সোশ্যাল মিডিয়ার উপর চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। কারণ এর লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ করা এবং বিশ্বমঞ্চে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তোলা।
বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ধারাকে নিজের অনুকূলে আনার জন্য চিনা কমিউনিস্ট পার্টি (সি সি পি) আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হচ্ছে এবং বিষয়টির প্রতি তাদের সুরও আগের চেয়ে আরও পরিশীলিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী সোশ্যাল মিডিয়া মঞ্চগুলি চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (সি সি পি) প্রভাব বিস্তার এবং সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে, সি সি পি কিছু বেসরকারি সংস্থাকে কাজে লাগাচ্ছে এমন বিষয়বস্তু তৈরি করার জন্য, যা তাদের প্রভাব বিস্তারের কাজে লাগবে। একেই বলা হচ্ছেপাবলিক ওপিনিয়ন ম্যানেজমেন্ট। দল বিশ্বব্যাপী সোশ্যাল মিডিয়া মঞ্চগুলিকে নিজেদের মতবাদ প্রচারের কাজে ব্যবহার করলেও, চিনের সাধারণ অধিবাসীদের কাছে সেই মঞ্চগুলি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।
পোস্ট-ট্রুথ বিশ্ব, যেখানে তথ্য এবং অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণ জনমত গঠনে সোশ্যাল মিডিয়া আখ্যানের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে এবং সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের আবেগকে নাড়া দিচ্ছে ক্রমশই, ঠিক সেই প্রেক্ষিতেই সোশ্যাল মিডিয়া চিনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য বিশেষ ভাবে উপযোগী হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একসুইস জীববিজ্ঞানীনাকি দাবি করেছেন, মার্কিন সরকার করোনাভাইরাস অতিমারি ঠিক কোথায় শুরু হয় তা খুঁজে বার করার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রচেষ্টাকে বাধা দিয়েছে। যদিও চিনের সুইস দূতাবাস থেকে এ রকম জীববিজ্ঞানীর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়, তবুও এই আশ্চর্যদাবিকেআরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলার ব্যাপারে চিনা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমগুলিকে আটকানো যায়নি।
সি সি পি তার জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য এবং হংকংয়ে বৃহত্তর স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে সওয়াল তোলা কর্মীদের উপর ক্রমাগত বর্বর আচরণের জন্য সকলের নিন্দা কুড়িয়েছে।
‘ইউনাইটেড ফ্রন্ট’ তত্ত্ব প্রচারের পিছনে সি সি পি-র দুটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল — তাদের কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উৎসগুলির মোকাবিলা করা এবং তাদের দলে টেনে নেওয়া। সি সি পি-র ইউনাইটেড ফ্রন্ট ওয়ার্ক ডিপার্টমেন্ট — যে বিভাগের প্রধান কাজ হল প্রভাব বিস্তার মূলক একাধিক কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা — দেশের অভ্যন্তরে একাধিক সম্ভাব্য বিরোধী পক্ষের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে মনোনিবেশ করে। ২০২১ সালের শুরুর দিকে এই বিভাগ দেশে এবং বিদেশে প্রভাব বিস্তার মূলক কর্মসূচিগুলি চালিয়ে যাওয়ার সংশোধিত নির্দেশিকা জারি করেছে। এই নতুন নিয়মগুলি থেকে দেখা যাচ্ছে — যা ২০১৫ সালের বিধির একটি সংশোধিত রূপ — ইউনাইটেড ফ্রন্টের কার্যকলাপের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। নতুন নির্দেশাবলিতে বিশদ ভাবে বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী চিনাদের এবং চিনে বসবাসকারী তাদের পরিবারগুলিকে ‘পথ’ বাতলে দেওয়ার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথম বার এটিতেনতুন সামাজিক শ্রেণিগড়ে তোলার কাজে ইউনাইটেড ফ্রন্টের লক্ষ্যের কথা বলা হয় যার আওতায় গণমাধ্যমের শাখা, শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ যুক্ত সংস্থায় কর্মরত সুদক্ষ চিনা কর্মী এবং সামাজিক সংগঠনগুলিও পড়ে।
অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী অনেক গুরুত্বপূর্ণ শক্তির সঙ্গে চিনের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। অন্য বিষয়গুলির মধ্যে সি সি পি তার জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য এবং হংকংয়ে বৃহত্তর স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে সওয়াল তোলা কর্মীদের উপর ক্রমাগত বর্বর আচরণের জন্য সকলের নিন্দা কুড়িয়েছে। কোভিড-১৯ অতিমারির সূত্রপাত চিনের মূল ভূখণ্ডে হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে তদন্তকে আরও বিস্তৃত করার আমেরিকান প্রচেষ্টার বিরুদ্ধেও চিন লড়াই করছে। ২০২১ সালের জুনে প্রকাশিত ১৭টি দেশ জুড়ে হওয়া পিউ গবেষণা কেন্দ্রের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকেই সেই সব দেশের নাগরিকরা চিনের প্রতিবিরূপ মনোভাবপোষণ করছে। (চিত্র দেখুন)
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চিনের কূটনৈতিক সংস্থাগুলি আরও সরব হয়েছে এবং চিনের সমালোচনাকারী যে কোনও সরকারকেই কটূক্তি করতে তারা পিছপা হচ্ছে না।
এই কৌশলটিকে ‘উলফ ওয়ারিয়র’ কূটনীতি নামে অভিহিত করা হয়েছে যা একটি বহুল প্রচলিত সিনেমা থেকে গৃহীত। সেখানে চিনের বিশেষ বাহিনী আমেরিকার সৈন্যদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়।
এই সব ঘটনার মধ্যেইশি জিনপিংজোর দিয়েছিলেন যে, চিন যেন নিজের কাহিনি পৃথিবীর সামনে ইতিবাচক ভঙ্গিতেই তুলে ধরে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন ও আন্তর্জাতিক জনমত নির্ধারণে বন্ধুদেশের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও সমর্থ হয়। এই প্রচেষ্টায় সাইবার স্পেসকে ব্যবহার করে নিজেদের প্রচার একটি মুখ্য পদক্ষেপ।
শি প্রথম দিকেই প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহারের সম্ভাবনা উপলব্ধি করেছিলেন।দুর্নীতিরবিরুদ্ধে প্রচার চালানো এবং ব্যক্তিগত অনুগামীদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য শি চিনের জনপ্রিয় মোবাইল মেসেজিং অ্যাপ এবং মাইক্রো-ব্লগিং সাইট উইচ্যাট এবং ওয়েইবোকে কাজে লাগিয়েছেন। চিনে ফেসবুকের উপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সি সি পি অন্যান্য দেশে শি-এর রাষ্ট্রীয় সফরের সময় দলনেতার প্রচারমূলক কাজে এই মঞ্চকে ব্যবহার করেছিল।
২০১৩ সালের ন্যাশনাল প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড ইডিওলজি ওয়ার্ক কনফারেন্সে শি ঘোষণা করেছিলেন, ‘ইন্টারনেটজনমতের সংগ্রামের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রেপরিণত হয়েছে।’ তার পরে তিনি চিনেসাইবার স্পেস নিয়ন্ত্রকসংস্থাগুলিকে দ্রুত সশক্তিকরণের কাজে মন দেন। এক বছর পর সেন্ট্রাল ইন্টারনেট সিকিউরিটি অ্যান্ড ইনফরমেশনাইজড লিডিং গ্রুপের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি এবং সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ চায়না-র (সি এ সি) পুনর্গঠন করেন। এই শীর্ষস্থানীয় সংস্থাটি পূর্বে চিনের প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছিল এবং শি-র করা পরিবর্তনগুলি তাঁকে দেশের ইন্টারনেট নীতির উপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে। সি এ সি প্রধানের জন্য শি-র নির্বাচিতলু ওয়েই, যিনি রাষ্ট্রচালিত জিনহুয়ার সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছিলেন, সি সি পির জার্নাল ‘কিউশি’র (যার অর্থ সত্যের সন্ধান) একটি প্রবন্ধে যুক্তি দিয়েছিলেন যে — তথ্য প্রযুক্তির উপর দলের নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। তিনি এ-ও বলেছিলেন যে, ‘তথ্য নিরাপত্তা ছাড়া কোনও অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বা জাতীয় নিরাপত্তা থাকা সম্ভব নয়।’
আমেরিকার ইনফোটেক সেক্টরের বড় পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে একটি অ্যামাজন সি সি পি-র চাপে শি-র লেখা একটি বইয়ের জন্য তাদের অনলাইন স্টোরে রেটিং ম্যানিপুলেট (অন্যায্য ভাবে নিয়ন্ত্রণ) করেছে।
সি সি পি সাইবার স্পেসকে একটি‘ইন্টারনেট সভ্যতা’হিসেবে মনে করে—যেখানে সব সভ্য শক্তি ‘ক্ষতিকর’ তথ্য প্রচারে রত ও স্বার্থপর উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হয়। মতাদর্শ প্রচারের দায়িত্বে থাকা সি সি পি-র তাত্ত্বিকলিউ ইউনশানবলেছেন যে, ‘ইন্টারনেটের উন্নয়নের প্রতি জাতির দৃষ্টিভঙ্গি অনলাইন জনমত নির্দেশিকাকে শক্তিশালী করা এবং ইতিবাচক মূলধারার জনমতকে শক্তিশালী করার উপরে অগ্রাধিকার দেবে।’ অভ্যন্তরীণ ভাবে চিনে ‘ইন্টারনেট জনমত বিশ্লেষক’ শিরোনামে তথ্য প্রবাহের উপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সাইবার-যোদ্ধাদের একটিবাহিনীরয়েছে। এই কর্মীদের সরকারি প্রচার ইউনিট, বেসরকারি সংস্থা এবং গণমাধ্যম শাখা জুড়ে মোতায়েন করা হয়। চিনের সোশ্যাল মিডিয়ার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পার্টির কার্যকলাপ ইন্টারনেটে হওয়া আলাপ-আলোচনাকে আকার দেয়। এর পাশাপাশি তারা প্রতি বছর অনলাইনে৪৮ কোটি ৮০ লক্ষপোস্ট করে এবং নেতিবাচক মন্তব্যগুলি ডিলিট করে দেয়। এ ছাড়া চিনের বিগ টেকের ‘রেড জিন’, বাইদু-র রবিন লি এবং কুইহো ৩৬০ প্রযুক্তি (ইন্টারনেট নিরাপত্তা পরিষেবা প্রদানকারী) ঝাউ হংই — এঁরা সকলেই চাইনিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্স নামকউপদেষ্টাসংস্থারসদস্য৷
বিগ টেকের জন্য চিনে একটি বড় সুযোগ রয়েছে এবং এই জন্যই ইন্টারনেট শীর্ষকর্তারা সি সি পি-র নেকনজরে থাকতে চান। আমেরিকার ইনফোটেক সেক্টরের বড় পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে একটি অ্যামাজন সি সি পি-র চাপে শি-র লেখা একটি বইয়ের জন্য তাদের অনলাইন স্টোরেরেটিং ম্যানিপুলেট(অন্যায্য ভাবে নিয়ন্ত্রণ) করেছে। মাইক্রোসফ্টের কেরিয়ার নেটওয়ার্কিং সাইট লিঙ্কডইন, চিনের ব্যবহারকারীদের জন্যগ্রেগ ব্রুনোএবং অন্য সাংবাদিকদের অ্যাকাউন্টগুলির অ্যাক্সেস ব্লক করেছে। ব্রুনো, যিনি তিব্বতিদের অবস্থা নথিভুক্ত করেছেন, তিনি হতাশ হয়ে বলেছেন যে, একটি প্রধান মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থা ‘বিদেশি সরকারের দাবিদাওয়ার কাছে নতি স্বীকার করছে।’ লিঙ্কড ইন-এর প্রধান আধিকারিক রায়ান রোসলানস্কি এবং মাইক্রোসফটের অধিকর্তা সত্য নাদেলা কমিউনিস্টপন্থী চিনের তোষামোদ করার জন্য মার্কিন সেনেটর রিক স্কটেররোষের মুখেপড়েছেন।
এই ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া যা আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ায় সামাজিক পরিবর্তন আনতে অনুঘটকের কাজ করেছিল এবং ‘জেসমিন রেভোলিউশন’ এবং ‘আরব স্প্রিং’-এর পক্ষে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল, বর্তমানে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সি সি পি-র প্রভাব বিস্তার মূলক কার্যকলাপের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী সোশ্যাল মিডিয়া মঞ্চগুলিতে প্রবেশ এবং সেগুলি ব্যবহারের মাধ্যমে সি সি পি-র প্রভাব বিস্তার বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রগুলিকে এক সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে। অভ্যন্তরীণ ভাবে চিনে ইন্টারনেটের ক্ষমতাকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে সি সি পি-র প্রয়াসের মডেল এখন গোটা বিশ্বব্যাপী সর্বত্র ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া গণতন্ত্রে জনগণের অংশগ্রহণের একটি প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠেছে, এটি জনমত গঠনে ব্যারোমিটারের ভূমিকাও পালন করে। সাম্প্রতিক সময়ে, যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গণতন্ত্রের ধারণা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হচ্ছে, তখন গণতন্ত্রগুলিকে চিনের সোশ্যাল মিডিয়া মঞ্চগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে স্বর তোলা অবশ্যই উচিত। এর পাশাপাশি সি সি পি-র ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাবিরোধী’গুজব প্রচারকেঅপরাধমূলক ধারার অন্তর্ভুক্ত করা এবং নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া মঞ্চগুলিকে শুধু মাত্র নথিভুক্তসংবাদমাধ্যমের দ্বারা প্রকাশিত প্রতিবেদনতুলে ধরার অন্যায্য আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.
Kalpit A Mankikar is a Fellow with Strategic Studies programme and is based out of ORFs Delhi centre. His research focusses on China specifically looking ...