Published on Feb 01, 2023 Updated 0 Hours ago

চিনের কোভিড-নীতি যদি একটি বিপর্যয় হয়ে থাকে, তবে তার হঠাৎ করে উলটো পথে হাঁটা আরও বড় বিপর্যয়

কোভিড–১৯ বিশৃঙ্খলা চিনের রাজনৈতিক মেধাতন্ত্রের কল্পকাহিনিকে ধ্বংস করেছে

২০২০ সালে অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় তিন বছর ধরে কোভিড–১৯ নিয়ন্ত্রণ ‌ব্যবস্থা প্রয়োগের পর আকস্মিক উলটো পথে হেঁটে চিনের তা শিথিল করার ঘটনা দেশটিকে বিহ্বল করেছে। নিষেধাজ্ঞার আকস্মিক শিথিলতা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও  জরুরি পরিষেবাগুলিকে প্লাবিত করেছে, এবং রক্ত ও ওষুধের ঘাটতি দেখা গিয়েছে। প্রবীণ নাগরিকদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ার মৌখিক কাহিনি, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া–ঘরে উপচে পড়া মৃতদেহের ফুটেজ, সোশ্যাল মিডিয়ার খবর ফাঁস করে দেওয়ার ভূমিকা পালন — এসবের পরেও চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বর্তমান সংকটকে শুধুমাত্র একটি ‘‌নতুন কোভিড পরিস্থিতি’‌ হিসাবে অভিহিত করেছেন। চিনের কোভিড-নীতি যদি একটি বিপর্যয় হয়ে থাকে, তবে তার হঠাৎ করে উলটো পথে হাঁটা আরও বড় বিপর্যয়।

কোভিড–১৯ অতিমারি সামলাতে চিনের ব্যর্থতা, এবং তারপর আকস্মিক ও  বিশৃঙ্খলভাবে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে দেওয়া, চিনের উন্নততর ব্যবস্থার জল্পনাটি চিরতরে শেষ করে দিয়েছে।

গর্ডিয়ান নট

উহানে অতিমারি শুরু হওয়ার সময় থেকে এর মোকাবিলার বিষয়টি একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। যাই হোক, গ্রাউন্ড জিরোতে ভাইরাসের বিস্তাররোধে চিনের প্রাথমিক সাফল্য এক অহংবোধ তৈরি করেছিল, এবং এই ধারণাটিকে উৎসাহিত করেছিল যে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য চিনের পথ সঠিক। এখন পিছনে তাকালে বোঝা যায় চিনের কৌশলে প্রচুর ফাঁক ছিল, কিন্তু মুক্ত বিতর্ক ও একটি সমন্বিত বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের অনুপস্থিতিতে ভুলগুলি উপেক্ষা করা হয়েছিল। যেমন, ভাইরাসের সন্ধানে একটি বড় জনসংখ্যার মধ্যে জনে জনে পরীক্ষা করার উপর জোর দেওয়ার অর্থ হল চিকিৎসার পরিবর্তে প্রতিরোধের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা। নিয়মিত পরীক্ষার প্রকল্পগুলির ব্যয় স্থানীয় সরকারগুলি বহন করেছিল, এবং কিছু ক্ষেত্রে ৪৮ ঘণ্টা থেকে এক সপ্তাহের নিয়মিত বিরতির মধ্যে বাসিন্দাদের পরীক্ষা করাতে বাধ্য করা হয়েছিল। চিনের প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরের শহরগুলিতে, যেখানে ৫০০  মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস করেন, সেখানে প্রতি ৪৮ ঘণ্টায় পরীক্ষা করা হলে বছরে পরীক্ষা করার খরচ দাঁড়ায় ১.৪৫ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (২১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা ২০২১ সালের চিনের জিডিপি–র ১.২৭ শতাংশ। চিন ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী লোকেদের টিকা দেওয়ার মাধ্যমে তার টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সম্ভবত এই বিশ্বাসে যে একটি টিকাপ্রাপ্ত কর্মক্ষম শ্রেণি অর্থনীতিকে নতুন করে সচল করবে। এছাড়াও এক–সন্তান নীতির (এখন বন্ধ) উত্তরাধিকার চিনকে একটি বৃহৎ বয়স্ক জনসংখ্যা দিয়েছে, যা অর্থনৈতিক দিক থেকে খুব বেশি ফলপ্রসূ নয়, এবং সেই কারণেই তাঁদের হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছিল। এটি বিশেষ করে ভারত–সহ অন্যান্য দেশের অনুশীলনের, যেখানে বয়স্কদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল, থেকে ভিন্ন ছিল। ঘটনাটি পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষের পক্ষে বয়স্ক ব্যক্তিদের টিকা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা খুব কঠিন করে তুলেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্র প্রবীণ নাগরিকদের জন্য তার টিকাদান কর্মসূচিকে ফাস্ট ট্র্যাক করার প্রয়াস ফের শুরু করে, এবং ২০২৩–এর জানুয়ারির শেষ নাগাদ ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের (২০২০ সালে ৩৬ মিলিয়ন) ৯০ শতাংশকে কমপক্ষে একটি ডোজ দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। অতিমারির তিন বছর হয়ে গেছে, বিভিন্ন দেশের সংক্রমণ মোকাবিলার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জিত হয়েছে, তবুও সিসিপি অন্যদের কাছ থেকে শিক্ষা না–নেওয়ার পথ বেছে নেয়, এবং স্বাস্থ্য-পরিষেবা ব্যবস্থার উন্নয়নের পরিবর্তে গণপরীক্ষা ও কেন্দ্রীভূত কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রগুলিতে মূল্যবান সংস্থান ব্যয় করেছে, যা দিয়ে দেশটি কোভিড–১৯ নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার পর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ মোকাবিলায় আরও ভালভাবে সজ্জিত করতে পারত।

অতিমারির তিন বছর হয়ে গেছে, বিভিন্ন দেশের সংক্রমণ মোকাবিলার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জিত হয়েছে, তবুও সিসিপি অন্যদের কাছ থেকে শিক্ষা না–নেওয়ার পথ বেছে নেয়, এবং স্বাস্থ্য-পরিষেবা ব্যবস্থার উন্নয়নের পরিবর্তে গণপরীক্ষা ও কেন্দ্রীভূত কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রগুলিতে মূল্যবান সংস্থান ব্যয় করেছে।

সিসিপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে

যদিও সিসিপি–র কঠোর কোভিড–১৯ নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার বিষয়ে অভ্যন্তরীণ  আলোচনাগুলি কখনই জনসমক্ষে আসবে না, এমন কিছু ইঙ্গিত রয়েছে যে শাসক  এলিটরা দেরিতে বুঝতে পেরেছিল যে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি একটি রাজনৈতিক সঙ্কটে পরিণত হচ্ছে। পিকিং ইউনিভার্সিটি পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফলগুলি কোভিড–১৯ বিধিনিষেধ দ্বারা সীমাবদ্ধ অর্থনীতির ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রকাশ করেছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অধীনে, সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে, ২০২২ সালে বেকারত্বের অনুপাত ২০২০ সালে উহান প্রাদুর্ভাব সর্বোচ্চ থাকার সময়কার উচ্চতায় পৌঁছতে পারে। তাদের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালের মাঝামাঝি বেকার চিনাদের সংখ্যা প্রায় ৯২.৬৬ মিলিয়ন হয়ে থাকতে পারে, যা মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ১২ শতাংশ। ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কোয়ার বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, এবং তা এখনও সিসিপি–কে শিহরিত করে। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছ থেকে সিসিপি–র স্বৈরাচারী প্রকৃতির বিরুদ্ধে পাল্টা ধাক্কা এসেছে, যেমন গ্রামীণ ব্যাঙ্কে তাঁদের অর্থ ব্লক করার পরে আমানতকারীদের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ থেকে সিসিপি–র নিপীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রগোষ্ঠীগুলির প্রতিবাদ। অসন্তোষের এই অভিব্যক্তিতে চিনা রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল একটি দুর্বল নেতৃত্বের অধীন দেশের জন্য উপযুক্ত, যা মোটেই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি বা একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী বৈশ্বিক শক্তির শোভা পায় না। ‘‌কোনও আমানত নেই, মানবাধিকার নেই‘‌, ‘‌আমরা হেনান সরকারের দুর্নীতি ও হিংস্রতার বিরুদ্ধে’‌ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাঙ্ক আমানতকারীদের উপর ভয়ঙ্কর শারীরিক আক্রমণ এ কথাই বুঝিয়ে দেয় যে চিনের মধ্যে একটি পদ্ধতিগত অব্যবস্থা রয়েছে, এবং চিন একটি ভীরু রাষ্ট্র যার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল বর্ধিত আকারে দমন–পীড়ন। এমনকি ২০২২ সালের নভেম্বরে ছাত্রদের বিক্ষোভেও চিনের প্রতিক্রিয়া ছিল যে তারা ‘শত্রু শক্তি’‌ দ্বারা অনুপ্রাণিত, যা ইঙ্গিত করে যে সিসিপি জনসাধারণের মনোভাব সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছে। তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক কর্ম–সম্মেলন প্রমাণ করে যে অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারগুলি সিসিপি–র অ্যাজেন্ডায় বিলম্বিতভাবে স্থান পেয়েছে, এবং সে জন্যই কর্ম–সম্মেলনে আয় বৃদ্ধি ও শিল্পের উন্নতির উপর আরও বেশি করে জোর দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও দেখা বাকি আছে যে চিনা ইনকর্পোরেটেড কীভাবে জিরো–কোভিড কৌশল থেকে ইউ–টার্ন ও সংক্রমণের পুনরুত্থানের কারণ সৃষ্ট অনুপস্থিতির চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করবে।

প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছ থেকে সিসিপি–র স্বৈরাচারী প্রকৃতির বিরুদ্ধে পাল্টা ধাক্কা এসেছে

সিসিপি তার অপকর্ম ঢাকতে বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়েছে

সব কিছু যত বেশি পরিবর্তিত হবে, তত বেশি সেগুলি একই থাকবে:‌ এই কথাটি  বহু ব্যবহারে জীর্ণ হতে পারে, তবে এটি চিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ১৯৫০–এর দশকের শেষের দিকে, আধুনিক চিনের প্রতিষ্ঠাতা মাও যে দং ফসলের ক্ষতির জন্য দায়ী করে পাখিদের নির্মূল করার লক্ষ্যে একটি প্রচার চালিয়েছিলেন। এই অভিযানের অনিচ্ছাকৃত পরিণতিতে পোকামাকড়ের বিস্তার ঘটে, খাদ্যের মজুদ ধ্বংস হয়, এবং তা দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যান। চিন মাও যুগের বাড়াবাড়ি ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে দূরে সরে গেছে বলে পশ্চিমে ক্রমাগত প্রচার হয়। কিন্তু নভেম্বর পর্যন্ত সংক্রামক রোগটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য চিনের জিরো–কোভিড কৌশলের প্রতি অবিচল আনুগত্য এবং এই সংক্রমণকে প্রাণঘাতী বলে আখ্যা দেওয়া, এবং তারপরে চিনের ঘোষণা যে ভাইরাসটি কম প্রাণঘাতী হয়ে পড়েছে, এসবই দেখায় যে  মাওবাদীদের দায়বদ্ধতাহীন কাজকর্মের সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। অতীতের মতোই এখনও বিজ্ঞানের একচেটিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে এমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য, যা একজন ব্যক্তির — শি জিনপিংয়ের — ইচ্ছানির্ভর, এবং তা এক বিলিয়ন মানুষের ক্ষতি করেছে। সর্বোপরি, অনেক শিক্ষাবিদ, যেমন ড্যানিয়েল বেল তাঁর বই ‘‌দ্য চায়না মডেল’‌–এ যুক্তি দিয়েছিলেন যে সিসিপি সফল হয়েছে কারণ এটি একটি রাজনৈতিক মেধাতন্ত্র, যা ফলস্বরূপ আরও ভাল শাসন ও নীতি নিয়ে আসে। কোভিড–১৯ অতিমারি সামলাতে চিনের ব্যর্থতা, এবং তারপর আকস্মিক ও বিশৃঙ্খলভাবে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে দেওয়া, চিনের উন্নততর ব্যবস্থার জল্পনাটি চিরতরে শেষ করে দিয়েছে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.