতে পেরেছে যে তাকে সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। সেই অনুসারে প্রতিরক্ষা–শিল্প সক্ষমতা তৈরি করতে নয়াদিল্লি এখন ওভারটাইম কাজ করছে, তবে আরও দুই দশক এর উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাওয়া যাবে না। বর্তমানে ভারত অবশ্য একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, যেখানে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তার কৌশলগত অংশীদারি আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকলেও সামরিক শক্তির গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতার জন্য মস্কোর উপর নির্ভরশীলতাও থেকে যাচ্ছে।
এই ভাষ্যটি প্রথম ‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.